আমরা প্রতিদিন কথা বলি, ভাবনা প্রকাশ করি, মনের অনুভূতি ভাগ করি—আর এই পুরো প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকে ভাষা। ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতি, পরিচয়, আবেগেরও অংশ। কিন্তু আমাদের কথোপকথনে কি সবসময় শুধুই শুদ্ধ মাতৃভাষা ব্যবহৃত হয়? উত্তরটা সহজ—না। আমরা মাতৃভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষাও ব্যবহার করি, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

মাতৃভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ

আমরা যেই ভাষায় বেড়ে উঠি, সেটাই আমাদের মাতৃভাষা। তবে একই ভাষাভাষীর মধ্যে আবার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের উচ্চারণ, শব্দচয়ন এবং বাক্যগঠনের পার্থক্য দেখা যায়, যাকে আমরা আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলি।

ধরো, তুমি যদি ঢাকার মানুষ হও, তাহলে হয়তো বলবে— ‘তুমি কেমন আছো?’ কিন্তু খুলনার কেউ বলতে পারে— ‘তুমি কেমন আছোস?’ কিংবা চট্টগ্রামের কেউ হয়তো বলবে— ‘তুমি কেমনে আছো?’ ভাষাটা বাংলা হলেও, তার রূপ বিভিন্ন অঞ্চলে বদলে যায়।

আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে শুধু উচ্চারণ বা বাক্যগঠনের পরিবর্তন হয় না, অনেক সময় এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে শব্দের অর্থও পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন, ঢাকায় ‘চালাক’ বলতে বুদ্ধিমান বোঝানো হলেও, উত্তরবঙ্গে অনেক সময় এটি ধূর্ততার অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

কথোপকথনে আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব

আমাদের প্রতিদিনের কথায় আঞ্চলিক ভাষার ছাপ স্পষ্ট থাকে, বিশেষ করে যখন আমরা আপনজনদের সঙ্গে কথা বলি। বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় শুদ্ধ বাংলার বদলে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার বেশি আরামদায়ক মনে হয়। অফিস বা আনুষ্ঠানিক পরিবেশে হয়তো আমরা একটু গুছিয়ে বলি, কিন্তু পরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলার সময় আঞ্চলিক ভাষার টান স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে।

কখনো কখনো এই ভাষার মিশ্রণ আমাদের কথাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বলে— ‘এটা তো একদম ফালতু কাইজ্জা হইলো’, তাহলে কথাটার মধ্যে একটা ভিন্নধর্মী স্বাদ থাকে, যা কেবল আঞ্চলিক ভাষার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে একজনের আবেগ প্রকাশ সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ খুব খুশি হয়ে বলে— ‘বাপরে! দারুণ লাগলো!’ তাহলে তা সাধারণ ভাষার চেয়ে বেশি আন্তরিক শোনায়।

আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণ করা কেন জরুরি?

অনেক সময় মনে করা হয়, শুদ্ধ বাংলা ছাড়া অন্যভাবে কথা বলা ঠিক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভাষার বিবর্তন চলমান এবং প্রতিটি অঞ্চলের ভাষাগত বৈচিত্র্য আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। তাই আঞ্চলিক ভাষাকে অবহেলা না করে, বরং সেটাকে সংরক্ষণ করা জরুরি। কারণ, আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে কেবল কথোপকথনই নয়, একটি অঞ্চলের সংস্কৃতি, ইতিহাস, মানুষের জীবনযাত্রার গল্পও বহন করে।

বিশ্বায়নের ফলে অনেক ছোট ছোট ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা আমাদের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণ না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো তাদের পুরোনো সংস্কৃতির অনেক কিছুই জানতে পারবে না। তাই আমাদের উচিত আঞ্চলিক ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং এটি রক্ষার জন্য উদ্যোগ নেওয়া।

আঞ্চলিক ভাষার ভবিষ্যৎ

ডিজিটাল যুগে এসে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার কিছুটা কমে যাচ্ছে। মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলায় লেখার চেষ্টা করে, অনেক ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার কমিয়ে দেয়। কিন্তু ভিডিও কনটেন্ট, ভ্লগ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার নানা প্ল্যাটফর্মে আমরা আবার আঞ্চলিক ভাষার জনপ্রিয়তা বাড়তে দেখছি। তরুণরা তাদের নিজেদের ভাষার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে, যা আশাব্যঞ্জক।

মাতৃভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ আমাদের ভাষাকে করে তোলে আরও রঙিন, আরও প্রাণবন্ত। তাই শুদ্ধ বাংলা শেখা যেমন জরুরি, তেমনি আঞ্চলিক ভাষার সৌন্দর্যকেও উপভোগ করা উচিত। কারণ, ভাষার প্রতিটি রঙ আমাদের পরিচয়েরই অংশ। আঞ্চলিক ভাষা আমাদের শেকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে, আমাদের আত্মপরিচয়কে দৃঢ় করে। তুমি কী বলো?

এরকম আরো ব্লগ  পড়তে, ক্লিক করুন

লেখক

পিয়াস মাহমুদ  

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE