একদিন বিকেলে শহরের রাস্তায় হাঁটছিলাম, সূর্যটা তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে আর আমার গা ঘেঁষে হাঁটছে দীর্ঘ এক ছায়া । আমার থেমে যাওয়ার সাথে সাথে, ছায়াটাও থেমে গেল। আবার চলা শুরু করলাম, সে-ও চলল। হুট করে মাথায় ভাবনা আসলো, এই ছায়া তো আমারই প্রতিচ্ছবি, কিন্তু কতোটা আমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করি, আর কতটা সে আমার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে?!

আমরা ছায়াকে জীবনের অংশ হিসেবেই আসলে গণ্য করি। কিন্তু ছায়া শুধু আলো আটকানোর ফল না, এটা মানুষের অনুভূতি, কল্পনা আর মনস্তত্ত্বের এক অদ্ভুত খেলা। ছায়া আমাদের ভয় দেখায় আবার ছায়া আমাদের সঙ্গীও হয়। কখনো ঘুমের ভেতরে, কখনো নির্জন রাস্তায় আবার কখনো শিশুর কৌতূহলে সে ঢুকে পড়ে। এমনও হয়, ছায়া না থাকলে জীবনটাই যেন কিছুটা অপূর্ণ থেকে যায়। নির্জনতাকে ছায়া যেভাবে রাঙিয়ে তোলে, অন্য কিছু তা পারে না। ছায়া আমাদের বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে এক ধূসর সেতু তৈরি করে দেয়।

ছায়া: এক দর্শন ও বিজ্ঞান

প্রথমেই আসি ছায়ার বিজ্ঞানে। আলো যখন কোনো বস্তুতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন তার পেছনে একটি অন্ধকার অংশ তৈরি হয়, যেটাকে আমরা ছায়া বলি। যতই সহজ মনে হোক, কিন্তু ছায়ার আচরণ অনেক সময় জটিল হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মানুষের চোখ এবং মস্তিষ্ক ছায়া দেখে নানা রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করায় অবচেতনভাবেই।

বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের মস্তিষ্কে ছায়া দেখার পরে তার অর্থ তৈরির প্রবণতা থাকে। আমরা শুধু আলো-অন্ধকারের পার্থক্য দেখি না, কল্পনাতেই সেই ছায়াকে আমরা নানারকম রূপ দিতে থাকি- কখনো মানুষ, কখনো পশু আবার কখনো কিছু অশরীরীও!

এই ব্যাখ্যা তৈরি করাটাই আমাদের কল্পশক্তির শক্তি, আবার কখনো এই ব্যাখ্যাই জন্ম দেয় গভীর ভয়ের।একেকটি ছায়া আমাদের চিন্তার জগতে নতুন দরজা খুলে দেয়।

ছায়ার মানসিক রূপ

ছোটবেলায় রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় দেয়ালে টাঙ্গানো জামার ছায়া দেখে ভয়ে গুটিয়ে গেছি আমরা অনেকেই। বড় হয়েও মাঝে মাঝে এই অনুভূতি যায় না। কারণ মানুষের মস্তিষ্ক ছায়াকে সহজে মেনে নিতে চায় না, বিশেষ করে যখন সেই ছায়া স্পষ্ট না হয়।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মস্তিষ্কের মধ্যে প্যারেডোলিয়ানামে একটি প্রবণতা আছে—যেখানে আমরা এলোমেলো আকৃতি থেকেও পরিচিত মুখ বা রূপ খুঁজে নিতে চাই। ছায়া এই প্রবণতাকে সক্রিয় করে তোলে। ফলে অচেনা ছায়াও হয়ে ওঠে চেনা ভয়।

এই ভয় অনেক সময় শারীরিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে – হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, হাত ঘামতে শুরু করে।মনে হয়, আমরা যেন কোনো অজানা কিছু দ্বারা পর্যবেক্ষিত হচ্ছি।

ছায়া ও স্বপ্ন

ছায়া শুধু বাস্তবে না, আমাদের স্বপ্নেও প্রবেশ করে। অনেকেই বলে থাকেন, তারা স্বপ্নে অন্ধকার কোনো অবয়ব দেখতে পান, যারা কথা বলেন না, শুধু চেয়ে থাকেন। এগুলোকে শ্যাডো ফিগারবা ছায়ামানব বলা হয়। আবার অনেক দর্শনচিন্তায় বলা হয়, মানুষের মনের অন্ধকার দিকগুলোও একেকটি ছায়ার রূপ নেয়।

সিগমান্ড ফ্রয়েড বা কার্ল ইয়ুং-এর মতো মনোবিশ্লেষকরা বলেছেন, আমাদের অবচেতন মনে যে অনুভূতি, অভিজ্ঞতা বা ভয় লুকিয়ে থাকে,তা ছায়া হিসেবে প্রকাশ পায়। মানে, ছায়া হলো একপ্রকার মানসিক প্রতিবিম্ব, যা আমাদের নিজেরই এক গোপন রূপ।এই ছায়ার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া মানে নিজের ভিতরের ভীতিকর বা গোপন সত্যের মুখোমুখি হওয়া।আর সেই সত্যকে আলিঙ্গন করলেই আসে মানসিক পরিপক্বতা।

ছায়া কি শুধুই ভয়?

না, ছায়া সবসময় ভয় নয়। ছায়া আমাদের শান্তিও দেয়। গরম দুপুরে গাছের ছায়ায় বসে সময় কাটানো, প্রিয়জনের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা দিনের শেষে নিজের ছায়া অনুসরণ করে বাড়ি ফেরা-এ সব কিছুতেই রয়েছে গভীর আবেগ। আবার ছায়া শিল্প ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় ছায়া এসেছে রহস্যময় প্রেমিকা হয়ে, আবার হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ছায়া এসেছে একাকীত্বের প্রতীক হয়ে। নাটক, সিনেমা, এমনকি মঞ্চনাট্যেও ছায়া কখনো রহস্য, কখনো প্রতীক, আবার কখনো নীরব প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।শিল্পীরা ছায়াকে ব্যবহার করেন কথা না বলে ,কথা বলার এক উপায় হিসেবে।

ছায়া নিছক এক বৈজ্ঞানিক প্রতিফলন নয়, ছায়া আমাদের মানসিক জগতের অংশ। আমাদের মস্তিষ্ক কখনো তাকে ভয় পায়, কখনো তাকে বন্ধু ভাবে, কখনো বা সে হয়ে ওঠে আত্মজ উপলব্ধির দরজা। মানুষের মন ঠিক যেমন আলো-আঁধারির খেলা, ছায়াও তেমনি আমাদের আত্মার এক রহস্যময় প্রতিবিম্ব। হয়তো একদিন, যখন আমরা নিজের ভেতরের ছায়াগুলোকেও চিনে ফেলতে পারবো, তখন ছায়ার এই লুকোচুরিও থেমে যাবে।

এ ধরনের আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন। 

লেখক, 

ফাতেমী সুষম

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE