আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত ইউরোপের মানুষজন গুহায় বসবাস করত, ঠিক সে-সময়ে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে প্রাচীন ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল এক সুসংগঠিত সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা, যা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত, বিশ্বের প্রাচীনতম নগর সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ১৯০০ অব্দ পর্যন্ত এই সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। বর্তমান পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তানের কিছু অংশ জুড়ে এই সভ্যতা বিরাজমান ছিল। সিন্ধু সভ্যতা শুধু তার নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যায় এর অবদান আজও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। এছাড়াও উন্নত জীবন মানের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও তারা এক অনন্য আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়ছিল। আজকে আমরা জানবো সেই মহান সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যায় এর অবদান নিয়ে।
নগর পরিকল্পনা ও প্রকৌশলবিদ্যা
সিন্ধু সভ্যতা, যা প্রায় ৫০০০ বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে বিকাশ লাভ করেছিল, তার নগর পরিকল্পনা ও প্রকৌশলবিদ্যা আধুনিক কালের কাছেও অনুসরণযোগ্য।
নগর পরিকল্পনা
সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর সুসংগঠিত নগর পরিকল্পনা। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নগরীতে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, যেখানে শহরগুলো একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল তার প্রমাণ আজও বিদ্যমান।
নগরীর কাঠামোতে পশ্চিমাংশে উঁচু দুর্গ এলাকা এবং পূর্বাংশে সাধারণ মানুষের বসবাসের স্থান ছিল। ঐতিহাসিকদের ধারণা, দুর্গ এলাকায় শাসক ও ধনী ব্যক্তিরা বাস করতেন এবং নিরাপত্তার জন্য কিছু শহরের চারপাশে প্রাচীরও নির্মাণ করা হতো যা কালিবঙ্গানে দেখা যায় ।
শহরগুলোর রাস্তাঘাট ছিল সোজা এবং পরিচ্ছন্ন। ঘরবাড়িগুলো পোড়া ইট দিয়ে তৈরি করা হতো ।
প্রকৌশলবিদ্যা
প্রকৌশলবিদ্যার ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তাদের উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। নগরীর পয়ঃপ্রণালী ছিল উন্নত, যেখানে মাটির নিচে ঢাকা নর্দমা তৈরি করা হয়েছিল। নিয়মিত আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য ম্যানহোলের ব্যবস্থাও ছিল। এই আধুনিক ধারণা অন্য কোনো প্রাচীন সভ্যতায় দেখা যায় না। এছাড়াও কূপ থেকে জল সংগ্রহের ব্যবস্থা ছিল এবং প্রতিটি বাড়িতে স্নানাগার ছিল, যা থেকে জল নর্দমায় গিয়ে পড়ত। এই ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এছাড়াও নৌকা তৈরির ক্ষেত্রেও তারা পারদর্শী ছিল। লোথালে একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বন্দর ছিল, যা অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করত।
গণিত ও পরিমাপবিদ্যা
সিন্ধু সভ্যতার মানুষ গণিত ও পরিমাপবিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তারা ওজন ও পরিমাপের জন্য একটি মানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করত। তাদের ওজনের একক ছিল খুবই সূক্ষ্ম এবং এই সূক্ষ্মতা তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে সহজতর ককরেছিলো। তারা দশমিক পদ্ধতির ব্যবহার জানত, যা পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে গণিতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও, সিন্ধু সভ্যতার স্থাপত্যে জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তারা বর্গ, আয়তক্ষেত্র ও বৃত্তের মতো জ্যামিতিক আকৃতি ব্যবহার করে স্থাপত্য নকশা তৈরি করত। এই জ্যামিতিক জ্ঞান পরবর্তীতে গ্রিক ও মিশরীয় সভ্যতায় গণিতের বিকাশে প্রভাব ফেলে।
ধাতুবিদ্যা ও শিল্পকলা
সিন্ধু সভ্যতার মানুষ ধাতুবিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তারা তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও রূপার ব্যবহার জানত। তারা ধাতু গলানোর জন্য উন্নত চুল্লি ব্যবহার করত এবং বিভিন্ন ধরনের অলংকার, হাতিয়ার ও প্রতিমূর্তি তৈরি করত। তাদের তৈরি ব্রোঞ্জের প্রতিমূর্তি, যেমন “নৃত্যরত মেয়েটি”, শিল্পকলার ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
এছাড়াও, তারা মৃৎশিল্পে অত্যন্ত উন্নত ছিল। তারা চাকতি ব্যবহার করে মাটির পাত্র তৈরি করত এবং সেগুলোতে নানান রকম নকশা অঙ্কন করত। এই শিল্পকলা শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতেও ব্যবহৃত হতো।
কৃষি ও জল ব্যবস্থাপনা
সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর ছিল। তারা বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করত। প্রায় ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বেলুচিস্তানের সিন্ধু উপত্যকায় প্রথম কৃষির উদ্ভব হয় বলে জানা যায়। এই সভ্যতার মানুষরা গ্রীষ্মকালে ধান, ভুট্টা ও শিম এবং শীতকালে গম, বার্লি ও ডাল চাষ করত। সিন্ধু সভ্যতার মানুষ কৃষি ও জল ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তারা সেচের জন্য উন্নত ব্যবস্থা অবলম্বন করত। তারা নদী থেকে পানি সরবরাহের জন্য খাল ও জলাধারের ব্যবস্থা রেখেছিলো, যা কৃষিকাজে সাহায্য করত। এই জল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পরবর্তীতে মেসোপটেমিয়া ও মিশরীয় সভ্যতায় প্রভাব ফেলে। জমিতে লাঙ্গল ব্যবহারের প্রমাণও পাওয়া গেছে। কৃষিকাজের অপরিসীম দক্ষতা তাদের শক্তিশালী অর্থনীতির প্রধান কারণ যা একটি স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
লিপি ও যোগাযোগ
সিন্ধু সভ্যতার মানুষ একটি উন্নত লিপি ব্যবস্থা ব্যবহার করত। যদিও এই লিপি এখনও সম্পূর্ণরূপে পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, তবে এটি তাদের যোগাযোগ ও রেকর্ড রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই লিপি ব্যবস্থা তাদের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে সুসংগঠিত করত।
সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটলেও এর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যার প্রভাব আজও আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাদের নগর পরিকল্পনা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, গণিত, ধাতুবিদ্যা ও কৃষি প্রযুক্তি আধুনিক সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সিন্ধু সভ্যতা আমাদের শেখায় যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার একটি সমাজকে কতটা উন্নত ও সুসংগঠিত করতে পারে। সিন্ধু সভ্যতার অবদান শুধু অতীতের গৌরব নয়, বরং এটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষা।
সিন্ধু সভ্যতা মানব ইতিহাসে একটি মাইলফলক। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অবদান তারা রেখেছে, আজকের আধুনিকতা তারই ফসল।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।
লেখক
শাহ মোহাম্মদ ফজলে এলাহি
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্ট্মেন্ট
YSSE