“আমি বাংলায় গান গাই,
আমি বাংলার গান গাই “
বাংলা আমাদের প্রাণের মাতৃভাষা। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা আমাদের মায়ের মুখ থেকে বাংলা শুনে বড় হই, তাই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমরা সাধারণত প্রমিত বাংলায় কথা বলে থাকি, যাকে কখনো শুদ্ধ বাংলা বলেও আখ্যায়িত করা হয়। এই প্রমিত বা শুদ্ধ বাংলার বাইরেও রয়েছে বাংলার অঞ্চল ভেদে বাংলা ভাষার আরো অনেক রূপ যেগুলোকে আঞ্চলিক ভাষা বলা হয়। এই আঞ্চলিক ভাষা গুলোও অঞ্চল ভেদে মানুষের মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষা। ভাষার এই বিভিন্ন রূপ বাংলা ভাষায় আনে বৈচিত্র্য।
বাংলা ভাষা এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে পরিমার্জিত হয়ে হাজার বছরের পরিক্রমায়। বাংলা যেরকম সংস্কৃতের পরিবর্তিত রূপ তেমনি অঞ্চল ভেদে সেই অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান ও প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে ভাষার রয়েছে আরো ভিন্ন ভিন্ন রূপ। দূরত্ব অনুসারে ভাষার এই রূপভেদের মধ্যে ঘটে আরও তারতম্য। যেমন সিলেটের ভাষা বা চট্টগ্রামের ভাষার মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। দূরত্ব এবং অঞ্চল ভেদে মানুষের একে অপরের আঞ্চলিক ভাষা বুঝতেও বেগ পেতে হয়। যেমন ধরা যাক, চট্টগ্রাম এবং রাঙামাটির আঞ্চলিক ভাষা ঐ ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষের কাছে বোধগম্য হলেও সিলেটের মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। দুরূহ বোধগম্যতার বিচারে বলতে গেলে এগিয়ে থাকবে চট্টগ্রাম এবং সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা। সমগ্র দেশের মানুষের কাছে ভাষাকে বোধগম্য করে তোলার জন্য সৃষ্টি হয় প্রমিত ভাষার। এক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য যে প্রমিত ভাষায় কথা বলা টা কেবলই প্রয়োজন, এটি কোন ফ্যাশন বা স্ট্যাটাসের অংশ নয়।
বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, কেউ যদি প্রমিত ভাষায় কথা বলতে গিয়ে তার ভাষায় কোনো আঞ্চলিকতার টান আসে তবে সেটিকে একটি হাস্যরসের খোরাক বানিয়ে ফেলা হয়। কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো জেলা শহর থেকে রাজধানীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন তার কথার আঞ্চলিকতাকে কেন্দ্র করে তাকে শিকার হতে হয় নানা লাঞ্চনার। এরকম অভিজ্ঞতা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় মানুষকে কর্পোরেট দুনিয়াতেও ভোগ করতে হয়। কখনো একজন যোগ্য ব্যক্তির চাকরি কেবল এই জন্যই হয় না কারণ তার কথায় আঞ্চলিকতার টান আছে। এই আঞ্চলিকতার প্রতি হীনমন্যতা এখন এক মহামারীর আকার ধারণ করেছে। প্রতিটি গৃহস্থালি হয়ে উঠেছে এখন প্রমিত ভাষা চর্চার প্রাণকেন্দ্র। অভিভাবক এখন সন্তানের কথায় আঞ্চলিকতার টান লক্ষ্য করলে রীতিমতো আৎকে ওঠেন। আঞ্চলিক ভাষাকে একটি অমার্জিত ভাব বিনিময়েী মাধ্যম হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে।
আঞ্চলিক ভাষাকে বর্তমানে ভাষার বিকৃত রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আঞ্চলিকতা বিকৃতি নয়, আঞ্চলিকতা আনে বৈচিত্র্য, ভাষায় আনে মাধুর্য। বাংলা বলতে কেবল প্রমিত ভাষা কে বুঝানো হয় না। বাংলা ভাষার বিভিন্ন রূপ একত্রিত হয়ে তেরি করে সমগ্র বাংলা ভাষা প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষার রয়েছে নিজস্ব সাহিত্যের রূপ, গান, কবিতা, লোকগাথা। যা বাংলার সাহিত্য কে করে আরো সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাই আঞ্চলিক ভাষাকে বাংলা ভাষা থেকে বর্জন করা হবে একরকম বাংলা ভাষার অঙ্গহানীর সামিল। আঞ্চলিকতা ছাড়া ভাষা হারাবে তার বৈচিত্র্য, মাধুর্য। আঞ্চলিক ভাষার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো এক প্রকার অপরাধের সামিল আঞ্চলিকতা কোনো হীনমন্যতা নয়, বরং গৌরবের ব্যাপার। প্রত্যেক অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাই সে অঞ্চলের মাতৃভাষা। আর মায়ের ভাষায় কথা বলা কোনো হীনমন্যতার বিষয় নয়। আঞ্চলিকতা এবং প্রমিত ভাষা কখনোই পরস্পর বিরোধী নয়।
ভাষা হোক সকলের, ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা হোক সার্বজনীন। বাঙালী জাতি তার স্বত্বায় বৈচিত্র্য কে ধারণ করে অতিক্রম করে এসেছে হাজার বছর। বাঙালির বৈচিত্র্যে আঞ্চলিকতা যোগ করুক এক নতুন মাত্রা। মায়ের মুখের ভাষা কারোর জন্য লজ্জার নয় বরং হোক গর্বের বিষয়। আঞ্চলিকতা পরিহার মানুষকে করবে শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন। আঞ্চলিকতার সাথে জড়িয়ে থাকে ঐ অঞ্চলের ঐতিহ্য – ইতিহাস। আঞ্চলিক ভাষা হবে একটি ভালোবাসার বিষয়ে। প্রয়োজনে প্রমিত ভাষার ব্যবহার যেন আঞ্চলিকতাকে ছাপিয়ে না যায়।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন
লেখক
জাবিন তাসমিন
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE