প্রতিভা কখনো বাধার কাছে হার মানে না। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এক অদম্য তাগিদ থেকে যাঁরা নিজেদের কাজকে সমাজের সেবায় নিয়োজিত করেন, তাঁদের যাত্রা হয় অনুপ্রেরণার গল্প। শাওন মাহমুদ তেমনই এক স্বপ্নদ্রষ্টা—বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা থেকে শুরু করে মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শাওন মাহমুদ একজন বাংলাদেশি সাইন্স কমিউনিকেটর ও লেখক। তিনি ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম “বিজ্ঞানপ্রিয়” প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে একাই গ্রাফিক ডিজাইন ও ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করলেও, নেতৃত্ব ও যোগাযোগ দক্ষতার মাধ্যমে এটি ১০০+ সদস্যের সংগঠনে রূপান্তর করেন। তাঁর ডিজিটাল বিজ্ঞান শিক্ষায় অবদানের জন্য ২০২২ সালে “Joy Bangla Youth Awardএবং ২০২৪ সালে ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট থেকে “BrightSkills Emerging Youth Award” লাভ করেন।

শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার কাজের স্বীকৃতি মিলেছে। “Diana Award 2024”এর মতো সম্মানজনক পুরস্কার তাঁর উদ্যোগ ও অবদানের মূল্যায়ন করেছে। আজকের সাক্ষাৎকার এ আমরা জানবো তাঁর বেড়ে ওঠা, শিক্ষাজীবন, অনুপ্রেরণা, এবং এই স্বীকৃতিগুলোর পেছনের গল্প। 

YSSE: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা, কীভাবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, বর্তমানে কী করছেন ইত্যাদি।

শাওন মাহমুদ: ছোটবেলায় পড়া কম বুঝতাম। বিজ্ঞান পছন্দের বিষয়। সেই বিজ্ঞানের কোনো টপিক খুব সহজেই মাথায় গেঁথে যেত না। বাসায় শিক্ষকদের কাছেও বেশিদিন পড়তে পারতাম না। স্কুলের ক্লাসেও বসতেও বোরিং লাগত। কেউ কোনো টপিক বোঝাতে চাইলে হতাশ হতাম। এরপর গোড়া থেকে পড়া শুরু করতাম। নিজেকে প্রশ্ন করতাম— কেন বুঝব না? সময় লেগে যেত, কিন্তু তবুও নিজে নিজে বোঝার চেষ্টা করতাম। কোনো বিষয়ের একেবারে গোড়া ছুঁতে পারলে তার আকর্ষণটা টের পাওয়া যায়। এমনও হতো, পরীক্ষা চলে এসেছে, অথচ আমি একটা টপিকেই ডুবে মত্ত হয়ে আছি। এভাবে অভ্যাস হয়ে যায়। এই অভ্যাসের দরুন আমার মধ্যে একটা দক্ষতা উঁকি দেয়। যে কোনো টপিক আমি একেবারে দুর্বল, অন্যমনস্ক ছাত্রকেও খুব সহজে বুঝিয়ে দিতে পারতাম। তা হোক ব্যাসিক ফিজিকস কিংবা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কেননা আমি বুঝে গেছিলাম, মনের ঠিক কোন অলিগলি ধরে এগুলে পড়াটা তার মাথায় খেলা করবে। এভাবেই বেড়ে ওঠা। গবেষণাপত্র পড়তে ভালোবাসি। গবেষণার কথা মানুষকে জানাতে ভালোবাসি। পড়েছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে।

YSSE: বিজ্ঞান শিক্ষাকে বাংলায় জনপ্রিয় করতে ‘বিজ্ঞানপ্রিয়’ প্রতিষ্ঠার পেছনের কারণ কী ছিল?

শাওন মাহমুদ: যখন কলেজে পড়ি, তখনই খেয়াল করেছি, ক্লাসে একজন দুজন জেনেটিক্যালি মেধাবী ছাত্র ছাড়া অধিকাংশই আমার মতো। অর্থাৎ সহজে ফিজিকস, কেমিস্ট্রির ধাঁধাঁগুলো ধরতে পারে না। এদের মধ্যে খুব কম অংশই আড়মোড়া ভেঙে শিক্ষককে প্রশ্ন করে। অধিকাংশই সেটুকুও করে না। তাঁদের জানার আগ্রহ আছে, কিন্তু তা কোনোভাবে মাঠে মারা পড়ছে। এক পর্যায়ে তাঁরা শেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অ্যাডমিশনে মোটিভেশন হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে ‘যা পাই তাই পড়ব’ মানসিকতা নিয়ে কোনোভাবে পড়াশোনার সাথে লেগে থাকে। যেখানে চীনের শিশু-কিশোরদের দুশ্চিন্তা— কীভাবে আরও হাল্কা স্যাটেলাইট তৈরি করা যায়, সেখানে আমাদের তরুন-যুবকেরা প্রশ্ন করেন, পৃথিবী কি গোল না সমতল? এমন প্রজন্ম আমরা চাই না। যে প্রজন্মের কাছে ভূত-প্রেত সঠিক, অথচ চাঁদের মাটিতে মানুষের পা রাখার খবর ভুয়া।

এ বিষয়গুলো খুব ভাবাত। জাবির প্রথম বর্ষের ক্লাসে বসে এমন কিছু ভাবতে ভাবতে খেয়াল করি, দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবি। তাতে লেখা ‘ফিজকস ইজ থিওরিটিক্যাল, বাট দ্য ফান ইজ রিয়াল’! যার অর্থ, পদার্থবিজ্ঞান তাত্ত্বিক হলেও, এর পেছনে মজাটা কিন্তু আসল! এই উদ্ধৃতি অনুপ্রেরণা দেয়। আমার মনে হয়, বিজ্ঞানের খুব মজার দিক আছে। যেটা থেকে শিক্ষার্থীরা দূরেই সরে যায়। এই দিকটা যদি আমি আমার প্রজন্মকে দেখিয়ে দিয়ে যেতে না পারি, সেটা আমার অন্যায় হবে। এই অভিপ্রায়েই শুরু হয় বিজ্ঞানপ্রিয়র যাত্রা। শুরুতে কেবল গুটিকয়েক বন্ধুরা সাথে ছিলেন। বর্তমানে দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী যুক্ত।

YSSE: ‘প্রজেক্ট প্রাচি’ এর মাধ্যমে ফার্স্ট-এইড প্রশিক্ষণ দেওয়ার আইডিয়াটি কীভাবে পেলেন? এবং এর পেছনের গল্পটা কী ছিল?

শাওন মাহমুদ: প্রজেক্ট প্রাচি শুরুর গল্পটা বেশ করুণ। ২০২৩ এ আমাদের সামনে এক পথচারি হৃদযন্ত্র জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন। আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। হার্ট অ্যাটাকের একটা সহজ ফার্স্ট অ্যাইড আছে। একঝাঁক মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের মতো কেউই তা জানতেন না। একজন মানুষও যদি সেদিন ফার্স্ট অ্যাইড জানতেন, পথচারিটি ওভাবে মৃত্যুবরণ না-ও করতে পারতেন। খুব অপরাধবোধ জেগে ওঠে আমাদের মধ্যে। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নিই দেশের প্রত্যেকটি স্কুলে প্রাথমিক চিকিৎসা একটি সহশিক্ষা কার্যক্রম হওয়া উচিত। আমাদের পরিকল্পনা ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০,০০০ পরিবারের অন্তত একজনকে প্রাথমিক চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যদিও আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও শুরু করতে হবে। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হলো ‘প্রাচি’। প্রাথমিকভাবে আমরা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহায়তা নিই। তাঁদের টিওটি সার্টিফাইড প্রশিক্ষকের দ্বারা স্কুলে স্কুলে শুরু করি ‘প্রজেক্ট প্রাচি’।

YSSE: আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আপনার জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে?

শাওন মাহমুদ: দীর্ঘ ৬ বছরের যাত্রায় কখনই পুরস্কার প্রাপ্তি আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। বিজ্ঞান গবেষণার ওপর ২৫ হাজার কনটেন্ট, ৩৫০টিরও বেশি ভিডিয়ো ডকুমেন্টারি, আড়াই লাখ বিজ্ঞান-ভিত্তিক আলোচনা— এই ধারায় সচল থাকা একরকম নেশা না থাকলে সম্ভব নয়। কিন্তু পুরস্কার প্রাপ্তি, নমিনেশন— এসব বরাবরই উৎসাহ দেয়। উল্লেখযোগ্য, ডায়ানা পুরস্কার। এটি আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক একটি প্রাপ্তি। এটি কেবল একটি পুরস্কারই নয়, বরং ইতোমধ্যে যে পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি, তার অনন্য স্বীকৃতি। পথটা যেহেতু সঠিক, তখন গতি বাড়ানোটাই হবে প্রথম দায়িত্ব।

সাক্ষাৎকারের ২য় পর্বে আমাদের অতিথির বাকি গল্প সম্পর্কে জানতে পারবেন। এবং আরো কিছু প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে অতিথির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এবং তার কাজের পরিধি সম্পর্কে জানতে পারবেন।

ধন্যবাদ সবাইকে।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন

লেখিকা

খোশবুবা আলম ব্রতী

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE