“নদীর জলে আঁকা গল্প, ঢেউয়ের গানে বাজে, ইলিশের গন্ধে ভাসে স্মৃতি, চাঁদপুর মনের মাঝে।”

চাঁদপুর! নামটাই যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। এই জেলার মাটি, পানি, বাতাস—সবকিছুতেই লুকিয়ে আছে নদীর গান, ইলিশের সুবাস আর মানুষের নিখাদ ভালোবাসা। চাঁদপুর মানেই নদী, চাঁদপুর মানেই ইলিশ, আর চাঁদপুর মানেই একদম আপন ঘরবাড়ির মতো শান্তি!

চলুন তাহলে,লেখনীতে চাঁদপুরে আমরা একটু ঢু মেরে আসি! 

চাঁদপুরের ইতিহাস—নদীর বুকে লেখা কাহিনি

চাঁদপুরের ইতিহাস এক কথায় নদীর ইতিহাস। পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে গড়ে উঠা এই জেলা একসময় গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল।মানুষ বলে, বারো ভূঁইয়াদের আমলে চাঁদ ফকির বা চাঁদ সওদাগরের নাম অনুসারে এই অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে চাঁদপুর। আবার অনেকে বলে, মুঘল আমলে চাঁদপুর নাম এসেছে চাঁদ বিবির নামে।

ব্রিটিশ আমলে চাঁদপুর ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। তখন থেকেই এখানে নদীবন্দর গড়ে ওঠে। আবার ধান, পাট, মাছসহ নানা সামগ্রী দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হতো এখান দিয়েই। স্বাধীনতার পরও চাঁদপুর তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এখনো দেশের অন্যতম বড় মাছের আড়ত এখানেই।

নদীর গল্প, মানুষের গল্প 

চাঁদপুরের মানুষ নদীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানকার জেলেরা বছরের বেশিরভাগ সময় মেঘনায় মাছ ধরতে ব্যস্ত থাকে। আর ইলিশ ধরার সময় হলে তো কথাই নেই—তখন চাঁদপুরের প্রত্যেকটা মাছের বাজার যেন এক অন্যরকম উৎসবে পরিণত হয়ে যায়। নতুন ইলিশ আসলে গঞ্জের মোড়ে মোড়ে হাঁকডাক পরে যায় মাছ ব্যবসায়ীদের,আর রান্নাঘরে জুড়ে থাকে ইলিশ ভাঁজার সুঘ্রাণ।

শুধু ইলিশ না, চাঁদপুরের প্রতিটা উৎসবই জমকালো। ইদ, পূজা, বৈশাখ, নবান্ন—যেই উৎসবই হোক, ঘরে ঘরে মজার খাবার আর আড্ডা জমবেই। বাড়ির বড় বউরা শিন্নী পাকায়, ছোটরা দল বেঁধে গান গায়, গঞ্জে মেলা বসে, আর নদীর পারে সারারাত পালাগান চলে। 

‘বেবাক দিন আগে মেলা লাম্বা জীনেরা আসি ক্যান, এই পুলডা বানাইছিলো…’

বলছিলাম শাহরাস্তি, চাঁদপুরের বিখ্যাত ফকিরা পুলের-কথা।লোক মুখে প্রচলিত আছে, এই পুল এক রাতের মধ্যেই নাকি বানানো হয়েছিলো।এরকম অনেক লৌকিক কল্পকাহিনী আপনি চাঁদপুর ভ্রমণে গেলে জানতে পারবেন।

চাঁদপুরের খাবার—ইলিশের রাজত্ব!

চাঁদপুরের খাবারের কথা আসলে ইলিশ মাছ ছাড়া কিছু ভাবাই যায় না! এখানকার ইলিশ শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও সুখ্যাতি পেয়েছে। পূজা আসলে তো বাংলাদেশ-ভারত রীতিমত যুদ্ধ লাগিয়ে দেয় আমাদের ইলিশ কেনার জন্য।পাতলা ঝোল, সরষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ, ইলিশ পোলাও—যেভাবেই রাধবেন সেভাবেই এই ইলিশ সুস্বাদু!নদীর তাজা ইলিশের স্বাদ একবার মুখে লাগলে, মনটা একেবারে তৃপ্ত হয়ে যায়।এছাড়াও মাছের ভর্তা, শুটকি ভাজা, নারকেল দিয়ে চিংড়ি এসব যতবারই খান না কেন, আরও খেতে মন চাইবে। 

তবে শুধু ইলিশই নয়, চাঁদপুরের কিন্তু আরও কিছু জনপ্রিয় খাবার আছে! চাঁদপুরের রসগোল্লা, জিলাপি, সন্দেশের মতো মিষ্টান্নগুলোর খ্যাতি অনেক পুরনো। চাঁদপুর সদরে গেলে, ‘ওয়ান মিনিট আইসক্রিম’ খেতে ভুলবেন না যেন! 

আঞ্চলিক ভাষার মিষ্টি সুর

চাঁদপুরের ভাষার আলাদা একটা মজা আছে। এখানে কথায় কথায় ‘বালা আছো?’ (ভালো আছো?) বা ‘আন্নে খাইছো নি?’ (আপনি খেয়েছেন?) শুনলে মনে হয় যেন নিজের ঘরের মানুষের সাথেই কথা বলছি।

এখানকার ভাষা যেমন মিষ্টি, তেমনি মানুষের মনও ততটাই আন্তরিক। অতিথি আসলে সবাই আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করতে চায়।যার ঘরে কিছুই নেই, সেও আপনাকে নিজের সর্বচ্চোটা দিয়ে আপ্যায়ন করতে চেষ্টা করবে।কারো বাড়িতে মেহমান আসলেই আশেপাশের পাড়া-প্রতিবেশী সব এসে হাজির হবে দাওয়াত দিতে।

‘ইগো, ইজ্ঞারে এক্কান মোড়া দি যা…’, ‘ ইগো, এক্কানা ফ্যান ডা ছাড়ি দে…’ 

এভাবেই ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে ওঠে তারা যখন নিজের কিংবা প্রতিবেশীর ঘরে কেউ বেড়াতে আসে। 

চাঁদপুরের প্রকৃতিও আবার কোন দিক দিয়া কম যায় না, বিকেলের আবহাওয়ায় নদীর পারে বসে পুরানো দিনের গল্প করতে করতে এক কাপ চা খেলে মনটা একেবারে ফুরফুরে হয়ে যাবে। 

চাঁদপুর শুধু জেলা না, এক অনুভূতি!

চাঁদপুর মানে শুধু ইলিশ আর নদী না, চাঁদপুর মানে বন্ধন, ভালোবাসা, ঐতিহ্যের এক মেলবন্ধন। শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে এসে যখন নদীর ধারে বসবেন, তখন বুঝবেন কেন চাঁদপুর মানুষরে এত টানে।

আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে YSSE-এর পক্ষ থেকে এবং চাঁদপুরবাসীর পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। আসুন, আমরা আমাদের আঞ্চলিক ভাষা, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে নিয়ে গর্ব করি, কারণ এগুলোতেই আমাদের পরিচয় গাঁথা আছে!

চাঁদপুরের ভাষায় বলি,

“ভালা থাইকেন, নদীর স্রোতের মতো ফুরফুরা থাইকেন!” 

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখিকা

হুমায়রা ইয়াসমিন 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE