একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, বিজ্ঞানপ্রেমী ও সমাজসেবক হিসেবে শাওন মাহমুদ কেবল নিজেই এগিয়ে যাচ্ছেন না, বরং একটি নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান ও মানবসেবায় অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। বিজ্ঞানকে সহজবোধ্য করে তোলা এবং সামাজিক সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য।

‘বিজ্ঞানপ্রিয়’ এবং ‘প্রজেক্ট প্রাচি’—এই দুটি উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি একদিকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার পরিবেশ গড়ে তুলছেন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করে জীবন রক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই পথচলা কখনোই সহজ ছিল না যার বিস্তারিত আলোচনা পার্ট -১ এ তিনি করেছেন। নানা চ্যালেঞ্জ, প্রতিকূলতা এবং বাধা অতিক্রম করেই তিনি আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন।

এই পর্বে আমরা জানবো তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস, উদ্যোগগুলোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, চলার পথে চ্যালেঞ্জ এবং সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলো সম্পর্কে। কীভাবে তিনি বারবার শূন্য থেকে শুরু করেছেন এবং কীভাবে এই উদ্যোগগুলো ভবিষ্যতে সমাজ পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, সেই গল্প নিয়েই থাকছে আজকের আলোচনা।

YSSE: আপনার অনুপ্রেরণা কারা বা কী ছিল, এবং তাদের প্রভাব কীভাবে আপনার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে?

শাওন মাহমুদ: বিজ্ঞানীদের লাইফস্টাইল ছোটবেলা থেকেই আমাকে অনুপ্রেরণা দিত। মূলত অজানাকে জানার আকাঙ্খা আমি তাঁদের থেকেই শিখেছি। কিন্তু সেই গতিবিধি ঠিক রেখে সেই আকাঙ্খাকে আকাশচুম্বি উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বাবা। বাবা ছোট দুটো চাকরি করেন। প্রচণ্ডরকম পরিশ্রমি মানুষ। আজ পর্যন্ত একদিনও তাঁকে স্বেচ্ছায় ছুটি কাটাতে দেখিনি। কাজই যেন তাঁর নেশা। প্রতিদিনের কাজ সময়মতো শেষ করা, এরপর পরিবারকে সময় দেওয়া— তাঁর থেকেই শেখা।

YSSE: বিজ্ঞানপ্রিয় এবং প্রজেক্ট প্রাচি-এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

শাওন মাহমুদ: আমরা বাংলা ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানের নেটওয়ার্ক তৈরি করার পরিকল্পনা করছি। উদ্দেশ্য, দেশ-বিদেশে কর্মরত বাঙালী গবেষকদের সাথে প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের সংযোগ সেতু তৈরি করা। দেশের মেধাবী দেশেই থাকবে— এই প্রত্যাশা বাস্তবায়নে দেশে প্রচুর গবেষণাকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান খাত তৈরি করার বিকল্প নেই। যার মূল স্তম্ভ হতে পারে এই পরিকল্পনা। আর প্রজেক্ট প্রাচির প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল রিয়ালিটির ব্যবহার বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছি।

YSSE: এসব উদ্যোগ চালিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল, এবং সেগুলো আপনি কীভাবে অতিক্রম করেছেন?

শাওন মাহমুদ: বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে লোকের বিশ্বাস অর্জন করা। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের কাছে বিজ্ঞান কেবলই ‘সময় কাটানোর খোরাক’। যেন এখনও প্রস্তরযুগে পড়ে আছেন তারা। গরিবের দেশে মানুষ খেতে পাচ্ছে না, সেখানে বিজ্ঞান গবেষণার পেছনে পয়সা ঢালার যৌক্তিকতা কী? জলবায়ু পরিবর্তনের দরুণ পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে, তা আটকাতে আমাদের ভূমিকা কী?— এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করানোটা চ্যালেঞ্জিং। তবে অসাধ্য নয়। আমরা চেষ্টা করছি।

YSSE: একজন সফল সামাজিক উদ্যোক্তা হতে গেলে কোন গুণগুলো থাকা সবচেয়ে জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

শাওন মাহমুদ: সামাজিক উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য এমন কোনো গুণ নেই যা ‘আগে থেকেই’ থাকা জরুরী। বরং কিছু অভ্যেস নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে পারলেই একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— আসল সমস্যা নিয়ে কাজ করা। আমরা অধিকাংশ সময় অতি-উৎসাহিত হয়ে এমন কিছু নিয়ে কাজ শুরু করে ফেলি যা আদোতে বড় কোনো সমস্যাই নয়। ফলে কিছুদিন পরেই আগ্রহ হারিয়ে যায়। আগে সমস্যা চিহ্নিত করুন। নিখুঁতভাবে কাজের পারপাস বা মোটিভ নির্ধারণ করুন। দ্বিতীয়ত— যে কোনো উদ্যোগের পূর্বে ইনফরমেশন সংগ্রহ করে তা ডট কানেক্ট করার জরুরী। বাস্তব জীবনেও এই অভ্যাসের ভূমিকা রয়েছে। তৃতীয়ত এবং সর্বপোরি— লেগে থাকা। হ্যা, বারবার হোঁচট খাবেন। ফেইলিওর এড়াতে পারবেন না। হতাশা কাজ করবে। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে লেগে থাকতে হবে।

YSSE: আপনার এই উদ্যোগ এবং কাজের জন্য যদি কোন স্লোগান লিখতে বলা হয় সেটি কী হবে?

শাওন মাহমুদ: যেসব স্লোগান আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়—

“কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতে অর্থের প্রয়োজন হয় না!”

“বিস্ময়ের শুরু এখানেই!”

“ভালো কাজ হাজারবার শূন্য থেকে শুরু করা যায়!”

YSSE: আপনার কাজের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটি কোনটি? এমন কোনো অভিজ্ঞতার কথা বলুন, যা আপনার জীবন পরিবর্তন করেছে।

শাওন মাহমুদ: বিজ্ঞানপ্রিয়র সাথে জড়িত সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটি ঘটেছিল ২০২১ এর জুলাইয়ে। আমাদের অনলাইন ও অফলাইন কার্যক্রমের একটা বড়ো অংশ ছিল গুজব ও অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে। যা এক শ্রেনীর ক্রোশের কারণ হয়ে ওঠে। ২১শে জুলাই মধ্যরাতে এক ভয়াবহ সাইবার হামলার শিকার হয় বিজ্ঞানপ্রিয়র প্রত্যেকটা সোশ্যাল প্লাটফর্ম। ছয় লাখ সদস্যের গ্রুপ ও ওয়েবসাইট সঙ্গে সঙ্গেই ডিজ্যাবল করে দেওয়া হয়। কিন্তু পেজ হ্যাক করে সেখানে ব্যপক অশালীন ছবি শেয়ার করা হয়। মানসিক চাপ ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ভেঙে পড়ে বিজ্ঞানপ্রিয় টিম। সাত দিনের আপ্রাণ চেষ্টায় পেজটি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও অশালীন কনটেন্ট শেয়ার করায়, পরদিনই তা নিষ্ক্রিয় করে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে বিজ্ঞানপ্রিয়। দুমড়ে মুচরে গেলেও, ভেঙে পড়িনি আমরা। এক মাস সময় নিই। পুনঃরায় গঠন করি টিম। শূন্য থেকে শুরু হয় সবকিছু। কিছুদিনের মাথায় দ্বিতীয়বার সাইবার হামলার শিকার হয় বিজ্ঞানপ্রিয়। দ্বিতীয়বার শূন্য থেকে শুরু করি আবার। একটাই মোটিভ ছিল— বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার এই উদ্যোগ ছিল, আছে, থাকবে।

YSSE: আপনার ভবিষ্যতের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা কী? এবং ভবিষ্যতে আর কী ধরনের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে?

শাওন মাহমুদ: বাংলা ভাষা ও বিজ্ঞানের জন্য কাজ করেছি, করব। ভবিষ্যতে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম তৈরি করতে চাই। যেখানে বিজ্ঞানের সমস্ত রিসোর্স পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ ভাষায়। আমাদের হাত ধরে অসংখ্য গবেষক বের হবেন। দেশেই বিজ্ঞানের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ক্ষুদে গবেষকদের একটা প্লাটফর্ম দিতে চাই। শিশু-কিশোরদের ছোটবেলা থেকেই ছোট ছোট বিজ্ঞান গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে চাই।

YSSE: পরিশেষে, পাঠকদের উদ্দেশ্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

শাওন মাহমুদ: পাঠকদের উদ্দেশ্যে একটাই অনুরোধ থাকবে— আমাদের দেশে শিশু কিশোরদের জানার আগ্রহ শৈশবেই মাটিচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতার গ্যাঁড়াকলে পৃথিবী দূরে থাক, নিজেকে জানার সুযোগও দেওয়া হয় না। দেশ পরিবর্তন করা এই প্রজন্মের জন্য চ্যালেঞ্জিং। এ কারণে পৃথিবীকে জানতে উৎসাহী হতে হবে। সেই উৎসাহের শিখা দু হাতের আড়ালে আমাদেরকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শুভ কামনা সবাইকে।

প্রত্যেক সফল উদ্যোগের পেছনে থাকে অগণিত চ্যালেঞ্জ, অনিশ্চয়তা এবং আত্মত্যাগ। শাওন মাহমুদের যাত্রাও এর ব্যতিক্রম নয়। বারবার প্রতিকূলতার মুখে পড়েও তিনি থেমে যাননি; বরং প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও শক্তিশালীভাবে এগিয়ে গেছেন।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন, সেটি কেবল তাঁর একার নয়—এটি আমাদের সবার স্বপ্ন হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে তাঁর হাত ধরে নতুন গবেষক, নতুন চিন্তক এবং নতুন উদ্যোক্তারা উঠে আসবেন, যারা বিজ্ঞান এবং সমাজসেবাকে হাতিয়ার করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবেন।

একটি দেশ এগিয়ে যায় তখনই, যখন তরুণরা নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের সাহস দেখায়। আপনিও কি সেই পরিবর্তনের অংশ হতে চান? তাহলে আসুন, আমরা সবাই মিলে গড়ি একটি বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিক সমাজ!

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন

লেখিকা

খোশবুবা আলম ব্রতী

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE