কুমিল্লা, এক প্রাচীন জনপদ, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে ভরপুর। এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ ইতিহাসের পাশাপাশি এর একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যা কুমিল্লার সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কুমিল্লার ভাষা তার স্বকীয়তা, মাধুর্য এবং প্রাণবন্ততার জন্য পরিচিত। এই ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি কুমিল্লার মানুষের পরিচয়, তাদের আবেগ, অনুভূতি আর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

কুমিল্লার ভাষা কোনো উপভাষা নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা, যা স্থানীয়দের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে মিশে আছে। এই ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর আঞ্চলিক টান। কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কথা বলার ধরনে ভিন্নতা দেখা যায়। কোথাও ‘ক’ এর উচ্চারণ ‘খ’ এর মতো, আবার কোথাও ‘চ’ এর জায়গায় ‘ছ’ উচ্চারিত হয়। এই ধরনের ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য কুমিল্লার ভাষাকে অন্যান্য অঞ্চলের ভাষা থেকে আলাদা করে তোলে। যেমন, “কিতা” (কি), “খাইছিস” (খেয়েছিস), “যাইতাছি” (যাচ্ছি) – এই শব্দগুলো কুমিল্লার ভাষার নিজস্ব রূপের উদাহরণ। এই আঞ্চলিক টান ভাষার মাধুর্য বৃদ্ধি করে এবং একই সাথে স্থানীয়দের মধ্যে একাত্মতার অনুভূতি তৈরি করে।

কুমিল্লার ভাষার শব্দভাণ্ডারও বেশ সমৃদ্ধ। এখানে অনেক শব্দ রয়েছে যা অন্য কোনো অঞ্চলে ব্যবহার করা হয় না। এই শব্দগুলো কুমিল্লার ভাষাকে এক নিজস্ব পরিচয় দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘বাপ্পি’ (বাবা), ‘মাইয়া’ (মেয়ে), ‘হোগ্গি’ (সব), ‘দাইল’ (ডাল), ‘বেডা’ (ছেলে), ‘বউ’ (স্ত্রী), ‘জামাই’ (জামাতা) ইত্যাদি শব্দগুলো কুমিল্লার মানুষের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। এই শব্দগুলো শুধু কুমিল্লার ভাষাকে সমৃদ্ধ করে না, বরং এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, সম্পর্ক এবং সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কেও ধারণা দেয়। কুমিল্লার ভাষার এই শব্দভাণ্ডার লোকসাহিত্যের উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

শুধু শব্দ নয়, কুমিল্লার ভাষার বাক্যগঠনেও রয়েছে বিশেষত্ব। এখানকার মানুষ সাধারণত ছোট ছোট বাক্যে কথা বলতে পছন্দ করে। তাদের কথা বলার ধরনে একটা আন্তরিকতা ও সহজ সরল ভাব থাকে। যেমন, “কিরে, খাইছিস নাকি?” (কি রে, খেয়েছিস নাকি?), “যাইতাছি তহন” (যাচ্ছি তখন), “আইজকা কাম নাই” (আজকে কাজ নেই) – এই ধরনের বাক্যগুলো কুমিল্লার মানুষের স্বাভাবিক কথাবার্তার উদাহরণ। এই ধরনের বাক্যগঠন কুমিল্লার ভাষার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা এটিকে অন্যান্য অঞ্চলের ভাষা থেকে ভিন্ন করে তোলে। এই সরল বাক্যগুলো স্থানীয়দের মধ্যে যোগাযোগের সহজতা তৈরি করে এবং তাদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

কুমিল্লার ভাষা শুধু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি স্থানীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। অনেক কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকার কুমিল্লার ভাষায় লিখেছেন এবং এর মাধ্যমে এই ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। কুমিল্লার আঞ্চলিক গান, নাটক ও সিনেমায় এই ভাষার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আব্দুল গাফফার চৌধুরী, যিনি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” গানটির রচয়িতা, কুমিল্লার ভাষাকে তাঁর অনেক লেখায় ব্যবহার করেছেন। এই ভাষার ব্যবহার কুমিল্লার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে একটি বিশেষ মাত্রা দিয়েছে এবং স্থানীয়দের মধ্যে তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্ববোধ করতে সাহায্য করেছে।

তবে, আধুনিকতার প্রভাবে কুমিল্লার ভাষার ব্যবহার বর্তমানে কিছুটা কমে যাচ্ছে। শহরাঞ্চলে বসবাসকারী অনেক মানুষ এখন প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পছন্দ করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে প্রমিত বাংলার ব্যবহার বাড়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কুমিল্লার ভাষার ব্যবহার সীমিত হয়ে আসছে। কিন্তু, কুমিল্লার ভাষা এখনও সেখানকার মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, এই ভাষার ব্যবহার এখনও দেখা যায়। স্থানীয় লোকেরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে, পরিবারে এবং বন্ধুদের সাথে কথাবার্তায় কুমিল্লার ভাষাকেই প্রাধান্য দেন।

কুমিল্লার ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এর চর্চা করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে এই ঐতিহ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও পৌঁছে দেওয়া যায়। এই ভাষার সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে স্থানীয় সম্প্রদায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর যৌথভাবে কাজ করা উচিত। নতুন প্রজন্মের মধ্যে কুমিল্লার ভাষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যেমন – ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম, আঞ্চলিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, এবং লোকগান ও নাটকের আয়োজন। কুমিল্লার ভাষার এই বৈশিষ্ট্যই তাকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে, যা একইসাথে শ্রুতিমধুর এবং হৃদয়গ্রাহী। এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে কুমিল্লার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কুমিল্লার ভাষা কেবল একটি ভাষাই নয়, এটি কুমিল্লার মানুষের পরিচয়, তাদের আবেগ ও অনুভূতির প্রতিচ্ছবি।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন.

লেখক
মাহফুজা আমির ইলা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং বিভাগ
YSSE