কিছু মানুষ শুধু স্বপ্ন দেখেন না বরং সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পথ তৈরি করেন। শোয়াইবুর রহমান ঠিক তেমনই একজন যিনি কৃষি ও বিজ্ঞানের সংযোগ ঘটিয়ে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছেন। তিনি Agri Science Society-এর প্রতিষ্ঠাতা যেখানে গবেষণা, উদ্ভাবন আর কৃষির ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ হচ্ছে। তাঁর অসাধারণ উদ্যোগের জন্য তিনি Ashoka ও Diana Award পেয়েছেন যা তাঁর কাজের স্বীকৃতিরই প্রমাণ। কিন্তু এই অর্জনের পেছনের গল্পটা কেমন? কীভাবে এক তরুণ পরিবর্তনের এই যাত্রা শুরু করলেন? আজ আমরা শুনবো শোয়াইবুর রহমানের গল্প—তাঁর স্বপ্ন, সংগ্রাম আর সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।

YSSE: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছি।  আপনার জন্ম, পড়াশোনা, বেড়ে উঠা,  বর্তমানে কী কাজ করছেন ইত্যাদি।

শোয়াইবুর রহমান:
আমি গ্রামের আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছি তাই শৈশব থেকেই কৃষিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সেখান থেকেই কৃষির প্রতি আমার গভীর আগ্রহ তৈরি হয় এবং মনে হলো, এই খাতে কিছু করা উচিত। ছোটবেলায় বাবাকে কাজে সাহায্য করতাম আর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কৃষির প্রতি ভালোবাসা জন্মায়।

আমি গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং জেলা পর্যায়ের কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। পরে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করি। বর্তমানে আমি জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছি।

YSSE: আপনি কেন Agri-Science Society (AgSS) প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

শোয়াইবুর রহমান: আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে যেখানে কৃষিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। লক্ষ্য করেছি অনেক কৃষক বাছবিচারহীনভাবে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে যত বেশি সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হবে, তত বেশি ফলন পাওয়া যাবে। কিন্তু এই অতি ব্যবহার পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে যা অনেকেই বুঝতে পারেন না।

যখন আমি হাইস্কুলে ছিলাম, তখন এ বিষয়ে কাজ করার সুযোগ তেমন ছিল না। তবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বিভিন্ন গবেষণা ও ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে পারি যে পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তখনই আমার মনে হলো এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া দরকার যা কৃষকদের পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করবে এবং উচ্চ ফলন নিশ্চিত করবে।

এই চিন্তা থেকেই ২০১৯ সালের মে মাসে আমরা চারজন বন্ধু মিলে Agri-Science Society (AgSS) প্রতিষ্ঠার ধারণা করি। দীর্ঘ আলোচনা ও পরিকল্পনার পর ডিসেম্বরের দিকে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ দল গঠন করতে সক্ষম হই। আমাদের মূল প্রেরণা আসে সেই কৃষকদের কাছ থেকে যারা বছরের একটি অংশ কৃষিকাজ করেন এবং বাকি সময় অন্য পেশায় (যেমন রিকশাচালনা) যুক্ত থাকেন।

ঢাকায় থাকার সময় আমি রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলতাম আর যখন তারা জানতেন যে আমি কৃষির শিক্ষার্থী তখন বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন— “কতটুকু কীটনাশক দেওয়া উচিত?”, “এই রোগ হলে কী করা প্রয়োজন?” ইত্যাদি। আমি বুঝতে পারি এটি শুধুমাত্র কয়েকজনের নয় বরং সবারই সমস্যা। তাই, কৃষকদের সহায়তা করার লক্ষ্যে Agri-Science Society (AgSS) প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিই।

YSSE: কৃষিতে প্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশন নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা কীভাবে পেলেন?

শোয়াইবুর রহমান: আমরা প্রায়ই টেলিভিশন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখি যে বিভিন্ন দেশে কৃষিকাজে ড্রোন ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব দেখেই উপলব্ধি করি যে প্রযুক্তির সহায়তায় কৃষির সম্ভাবনা অনেক বেশি।

উদাহরণ হিসেবে আমেরিকার কথা বললে দেখা যায় তারা কৃষিকাজের বেশিরভাগ অংশেই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কারণ কৃষিকে কেবল একটি পেশা বা চাষাবাদ বললে ভুল হবে— এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসাখাতও। আমাদের অস্তিত্ব এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। উচ্চ ফলন তখনই সম্ভব যখন আমরা কৃষিকাজে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়াব।

জাতিসংঘের FAO (Food and Agriculture Organization) বলছে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে কিন্তু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমতে থাকবে। মূল চ্যালেঞ্জ হলো— আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেব? পাশাপাশি আমাদের অতিরিক্ত উৎপাদনের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। FAO আরও বলছে যদি কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যায় তাহলে ফসল উৎপাদন দ্বিগুণ বা তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব।

এই ভাবনা থেকেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, একটি প্রযুক্তি দল গঠন করব, যারা হয়তো বড় পরিসরে কাজ করতে পারবে না কিন্তু ফার্মিং টেকনোলজি কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। যদিও বাংলাদেশে কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা ও বাধা রয়েছে, তারপরও আমরা বিশ্বাস করি বর্তমান যে প্রযুক্তিগুলো আছে সেগুলো কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যেমন টেকনোলজি ট্রান্সফারের কাজ করে তেমনিভাবে আমরা বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম যাতে তারা সহজেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন।

YSSE: Diana Award 23 ও Ashoka Young Changemaker হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

শোয়াইবুর রহমান: Diana Award 2023 এবং Ashoka Young Changemaker হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল কারণ দুটিই আন্তর্জাতিক সম্মাননা। এটি আমার এবং আমার সংগঠনের জন্য অত্যন্ত গর্বের মুহূর্ত ছিল। আমাদের কাজ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে যা আমাদের জন্য দারুণ অনুপ্রেরণার বিষয়।

আমরা ২০১৯ সালে কৃষি খাতে কাজের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সংগঠন গড়ে তুলি এবং ২০২০ সালের এপ্রিলে জানতে পারি যে আমি Ashoka Young Changemaker হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। এটি ছিল একটি অবিশ্বাস্য অনুভূতি- এত কম সময়ে এত বড় স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের কাজের গুরুত্বকে আরও দৃঢ় করে তোলে।

২০১৯ সাল থেকে আমরা নিরলসভাবে কৃষি খাতে কাজ করে গেছি এবং আমাদের তিন বছরের প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৩ সালে আমি ও আমার সংগঠন Diana Award অর্জন করি। এটি এমন একটি সম্মাননা যা একজন তরুণ তার মানবিক কাজের জন্য সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে পেতে পারে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই সম্মাননা আমাদের শুধু অনুপ্রাণিত করেনি বরং অন্যদেরও উৎসাহিত করেছে যে— সমাজে পরিবর্তন আনতে বড় কিছু করার প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন শুধু ইতিবাচক মানসিকতা ও দক্ষতার উন্নয়ন। এই স্বীকৃতি আমাদের ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার দৃঢ় সংকল্পকে আরও শক্তিশালী করেছে।

YSSE: AgSS কীভাবে কৃষকদের পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি সম্পর্কে সচেতন করছে?

শোয়াইবুর রহমান: আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের কৃষিখাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই AgSS কৃষকদের সঠিক ও পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করে।

আমরা কৃষকদের বুঝানোর চেষ্টা করি যে সঠিক পরিমাণে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করলে ফসলের ফলন বাড়ে, অথচ পরিবেশের ক্ষতি কম হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদের যথাযথ ধারণা দেওয়া যাতে তারা অধিক ফলন পেতে পারেন এবং একই সঙ্গে পরিবেশের সুরক্ষাও নিশ্চিত হয়।

YSSE: ‘Agriculture Virtual Summit’ ও ‘Farmer Consultation Programme’ আয়োজনের উদ্দেশ্য ও এর মূল সফলতাগুলো কী ছিল? এটি কীভাবে কৃষকদের সাহায্য করছে? যদি বলতেন।

শোয়াইবুর রহমান: আমাদের পরিকল্পনা ছিল Agriculture Summit অফলাইনে আয়োজন করার কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। সরকার বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল যার ফলে সরাসরি কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আমরা বুঝতে পারলাম, কাজ থামিয়ে রাখলে হবে না বরং নতুন উপায়ে এগোতে হবে।

সেই চিন্তা থেকেই আমরা Agriculture Virtual Summit আয়োজন করি যেখানে সারা বাংলাদেশের কৃষি বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল কৃষক ও কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। যদিও বেশিরভাগ কৃষক সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় নন তবে বর্তমানে অনেক কৃষি উদ্যোক্তা ও কৃষির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে যুক্ত আছেন।

Farmer Consultation Programme-এর মাধ্যমে আমরা কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যেহেতু কোভিডের সময় সরাসরি সহায়তা দেওয়া সম্ভব ছিল না আমরা ফোনকলের মাধ্যমে কৃষকদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করেছি এবং তাদের সমস্যার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

আমাদের মূল সফলতা ছিল ভার্চুয়াল মাধ্যমে কৃষকদের সমস্যার সমাধান দেওয়া পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কৃষি বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তা ও কৃষকদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন। এই উদ্যোগের ফলে অনেক কৃষক ও কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কৃষি প্রযুক্তি ও আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন যা তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।

YSSE: AgSS এর ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত ১০০টিরও বেশি প্রবন্ধ ও ব্লগের প্রতিক্রিয়া কেমন পাচ্ছেন?

শোয়াইবুর রহমান: প্রতিক্রিয়া দারুণ ছিল। একই উদ্দেশ্যে আমাদের টিম মেম্বাররা কৃষি বিষয়ে লেখালেখি শুরু করে। এর পাশাপাশি কিছু স্বাধীন লেখকও ছিলেন যারা বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তি ও টেকনোলজি নিয়ে লিখতে আগ্রহী ছিলেন। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ও ওয়েবসাইট ছিল যেখানে তারা তাদের লেখাগুলো প্রকাশ করতেন।

মূল বিষয় হলো, কিছু করতে হলে আগে জানতে হয়। আমি এবং আমাদের টিম আগে গবেষণা করতাম, শিখতাম, তারপর সেই জ্ঞান কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। দেশের বাইরেও আমাদের ব্লগ ও প্রবন্ধগুলো থেকে ভালো প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। অনেক পাঠক জানিয়েছেন যে আমাদের লেখা তাদের কৃষি সম্পর্কিত ধারণা বাড়াতে সহায়তা করেছে। আমাদের ব্লগ ও প্রবন্ধগুলো মানুষের শেখার আগ্রহ বাড়িয়েছে এবং কৃষি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

YSSE: ‘Farmer Aid’ প্ল্যাটফর্ম এবং ‘Agricultural Dictionary’ অ্যাপটি কীভাবে কৃষকদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে এবং তাদের সমস্যার সমাধান দিচ্ছে?

শোয়াইবুর রহমান: আমাদের এখানে একটি ব্যর্থতা ছিল। ‘Farmer Aid’ প্ল্যাটফর্ম আমরা তৈরি করেছিলাম কৃষকদের সঙ্গে পরামর্শ না করে। আগেও উল্লেখ করেছি, কৃষকদের অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার সংস্পর্শে থাকেন না এবং একটি অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইট কীভাবে পরিচালনা করতে হয় সেটিও জানেন না। পরবর্তীতে আমরা বুঝতে পারি এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কৃষকদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে না। তবে তরুণদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা সফল হইনি।

এখান থেকে আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি, তা হলো—যখন কোনো সমাধান ডিজাইন করব, তখন অবশ্যই সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার এবং যারা সেই সেবা গ্রহণ করবেন, তাদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। সবকিছু বিবেচনা করে যদি সমাধান ডিজাইন করা হয়, তাহলে সফলতা আসবেই।

অন্যদিকে, আমাদের ‘Agricultural Dictionary’ অ্যাপটি আমাদের অন্যতম বড় উদ্ভাবন। পুরো বিশ্বে কৃষি নিয়ে মাত্র দুটি অভিধান রয়েছে যার মধ্যে একটি আমাদের। এই অ্যাপে কৃষি সম্পর্কিত ৮,০০০-এর বেশি শব্দ ও পরিভাষা সংযুক্ত করা হয়েছে। এই অ্যাপটি মূলত কৃষি শিক্ষার্থীদের ও গবেষকদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী। এটি কৃষকদের জন্য ডিজাইন করা হয়নি।

বর্তমানে সারা বিশ্বে ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ অ্যাপটি ব্যবহার করছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। এটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু এটি বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হচ্ছে তাই আমাদের কাছে বিভিন্ন উন্নতির জন্য পরামর্শ আসে। পাশাপাশি অনেকে প্রশংসা করেন এবং জানান যে তারা উপকৃত হচ্ছেন।

এই অ্যাপটি তৈরি করতে আমাদের ৮ থেকে ১০ মাস সময় লেগেছিল। পুরো টিম অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে এটি বাস্তবায়নের জন্য। ব্যবহারকারীদের ফিডব্যাক ও রিভিউ দেখলে মনে হয় আমাদের শ্রম সার্থক হয়েছে।

YSSE:  আপনার এই উদ্যোগ এবং কাজের জন্য যদি কোনো স্লোগান লিখতে বলা হয় সেটি কী হবে?

শোয়াইবুর রহমান: আমাদের Agri-Science Society এর ট‍্যাগ লাইন হচ্ছে –

“ Let’s make our future of agriculture”

এটি আমি আমার স্লোগান বলতে পারি।

YSSE: Agri-Science Society (AgSS) প্রতিষ্ঠা করার সময় কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন, এবং সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করেছেন?

শোয়াইবুর রহমান: প্রথম যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তা হলো একটি কার্যকর টিম তৈরি করা। এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কারণ দলে এমন মানুষ রাখতে হবে যারা সত্যিকারের কাজ করতে চায়। যেহেতু এটি একটি যুব-ভিত্তিক সংগঠন তাই এখানে নিঃস্বার্থভাবে যথাযথ পরিশ্রম করতে হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কেবল তারাই কাজ করতে পারে যাদের মধ্যে সহানুভূতি রয়েছে। সবাই কিন্তু দেশের বা দেশের কৃষকদের জন্য কিছু করার মানসিকতা নিয়ে আসে না। আমাদের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল এমন উদ্যমী ও নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। আমরা আগ্রহী ও প্যাশনেট ব্যক্তিদের নিয়ে আমাদের টিম গঠন করি এবং তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেই। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষকদেরও এতে সংযুক্ত করি।

আরেকটি বড় সমস্যা ছিল দক্ষতার অভাব। সবাই দক্ষ হয়ে আসে না। যখন আমরা শুরু করেছিলাম তখন আমরাও দক্ষ ছিলাম না। আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখেছি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি এবং এভাবেই ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠেছি।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি ছিল অর্থায়ন। কোনো প্রোগ্রাম বা উদ্ভাবনী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই অর্থায়নের বিষয়টি বিবেচনা করতে হয়। অর্থায়নের জন্য আমরা আমাদের শিক্ষকদের সহায়তা নিয়েছি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সহযোগিতা চেয়েছি। তাদের স্পন্সরের মাধ্যমে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। তবে অর্থায়নের অভাবে অনেক কিছুই করা সম্ভব হয়নি যা আমাদের জন্য একটি দুঃখের বিষয়। যদি পর্যাপ্ত তহবিল থাকতো তাহলে আমরা আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারতাম।

YSSE: আপনার সফলতার পেছনে ব্যক্তিগত এবং পেশাগতভাবে কাদের সাপোর্টের কথা আপনি উল্লেখ করতে চান?

শোয়াইবুর রহমান: আমি বলতে পারি, খুব কম বয়সে আমার টিম সদস্যদের সাথে কৃষিখাতে যতটা প্রভাব রাখতে পারছি, এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার টিম সদস্যদের। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে আমাদের সংগঠনের জন্য। ব্যক্তিগতভাবে, আমি আমার পরিবারেরও সমর্থন পেয়েছি। এর সাথে রয়েছেন আমার শিক্ষকগণ যারা যখন যেমন প্রয়োজন পড়েছে, তখন তাদের থেকে সহায়তা পেয়েছি—এটি ফান্ডিং, টেকনিক্যাল সহায়তা বা গাইডেন্স সব ক্ষেত্রেই। প্রত্যেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণেই আমরা কিছু করতে পেরেছি।

YSSE: কৃষি গবেষণা এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সাথে সহযোগিতার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন?

শোয়াইবুর রহমান: কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সাথে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তাদের প্রধান কাজ হলো টেকনোলজি ট্রান্সফার করা এবং কৃষকদের সহায়তা প্রদান করা। আমরা যদি তাদের সাথে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করি তাহলে অনেক বড় প্রভাব সৃষ্টি করতে পারব। আমাদের অনেক রিসোর্সের অভাব থাকলেও তাদের কাছে সবকিছুর অ্যাক্সেস রয়েছে। তারা পলিসি নির্মাণে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারে। ফলে কৃষিখাতে টেকনোলজির ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হবে। যদিও তারা আইসিটি খাতে তেমন কাজ করছে না তবে এখনই সবচেয়ে বেশি কাজ করা প্রয়োজন। টেকনোলজি সেন্সর ব্যবহার করে কৃষকরা বুঝতে পারবে কখন সার দিতে হবে কখন কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে এবং কখন চাষ করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়নে আমাদের বেশি বিনিয়োগ এবং মাঠ পর্যায়ের পরিশ্রম দরকার। এসব ক্ষেত্রে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারি।

YSSE: ‘AgriPro’ অ্যাপটি কীভাবে কাজ করবে এবং এটি কৃষকদের জন্য কতটা কার্যকর হবে বলে আপনি মনে করেন?

শোয়াইবুর রহমান: আমরা অ্যাপটি ডিজাইন করছিলাম মূলত কৃষকদের জন্য কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারিনি আমাদের পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে। এর মূল কাজ হলো কৃষকরা ফসলের ছবি তুলে যখন আমাদের অ্যাপটিতে আপলোড করবেন তখন অ্যাপটি ফসলের রোগ ডিটেক্ট করবে এবং সেটির ট্রিটমেন্ট সম্পর্কিত সব তথ্য অ্যাপটি প্রদান করবে। কৃষকরা সাধারণত জানেন না ফসলের কী রোগ হয়েছে এবং এর প্রতিকার কী। আমাদের অ্যাপটিতে একটি কমান্ডের মাধ্যমে ফসলের রোগ নির্ণয়সহ কী ট্রিটমেন্ট লাগবে সব জানিয়ে দেওয়া হবে। এটি আমরা কৃষকদের জন্য ডিজাইন করছি। আশা করি কৃষকদের উপকারে আসবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে একটি সার্ভে করেছিলাম ২০০ এর বেশি কৃষকের কাছে। তারা অ্যাপটির জন্য প্রশংসা করেছেন। যদি আমরা অ্যাপটি মার্কেটে নিয়ে আসতে পারি তাহলে আমরা আশাবাদী যে এটি কৃষকদের মাঝে একটি বড় প্রভাব ফেলবে।

YSSE: ভবিষ্যতে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে আপনার লক্ষ্য কী? অথবা Govt. এবং  Non-Govt অরগানাইজেশন কি পদক্ষেপ রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

শোয়াইবুর রহমান: আমাদের প্রধান কাজই হচ্ছে ফুড সিকিউরিটির জন্য। আমরা যেটাই করি, আমাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদন করা। যেহেতু জনসংখ্যা বাড়ছে, আমাদের কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হবে। তার মধ্যে আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি এবং কৃষি বিষয় নিয়ে যারা পড়াশোনা করছেন তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। এগুলো সবই একটি জায়গায় সংযুক্ত হয়; সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের ফুড সিকিউরিটি নিশ্চিত করা। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন অবশ্যই সম্ভব সরকারের সহযোগিতা সহ। আমাদের দেশের খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মধ‍্যস্বত্বভোগী। এই বিষয়টি কমাতে হবে। এই দৌরাত্ম্য কমাতে সরকারকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। এর সঙ্গে পলিসি নিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সবার জন্য একটি অনলাইন অথবা অফলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে যেখানে ভোক্তারা সরাসরি কৃষকদের থেকে পণ্য ও ফসল কিনতে পারবে। এই পদ্ধতিতে মধ‍্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে যাবে এবং ভোক্তা ও কৃষক উভয়ই উপকৃত হবেন।

YSSE: একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশের কৃষিখাতে নতুন প্রজন্মের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

শোয়াইবুর রহমান: কৃষিখাত অনেক বড় একটি সেক্টর। বাংলাদেশের ১২% জিডিপি কৃষির উপর নির্ভর করে। এটিকে বাদ দিয়ে কিছু চিন্তা করা যাবে না। এই খাতে কাজ করার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত যুবক কৃষি কাজ করছে। যদি শিক্ষিত যুবকরা এই কৃষি উদ্যোগে এগিয়ে আসে তাহলে বেশি প্রফিট করা এবং গ্রো করা সম্ভব। কৃষি হচ্ছে বিজ্ঞান। যদি কেউ জেনেশুনে এই খাতে আসে তাহলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। তাছাড়া যারা টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছে তারা কৃষি ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। কিভাবে টেকনোলজির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কৃষক ও ভোক্তা উভয় লাভবান হতে পারে, এমন ব্যবসা, ভলেন্টারি অ্যাক্টিভিটিস, বিভিন্ন ইনোভেশন তরুণরা ডিজাইন করতে পারে। এতে করে প্রোডাকটিভিটি বৃদ্ধি পাবে। আমাদের লক্ষ্য থাকবে উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদন, যাতে করে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এখানে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কেউ পড়াশোনা করে এই বিষয়ে, তাহলে খুব সহজেই সফলতা অর্জন করতে পারবে। আমার এটাই পরামর্শ থাকবে যে কৃষি খাতে গ্যাপগুলো এক্সপ্লোর করা এবং নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে কৃষকদের জন্য কী করা যায়, সেটি নিয়ে কাজ করা।

ধন্যবাদ।

Facebook : https://www.facebook.com/share/15uUqkc7xz/

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখিকা

আনিকা শারমিলা

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE