মুরাদ আনসারী একজন স্বনামধন্য মানসিক স্বাস্থ্য উদ্যোক্তা এবং Psycure-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। One Young World সম্মেলনে বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণসহ মুরাদ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বীকৃতি অর্জন করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো The Diana Award। এছাড়াও তিনি ‘মনো জগতের আধার আলো’ নামক সাইকো-ফিকশন বইয়ের সম্পাদক। আজকের এই সাক্ষাৎকারে আমরা মুরাদ আনসারীর অনুপ্রেরণা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আরও জানতে এবং তার কাজের গভীরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। মানসিক স্বাস্থ্য প্রচারে তার অবদান এবং অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের নতুনভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।

YSSE: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং বর্তমানে কী কাজ বা প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত আছেন?

মুরাদ আনসারি: আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পুরোটাই জামালপুরে। বর্তমানে আমি Psycure নিয়ে কাজ করছি, যা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। আমাদের লক্ষ্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করে তোলা এবং সবার নাগালের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া।

YSSE: ক্লিনিকাল সাইকোলজি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পেছনে মূল কারণ কী ছিল?

মুরাদ আনসারি: সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছিল না। আমার ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে পড়ার। দুর্ভাগ্যবশত সেটি সম্ভব হয়নি। যেহেতু মেডিকেল প্রস্তুতির জন্য গণিত কিছুটা এড়িয়ে যেতে হয়, অন্য কোনো বিষয়ের প্রস্তুতিও ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর জানলাম, আমি ক্রিমিনোলজিতে চান্স পেয়েছি। তবে এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ভর্তির পুরো কার্যক্রম সম্পন্ন হয়, এবং পরবর্তীতে জানতে পারি ক্রিমিনোলজিতে না আমি ক্লিনিকাল সাইকোলজিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি।

YSSE: Psycure প্রথমে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব হিসেবে শুরু হয়েছিল। এটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে কী আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল?

মুরাদ আনসারি: বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথম দিকে খুব একটা অনুপ্রেরণা পাচ্ছিলাম না। তবে কিছু বিষয় আমাকে ভাবিয়েছিল। আমি লক্ষ্য করলাম, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক মানুষ সংগ্রাম করছে। আমাদের দেশে প্রায় ৩১% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে, কিন্তু ৯২% মানুষই এ সেবার বাইরে রয়েছে । প্রতিবছর মানসিক স্বাস্থ্য থেকে স্নাতক হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ ,০০০-এর বেশি হলেও মাত্র ২% শিক্ষার্থী এই পেশায় যুক্ত হয়। শিক্ষার্থীদের সচেতন ও দক্ষ করে তোলার জন্যই মূলত Psycure শুরু হয়েছিল।

আমাদের সফলতার পেছনে প্রধান কারণ ছিল সঠিক জ্ঞান এবং পার্টনারশিপ অ্যাপ্রোচ। আমরা একা কাজ না করে সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়েছি।

YSSE: Psycure থেকে এখন পর্যন্ত ২৬,০০০-এর বেশি মানুষ উপকৃত হয়েছে। এই উদ্যোগ নিতে গিয়ে বড় কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?

মুরাদ আনসারি: মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় মান নিশ্চিত করা আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনো অনেক ট্যাবু আছে। ফলে মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এ ছাড়া, ১৬ কোটি জনসংখ্যার জন্য মাত্র ১,০০০ জন মেন্টাল হেলথ প্রফেশনাল রয়েছে, যার প্রায় ৯০% রাজধানীকেন্দ্রিক। অন্যান্য শহরে এই সংখ্যা অত্যন্ত কম। আমরা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি, রিসোর্স এবং অর্থায়নের ঘাটতিও বড় সমস্যা। অনেক কিছু আমরা প্রথমবারের মতো করছি, তাই প্রায়ই ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

YSSE: আপনার অনুপ্রেরণা কারা বা কী ছিল, এবং এদের প্রভাব আপনার কাজে কীভাবে পড়েছে?

মুরাদ আনসারি: আমার অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো একজন ব্যক্তির প্রভাব নেই। আমি বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে অনুপ্রেরণা নিই। আমি নিজেকে একজন অবজারভার লার্নার হিসেবে মনে করি। বিভিন্ন মানুষ এবং ঘটনাবলি আমাকে প্রভাবিত করে।

YSSE: আপনি একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ২০২৩ সালে ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড সম্মেলনে বক্তা হিসেবেও উপস্থিত ছিলেন। এই ধরনের বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মগুলো আপনার কাজে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?

মুরাদ আনসারি: বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে অংশগ্রহণ করা আমাদের কাজকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ দেয়। নিজেদের কাজ অন্যদের কাজের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ পাই। এর মাধ্যমে আমাদের প্রচেষ্টা বৈশ্বিক মানদণ্ডে কতটা কার্যকর, তা যাচাই করা যায়। পাশাপাশি, এই প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের কাজ প্রচারের পাশাপাশি গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেও ভূমিকা রাখে।

YSSE: আপনার কাজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি আপনার নেতৃত্ব ও ব্যক্তিগত বিকাশে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?

মুরাদ আনসারি: যারা নতুন ও অনাবিষ্কৃত সেক্টরে কাজ করে, তাদের প্রায়ই নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করতে হয়। যেখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত উদাহরণ নেই, সেখানে কাজ করা আরও কঠিন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের জন্য বড় একটি প্লাস পয়েন্ট। এটি নেতৃত্বের দক্ষতা বাড়াতে এবং কাজের সুযোগ তৈরি করতে সহায়তা করে।

YSSE: আপনার উদ্যোগের জন্য যদি একটি স্লোগান লিখতে বলা হয়, সেটি কী হবে?

মুরাদ আনসারি:

‘Online Counseling at Your Schedule’

YSSE: আপনি ‘মনো জগতের আধার আলো’ নামক একটি সাইকো-ফিকশন বইয়ের সম্পাদক। এই বইটি সম্পাদনা করার পেছনে কী অনুপ্রেরণা ছিল, এবং এটি কীভাবে যুবসমাজকে সাহায্য করতে পারে?

মুরাদ আনসারি: বইটির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা তখনকার, যখন আমি Psycure ক্লাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলাম। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপে পড়েও আমি এটি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। মূলত Psycure-এর কাজ এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে সহজভাবে তুলে ধরার জন্যই এই বইটি করা। এতে গল্পের মাধ্যমে মানসিক সমস্যাগুলো সহজভাবে উপস্থাপন করেছি, যা তরুণদের জন্য সহায়ক হবে।

YSSE: আপনার মতে, বাংলাদেশের যুবসমাজে সবচেয়ে বড় মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ কী, এবং কীভাবে তা কার্যকরভাবে সমাধান করা যেতে পারে?

মুরাদ আনসারি: বাংলাদেশের যুবসমাজে মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একাডেমিক পিয়ার প্রেশার, সম্পর্কজনিত জটিলতা এবং অর্থনৈতিক সংকট। এ চাপ থেকে উত্তরণের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক উপাদানের সমন্বয়ে মূল্যায়ন করা জরুরি। পরিবার ও বন্ধুদের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে সমস্যাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা সম্ভব। প্রফেশনাল কাউন্সেলিংও এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর।

সচেতনতার অভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ যুবদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির অপব্যবহার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের অভাব একটি বড় সমস্যা। এই সংকট মোকাবিলায় কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। পরিবারের সদস্য, বন্ধু এবং আশেপাশের মানুষ মেন্টাল হেলথ সচেতনতার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

YSSE: পরিশেষে, পাঠকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

মুরাদ আনসারি: সবার আগে নিজেদের যত্ন নিতে হবে। সেলফ কেয়ারকে অগ্রাধিকার দিন। মানসিক স্বাস্থ্য সবার অধিকার। তাই সমাজ থেকে ট্যাবু দূর করতে হবে এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। নিজের জন্য সময় বের করুন এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন।

এরকম আরও ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন

লেখক

ফারদিন বিন আবদুল্লাহ 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE