আহসান মঞ্জিল ইতিহাসের এক অনবদ্য সৃষ্টিশৈলী। কিন্তু আমরা কি জানি কারা এর নির্মাণ করার পদক্ষেপ নেন? সেই ইতিহাস অনেকেরই জানা নেই। ঢাকার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এক সোনালী অধ্যায় সম্পর্কে জানবো।
অহংকার ও ঐতিহ্যের এক অবিস্মরণীয় স্মারক, আহসান মঞ্জিল। বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল প্রাসাদ একসময় ঢাকার নবাবদের বাসভবন এবং কাচারি ছিল। তবে এর গল্প শুরু হয়েছিল আরও আগে, যখন এটি ছিল শেখ এনায়েতউল্লার রংমহল। ১৮৩০ সালে খাজা আলীমুল্লাহ এটি কিনে নিজের আবাস হিসেবে গড়ে তোলেন। এরপর ১৮৫৯ সালে শুরু হয় প্রাসাদের নির্মাণকাজ, যা শেষ হয় ১৮৭২ সালে। পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে নবাব আবদুল গনি এর নাম দেন আহসান মঞ্জিল।
সেই সময় নতুন প্রাসাদকে বলা হতো রংমহল, আর পুরোনো অংশটি ছিল অন্দরমহল। ১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে এটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নবাব আহসানউল্লাহ অন্দরমহল নতুন করে গড়ে তোলেন এবং রংমহল মেরামত করেন, যেখানে ব্যবহৃত হয় রাণীগঞ্জ থেকে আনা উন্নতমানের ইট। কিন্তু দুর্যোগ এখানেই থামেনি—১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আবারও প্রাসাদটিকে নাড়িয়ে দেয়। নবাব আহসানউল্লাহ আবারও মেরামতের ব্যবস্থা নেন।
এই দুই তলা প্রাসাদটির দৈর্ঘ্য ১২৫.৪ মিটার, প্রস্থ ২৮.৭৫ মিটার। নিচতলার উচ্চতা ৫.৮ মিটার, আর এর উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। একসময় সিঁড়ির সামনে একটি নয়নাভিরাম ঝরনা ছিল, যা আজ আর নেই। তবে তার ঐতিহ্যের সৌন্দর্য একটুও ম্লান হয়নি।
আহসান মঞ্জিল শুধু একখণ্ড স্থাপত্য নয়, এটি সাক্ষী হয়ে আছে সময়ের বিবর্তনের। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে পাকিস্তান গঠনের শুরুর দিনগুলো পর্যন্ত এটি ছিল বাংলার মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। নবাবরা এখানেই তাদের বিচারালয় পরিচালনা করতেন, পঞ্চায়েতের সভাপতি হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এখানে। ১৮৭৪ সালে ভারতীয় গভর্নর-জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক যখন ঢাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে আসেন, তখন তিনি আহসান মঞ্জিলে অবস্থান করেন। ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিনও এখানেই অতিথি হয়েছিলেন। ১৯০৪ সালে বেঙ্গল বিভাজনের প্রস্তাব নিয়ে লর্ড কার্জন যখন পূর্ববঙ্গে আসেন, তখন ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি এই প্রাসাদেই ছিলেন।
ব্রিটিশ ভারতের প্রায় সব ভাইসরয়, গভর্নর ও লেফটেন্যান্ট গভর্নর যখনই ঢাকায় আসতেন, আহসান মঞ্জিলে কিছুটা সময় কাটাতেন। নবাব খাজা পরিবারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই প্রাসাদ। এখান থেকেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল।
কিন্তু সময়ের নির্মমতায় নবাব পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন দেখা দিলে ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলা এস্টেট অধিগ্রহণ আইনের মাধ্যমে ঢাকার নবাব এস্টেট সরকারের হাতে চলে যায়। উত্তরাধিকারীদের জন্য প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এটি ভগ্নদশায় চলে যায়, ভাড়াটিয়াদের অনিয়ন্ত্রিত বসবাসে তা পরিণত হয় এক নোংরা বস্তিতে।
তবে ইতিহাসের মূল্য যে অমূল্য, তা বুঝতে দেরি হয়নি। ১৯৮৫ সালে সরকার আহসান মঞ্জিল ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আওতায় আনা হয়। এরপর শুরু হয় সংস্কারকাজ, যা আজকের আহসান মঞ্জিলকে তার হারানো জৌলুস ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন এটি এক ইতিহাসের দর্পণ, যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই ঢাকার নবাবি আমলের প্রতিচ্ছবি, বাংলার এক অনন্য ইতিহাস।
আহসান মঞ্জিল শুধু ইট-পাথরের এক প্রাসাদ নয়, এটি ঢাকার এক জীবন্ত ইতিহাস। সময়ের ফেরে অনেক কিছু বদলে গেছে, নবাবদের সেই জাঁকজমক আর নেই, কিন্তু এই প্রাসাদ এখনো অতীতের গল্প শুনিয়ে যায়। একসময় যেখানে রাজকীয় আয়োজন হতো, আজ সেখানে ইতিহাসপ্রেমীরা এসে নবাবি আমলের ছোঁয়া খোঁজেন।
ভগ্নদশা থেকে উঠে এসে আজ এটি আমাদের ঐতিহ্যের এক অমূল্য স্মারক। যারা ঢাকার অতীত জানতে চান, তাদের জন্য আহসান মঞ্জিল একদমই মিস করা যায় না। বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাসাদ কেবল অতীতের সাক্ষীই নয়, এটি আমাদের শেকড়ের গল্প বলে—যে গল্প হারিয়ে গেলে আমরা নিজেরাই হারিয়ে যাবো।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা,
আনিকা শারমিলা
ইন্টার্ন,
কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE