শুভঙ্কর দাশ শুভ—বাংলাদেশের পাপেট শিল্পের এক অনন্য কারিগর, যিনি দু’হাতের জাদুতে প্রাণ দেন চরিত্রে, ছড়িয়ে দেন আনন্দের রঙ। বাংলাদেশের সৃজনশীল মিডিয়ায় ২৫ বছরের এই পথচলায় পাপেট, ভিজ্যুয়াল মিডিয়া, টিভিসি আর টিভি শো পরিচালনার পাশাপাশি জনপ্রিয় শিশুতোষ অনুষ্ঠান সিসিমপুর-এর তার হাতের পুতুল “শিকু” কিংবা “এলমো” শিশুদের হাসি-আনন্দের সঙ্গী হয়ে উঠেছে । শুধু বিনোদন নয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও পাপেটকে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। মঞ্চ, থিয়েটার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পাপেটকে ব্যবহার করে কাজ করছেন জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক এনজিও ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। আজ শুনতে চলেছি শুভঙ্কর দাশ শুভর স্বপ্ন, চ্যালেঞ্জ আর জীবনের পথ চলতে যে উৎসাহ তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই গল্পগুলো।
YSSE: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছি। আপনার জন্ম, পড়াশোনা, বেড়ে উঠা, বর্তমানে কী কাজ করছেন ইত্যাদি।
শুভঙ্কর দাশ শুভ : আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ১৯৮৩ সালে পুরান ঢাকার জুরাইনে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিজ এলাকাতেই যথাক্রমে জুরাইন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশ্রাফ মাষ্টার উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে প্রি ডিগ্রী করে ইউনিভার্সিটি অফ ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (UODA) থেকে বি.এফ.এ (পেইন্টিং-এ মেজর) ডিগ্রি অর্জন করেছি।
পাপেট্রি, ভিজ্যুয়াল মিডিয়া, টিভিসি, টিভি শো এবং পরিচালনা সহ সৃজনশীল মিডিয়াতে আমার ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি একজন পাপেটিয়ার, আর্টিস্ট এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিশুদের টিভি অনুষ্ঠান – সিসিমপুর, সিসেমিস্ট্রিটের সহ-প্রযোজনায় জনপ্রিয় শিকু এবং এলমোর মতো চরিত্রে পাপেটিয়ার হিসেবে অভিনয় করেছি। আমি ২০২০ সাল থেকে গুফি পাপেটের প্রধান হিসেবে কাজ করছি। ২০১২ সালে ইনভেন্টর’স পাপেট প্রতিষ্ঠা করেছি এবং এর পাপেটিয়ার ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
মঞ্চ, থিয়েটার, পাপেট থিয়েটার এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে বিভিন্ন সেক্টরকে সচেতনতা, শিক্ষা এবং বিনোদনের মাধ্যমে পাপেটকে সৃজনশীল মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমার ২০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি বাংলাদেশের এডুকেশনাল পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রথম দিকের ছাত্রদের একজন ছিলাম এবং দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন জাতিসংঘ সংস্থা, স্কুল, শিক্ষাক্ষেত্র, সরকারী এবং আন্তর্জাতিক এনজিও-র সাথে নানা প্রকল্পে কাজ করছি।
বর্তমানে ইনভেন্টর’স পাপেটের প্রতিষ্ঠাতা, পাপেটিয়ার এবং পরিচালক হিসেবে কাজ করছি এছাড়াও গুফি পাপেটের প্রধান, পাপেট ক্যারেক্টার ডেভ্লপমেন্ট এবং শিশুদের জন্য অডিও – ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট তৈরি ও পরিচালনা করছি।
YSSE: আপনার শিশুদের এডুটেইনমেন্টের প্রতি আগ্রহ কীভাবে তৈরি হলো এবং এই যাত্রার শুরুটা কেমন ছিল?
শুভঙ্কর দাশ শুভ : ছোট থেকেই আমি বেশ স্বাধীন ভাবে বেড়ে উঠেছি, কোন বিষয় নিয়ে কোন প্রকার বাধা বা নিষেধ ছিলনা। ছোট বেলায় মুক্ত মনে আমার বিকাশ হয় আমার পরিবার থেকে, যার জন্য আমার একটা দায়িত্ব বোধ ও ভালোবাসা তৈরি হয় পরিবারের প্রতি। আমাকে নিয়ে বাবা মা বড় দা বড় দি অহেতুক চিন্তা করেনি। পরিবার বন্ধু, আত্মীয় স্বজন সহকর্মী সবার কাছে প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি যা এখনো অব্যাহত আছে, এটা আমার এক প্রকার শক্তি।
তাই আমি মনে করি প্রত্যেক শিশুর সমান অধিকার ও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা সমান, এখানে কোন শ্রেণী বৈষম্য নেই। তাদের প্রচুর ভালোবাসতে হবে তাদের জন্য উজার করে দিতে হবে, তার কি আছে কি নেই এটা পরের হিসেব। এ ভাবনা থেকেই শিশুদের জন্য এডুটেইনমেন্ট বিষয়ে কাজ করা শুরু ।
যেহেতু আমি চারুকলায় লেখাপড়া করেছি ও ছোট থেকেই আমার বড় দা আমার আদর্শিক জায়গায় ছিলো ওর নান্দনিক বোধ ওর ছবি আঁকা মাটি দিয়ে ভাস্কর্জ গড়া এবং আমি ওকে অনুকরণ করে বড় হয়েছি। ছোট বেলায় আমরা দুই ভাই বাড়ির পাশে মামা বাড়িতে একসাথে টেলিভিশন দেখতে যেতাম, আমাদের তখন টেলিভিশন ছিলনা।
বাংলাদেশের লিজেন্ডারি পাপেটিয়ার আর্টিস্ট মুস্তাফা মনোয়ার স্যারের “মনের কথা” পাপেট অনুষ্ঠান হতো বাংলাদেশ টেলিভিশনে ওটা আমি খুব মন দিয়ে দেখতাম ভালো লাগতো, পারুল বাউল বলদ ওরা আমার ড্রিম ক্যারেক্টার ছিলো। হলো কি মাধ্যমিক শেষে তিন মাসের একটা ফাঁকা সময় থাকে, আমার স্কুলের অন্য বন্ধুরা এক্সট্রা কারিকুলার শিখতে লেগে গেলো, এই সময় আমি বেড়িয়ে পরলাম ঢাকা শহর ঘুরে দেখতে। শহরে ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে ধানমন্ডির এক নম্বর রোডে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মুস্তাফা মনোয়ার স্যারকে দেখি উনি হেঁটে হেঁটে কোথাও জাচ্ছেন। ওনার পিছু নিলাম, গিয়ে আবিস্কার করলাম ওনার এডুকেশনাল পাপেট ডেভ্লপমেন্ট সেন্টার (EPDC) এর পুর্নাঙ্গ পাপেট স্টুডিও। আমারতো দেখেই ঘোর লেগে গেলো।
ছোট ছিলাম স্যারকে চেপে ধরলাম আমি পাপেট করবো, স্যার বললো তুমিতো অনেক ছোট আমার লাগবে গ্রাজুয়েশনে পড়া মানুষ। আমিও নাছোর বান্দা, পরে EPDC তে আমার যারা মেন্টর ছিলো মির্জা শাহরিয়ার আলম, কামাল আহসান বিপুল, আর্থার ব্যাপটিস্ট মুক্ত ওনারাই আমার জন্য স্যারকে রিকোয়েস্ট করেন। বলেন আমরা ওকে ভর্তি করে নেই ও হবে আমাদের সর্ব কনিস্ট পাপেটিয়ার। ১৯৯৮ সালে এভাবেই পাপেট্রিতে আমার পথ চলা শুরু হয়। পরে ওনাদের সাথে একসাথে ঢাকা পাপেট থিয়েটার গঠন করি ২০০২ সালে। তবে আমি প্রথমে কোন পরিকল্পনা করে পাপেটিয়ার হইনি অনেক পরে এসে আমি ডিটারমাইন্ড হই আমি পাপেটিয়ার হবো।
YSSE: ২০০৪ সালে ‘সিসিমপুর’-এ কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
শুভঙ্কর দাশ শুভ : আমি ঢাকা পাপেট থিয়েটার থেকে ২০০৪ সালে সরাসরি সিসিমপুরে এপ্লাই করি, ওই সময় প্রায় নয় শত ক্যান্ডিডেট সিসিমপুরে পাপেটিয়ার হিসেবে এপ্লাই করে। সিসেমিস্ট্রিটের আরেক লিজেন্ডারি পাপেটিয়ার মার্টিন প্যাট্রিক রবিনসনের তত্ত্বাবধানে নয় দিনের অডিশন শেষে আমরা নয় জন চূড়ান্ত ভাবে পাপেটিয়ার হিসেবে নির্বাচিত হই, সিসিমপুরের চার জন এম্বাসেডর ক্যারেক্টারের জন্য। এর মধ্যে আমি শিকু পারফর্ম করার জন্য সিলেক্টেড হই বাকিরা অন্যান্য ও র্যাংলার হিসেবে।
মজার ব্যাপার হলো হালুম টুকটুকি শিকু ইকড়ি এই চারটা ক্যারেক্টারের সব গুলই সবাই পারফর্ম করার জন্য অডিশন দেয়। আমি প্রথমে বুঝতে পারি এখানে দুইটা ক্যারেকটার মেয়ে আর দুইটা ক্যারেকটার ছেলে এবং আমি টানা নয় দিনই শুধু মাত্র শিকুর জন্য অডিশন দেই। অন্য কোন ক্যারেক্টার ট্রাই করিনি এই ডিটার্মিনেশন আমাকে অন্যদের থেকে একটু এগিয়ে রাখে।
ফাইনালি আমি যখন শিকুর জন্য সিলেক্ট হই এবং ভোকাল ও প্লে প্র্যাক্টিস শুরু করি আমি তখনও একটু এগিয়ে থাকি কারন আমাদের টিমে নয় জনের মধ্যে আমি একমাত্র যার পুর্বে পাপেট করার অভিজ্ঞতা আছে। এরপর শুরু হল টানা তিন মাসের রিহার্সেল স্ক্রিপ্ট, প্লে, ভোকাল টেকনিক্যাল সব কিছুর। আমরা যখন FDC তে শুটিং শুরু করলাম আমি একদম থ হয়ে গিয়েছিলাম প্রথম দিন, এত বিশাল আয়োজন সেট, লাইট, ক্যামেরা, সাউন্ড, ডিরেকশন এর আগে এত বড় ক্যানভাসে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার ছিলনা।
আমি সেই সময় নার্ভাস থাকতাম, আমার সহকর্মী থেকে সহ শিল্পিরা এটা ওভারকাম করতে সহযোগিতা করেছে আমাকে, আমরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে দলগত ভাবে কাজ করেছি আমরা সবাই তখন নতুন ছিলাম যার চর্চা এখনো আমরা করি দলগত হয়ে কাজ করা। এই নার্ভাসনেস কাটতে আমার সপ্তাহ খানেক সময় লেগেছিল, আর টানা পাঁচ মাসের শুটিং নিমিষেই শেষ হয়ে গিয়েছিল টেরই পাইনি।
YSSE: ২০১২ সালে Inventor’s Puppet প্রতিষ্ঠার পেছনের মূল অনুপ্রেরণা কী ছিল? শিশুদের শেখানোর ক্ষেত্রে পাপেট্রির ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
শুভঙ্কর দাশ শুভ : এর আগে বেশ কিছু পাপেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে ও কয়েকটা পাপেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য থাকার কারণে বেশ কিছু বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি। চিন্তার যায়গা ও কাজ করার স্বাধীনতায় আমি ঠিক নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না।
এর ফলে ২০১২ সালে, ইনভেন্টরস পাপেট একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন কিছু বিষয় নিয়ে পাপেট্রি করা যাতে শিশুরা সহ সবাই হাসতে পারে এবং শিখতে চায়। ইনভেন্টর’স এর লক্ষ্য কেবল বিনোদন দেওয়া নয় বরং শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের পাপেটের মাধ্যমে মানব সভ্যতার ইতিহাস এবং অর্জন সম্পর্কে আরও জানানো, শিক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত করা। আমরা তরুণ এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ে শেখার, সৃজনশীলতা এবং অন্বেষণের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলার দিকে লক্ষ্য রাখি।
আমাদের একটি স্লোগান আছে “বিকশিত শিশু আলোকিত পৃথিবী”। ইনভেন্টর’স পাপেট এমন একটি সংস্থা যা পরিবেশ, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সাথে কাজ করার জন্য পাপেট্রি ব্যবহার করে। এর লক্ষ্য হল বাংলাদেশের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বিষয়গুলিকে শিশু ও মানুষের সাথে যোগাযোগ করানো, প্রযুক্তিগত, সামাজিক এবং নান্দনিক দিকগুলিতে মনোনিবেশ করানো।
ইনভেন্টর’স পাপেট “একটি ছবি হাজার শব্দের চেয়েও বেশি কিছু বলে” এই দর্শনের উপর ভিত্তি করে তৈরি। আমরা আমাদের সকল প্রকল্পে এই নীতি প্রয়োগ করি, বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কিত কাজ থেকে শুরু করে আমাদের নিয়মিত ইভেন্টগুলিতেও।
এরই ধারাবিহিকতায় ২০১২ সালে আমাদের বন্ধু ও পাপেটিয়ার লিটু সোলায়মান যে বৈশাখী টেলিভিশনে প্রডিউসার হিসেবে আছেন ওর অনুপ্রেরণায় যৌথ ভাবে টেলিভিশনের জন্য পাপেট ড্রামা সিরিজ তৈরি করি। যা পর পর “রংধনু ফুল” “ছুটির আনন্দ” ও “গল্পের দেশে” নামে তিন সিজন প্রচারিত হয়। এর সবই আসলে শিশুর শিক্ষা ক্ষেত্রে কাজে লাগে
সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে আমাদের অতিথির বাকি গল্প উঠে আসবে। আরও কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে জানতে পারবেন তার অভিজ্ঞতা, কাজের পরিধি এবং জীবনের নানা দিক।
ধন্যবাদ সবাইকে সাথে থাকার জন্য!
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
আনিকা শারমিলা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE