একটি প্রশ্নযদি আপনার ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়, কেমন লাগবে? ভাবুন তো, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন, চারপাশের সবকিছু বদলে গেছে। স্কুলের বইগুলো এখন এক ভিনদেশি ভাষায় লেখা, যা আপনি পড়তে পারছেন না। রাস্তাঘাটের সাইনবোর্ডগুলো অপরিচিত শব্দে পরিপূর্ণ। কেমন লাগবে? শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসবে,  তাই না?

একটি ভাষা কেবল কিছু শব্দের সমষ্টি নয়, এটি আত্ম-পরিচয় ও অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। ভাষা হারিয়ে গেলে কেবল ভাব প্রকাশের মাধ্যমই নয়, একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস, আবেগ – সব বিলিন হয়ে যায়। এমনটাই হতে বসেছিল আমাদের বাংলা ভাষার সঙ্গে। কিন্তু একদল তরুণ মাথা নত করে নি। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তারা লিখেছে ইতিহাস। 

১৯৫২- সংগ্রামের বছর :

সময়টা ১৯৪৭। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান একসঙ্গে পাকিস্তান নামে গঠিত হলো। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় এক জনসভায় ঘোষণা করে যে “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”  তাহলে বাংলার অবস্থান কোথায়? বাংলাভাষী মানুষদের কি তাহলে তাদের নিজের ভাষা ত্যাগ করতে হবে?

এই ঘোষণা শুনে ক্ষোভে ফেটে পরে বাংলার ৫৬% বাংলাভাষী মানুষ। ঢাকার রাজপথ কেঁপে উঠে প্রবল প্রতিবাদে। ১৯৪৮ সালে ঢাকার ছাত্ররা প্রতিবাদে সরব হলেন। শুরু হলো ক্ষোভ, আন্দোলন, প্রতিবাদ।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ।

কিন্তু সরকার! তারা মানলো না। বরং ৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি, শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হলো ছাত্রদের!রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত সহ ৩৯জন শহীদের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। কিন্তু তাদের এ-ই আত্মত্যাগ বৃথা যায় নি, ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করা হয়। এবং এটি ছিল বিশ্বের একমাত্র আন্দোলন যেখানে ভাষার জন্য জীবন দেয়া হয়েছে।

স্মরণীয় ও দায়িত্ব পালনের দিন:

আজ আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করি। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে, কালো ব্যাজ পরে শহীদের প্রতি সম্মান জানাই। কিন্তু তারপর? আমাদের দায়িত্ব কি এটুকুতেই সীমাবদ্ধ? অবশ্যই না!!

  • বাংলার সাথে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজির মিশ্রণ বন্ধ করতে হবে। 
  • শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে ও লিখতে পারতে হবে। 
  • ভাষার সমৃদ্ধি বাড়ে চর্চার মাধ্যমে। এবং এই চর্চা হয় বাংলা বই পড়ার মাধ্যমে। 
  • নিজের সাহিত্য জানতে হবে, নতুন লেখকদের বই পড়তে হবে।
  • নতুন প্রজন্মকে বাংলার গৌরবময় ইতিহাস জানানোর মাধ্যমে ভাষার সংস্কৃতিকে লালন করতে হবে।

সময় যেমন বদলেছে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু এই আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা কি বাংলা ভাষাকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারছি? আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজির প্রভাব এতটাই বেশি যে অনেক শিক্ষার্থী বাংলাকে অবহেলা করছে। অফিস-আদালত, কর্পোরেট সভা এমনকি দৈনন্দিন কথোপকথনেও বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি বা বাংলিশ ব্যবহার করা যেন ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। তাতে কি বাংলা ভাষা পিছিয়ে পড়ছে?

আমাদের বুঝতে হবে, অন্য ভাষা শেখা দোষের কিছু নয়, বরং তা দরকার। তবে সেটার জন্য নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করা একেবারেই ঠিক নয়। আমরা যদি বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে রাখতে চাই, তাহলে আমাদের ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তিতে বাংলার প্রয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলা কেবলমাত্র একটি বিষয় হয়ে না থেকে জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে।

প্রযুক্তি ও বাংলা ভাষার উন্নয়ন

আশার কথা হলো, এখন বাংলার ডিজিটাল রূপান্তর শুরু হয়েছে। বাংলা ভাষার অভিধান, বাংলা কিবোর্ড, বাংলা ভাষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার—এসব আমাদের ভাষাকে ভবিষ্যতের জন্য আরও শক্তিশালী করে তুলছে। বাংলা ভাষায় কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে আমরা ইন্টারনেটে বাংলার অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারি। ব্লগ লেখা, ইউটিউবে বাংলা কনটেন্ট তৈরি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলার সঠিক ব্যবহারে সচেতনতা তৈরি করা—এসব উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারি।

মাতৃভাষা দিবস শুধু একদিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি আমাদের আন্দোলনের প্রতীক। ভাষা শহীদরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার পাশাপাশি একটা সার্বজনীন সম্মানের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে।  তারা কি সার্থক? আমাদের ভাষাচর্চাই বলে দিবে এর উত্তর।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। 

লেখক

তানমিরা তাকওয়া

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE