ভৌতিক গল্প কিংবা সিনেমাপ্রিয় দর্শকদের এক বড় অংশের কাছে একটি প্রিয় চরিত্র হলো “ভ্যাম্পায়ার”। ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব আছে কি না সেই প্রশ্ন কম বেশি আমাদের সকলের মনেই এসেছে, অনেকে হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে অনলাইনে বেশ ঘাটাঘাটিও করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগই যে উত্তরটি পেয়েছেন তা হলো, “ভ্যাম্পায়ার বলতে বাস্তব জগতে কিছু নেই।” তবে যদি বলি ঠিক পৌরাণিক কাহিনীর ভ্যাম্পায়ার নয় কিন্তু সাধারণ মানুষের চেহারা নিয়েই ভ্যাম্পায়ারের মতো কিছু বৈশিষ্ট্যের মানুষ বিচরণ করছে এই পৃথিবীতে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই বিষয়টি Clinical Vampirism এ আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে অনেকাংশে সত্য।

Clinical vampirism হলো এক ধরনের ভয়াবহ মানসিক অসুস্থতা, যা সাধারণত Renfield’s syndrome নামে পরিচিত। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রক্তপানে আসক্তি। ১৯৬৪ সালে রিচার্ড এল.ভ্যান্ডেন বার্গ এবং জন এফ.কেলির দুইটি দৃষ্টান্তের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রথমবারের মতো Clinical vampirism নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো। ১৮৯২ সাল হতে ২০১০ সাল পর্যন্ত, মানসিক সাহিত্যে ৫০,০০০টিরও বেশি রক্ত পানকারীদের বিবরণ পাওয়া যায়। রিচার্ড ভন ক্রাফট-ইবিং, একজন অস্ট্রিয়ান ফরেনসিক সাইক্রিয়াটিস্ট, তার কাজে Clinical vampirism এর প্রমাণ দিয়েছেন। ফরেনসিক সাইক্রিয়াটির সাহিত্যে, এই রোগটি সম্পর্কে অসংখ্য মেডিকেল পেপার রয়েছে। মেডিকেল পেপারে রোগটি মারাত্মক হিংস্র অপরাধ সংঘটনের একটি অন্যতম উপাদান হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে।

রেনফিল্ড সিনড্রোম” নামকরণ 

ব্রাম স্টোকারের ১৮৯৭ সালের উপন্যাস ‘ড্রাকুলা’ তে ড্রাকুলা মানব ও জুফ্যাগাস রোগী আর.এম.রেনফিল্ডের নামানুসারে বিকল্প শব্দ “রেনফিল্ড সিনড্রোম” নামকরণ করা হয়েছে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট রিচার্ড নোল তার লেখা একটি বইয়ে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৯৯২ সালে নোলের বই প্রকাশের পর থেকে Clinical vampirism কে রেনফিল্ড সিনড্রোম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

Clinical vampirism এ আক্রান্ত রোগীর বৈশিষ্ট্য

পুরোনো মনস্তাত্ত্বিক সাহিত্যের Case history report অনুযায়ী, এই অবস্থাটি শৈশবের একটি মূল ঘটনা দিয়ে শুরু হয় যা আঘাতের ফলে রক্তপাত এবং রক্তপানের অভিজ্ঞতাকে উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলে। বয়ঃসন্ধির পর এই উত্তেজনা যৌন উত্তেজনার সাথে সম্পৃক্ত হয়। রক্তপানের মাধ্যমে তাদের দেহে এক ধরনের শক্তি তৈরি হয় এবং তারা তাদের উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে বলে বিশ্বাস করে অথচ রক্তপানের মাধ্যমে একজন মানুষের দেহে নানারকম ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। নোল লক্ষ্য করেন যে রেনফিল্ড সিনড্রোম সাধারণত তিনটি পর্যায়ে অগ্রসর হয়। 

১ম পর্যায়ঃ এ পর্যায়কে ‘Autovampirism’  বা ‘Autohemophagia’বলা হয়। এ পর্যায়ে রোগীরা নিজেদের অঙ্গ বিভিন্ন উপায়ে আঘাত করে বা কেটে রক্তগ্রহণ করে। 

২য় পর্যায়ঃপর্যায়কে ‘Zoophagia’ বলা হয়। এ পর্যায়ে রোগীরা জীবন্ত প্রাণী ভক্ষণ কিংবা তাদের রক্ত পান করে। এই পর্যায়ে অনেকেই রক্ত পানের জন্য কসাইখানা থেকেও রক্ত সংগ্রহ করে।

৩য় পর্যায়ঃ এ পর্যায়ে আসার পর রোগীর লক্ষ্য মানুষের রক্ত গ্রহণের দিকে ধাবিত হয়। রোগী হাসপাতাল বা ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত চুরি করে অথবা জীবিত ব্যক্তির রক্তপান করে। এই পর্যায়ে আসার পর “রেনফিল্ড সিনড্রোম” এ আক্রান্ত কিছু লোক হত্যার মতো সহিংস অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

রোগে সাধারণত পুরুষরা আক্রান্ত হয়ে থাকেন। নারীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য কম পাওয়া যায়। বিরল এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা প্রায় সময়ই রক্তপানের উত্তেজনা অনুভব করে এবং এদের মধ্যে কিছু রোগী ‘নেক্রোফিলিয়া’ স্বভাবের হয়ে থাকে অর্থাৎ মৃতদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে এবং শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে উদ্ধুদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে প্রায়ই এক ধরনের অনিশ্চিত পরিচয় গড়ে উঠে এবং নিজেদের চেহারা ভুলে যায়। যাদের মধ্যে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তাদেরকে ‘Vampirist’ বলা হয়। ইতিহাসে এমন অনেক vampirist এর পরিচয় পাওয়া যায় যারা কুখ্যাত Serial killer ছিলো।

এদের মধ্যে ২ জন Vampirist এর জীবনী খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।

Haigh (The acid bath murderer)

হাই, ১৯০৯ সালের ২৪ শে জুলাই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন। তিনি ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র সন্তান। তার জন্ম, বিকাশ ও স্বাস্থ্য স্বাভাবিক ছিলো এবং মানসিক ব্যাধির কোনো পারিবারিক ইতিহাস ছিলো না। শৈশব হতেই তিনি বেশ ভালো চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং বেশ ভালো পিয়ানো বাজাতেন। শিশু এবং প্রাণীদের প্রতিও তার ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু সে ছোট থেকেই ধীরে ধীরে ভ্যাম্পায়ারিজমের দিকে ধাবিত হচ্ছিলেনছয় বছর বয়স থেকে তিনি নিজের হাতে আঁচড় কেঁটে তা থেকে রক্ত চুষতেন। তিনি প্রায়ই রেল দূর্ঘটনায় আহত লোকদের রক্তপাত হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।

এরপর, পঁচিশ বছর বয়সে তিনি তার কর্ম সংস্থায় প্রতারণা করায় কারাগারে বন্দী হন এবং তার সাংসারিক জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৪৪ সালে, পয়ত্রিশ বছর বয়সে, একটি দূর্ঘটনায় তার মাথার ক্ষত থেকে রক্ত তার মুখে প্রবেশ করে যা পুনরায় তার রক্তপানের পিপাসাকে জাগিয়ে তোলে। সেই বছর তিনি দুইজনকে, ১৯৪৫ সালে তিনজনকে, ১৯৪৮ সালে তিনজন এবং ১৯৪৯ সালে তিনি তার শেষ হত্যা করেন এবং এ বছরের ১০ই আগস্ট, তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। তার ভাষ্যমতে, তিনি নয়জনকে হত্যা করেছিলেন, যার মধ্যে ছয়জন তার বন্ধু ছিলেন। তিনি হত্যাকৃত ব্যক্তিদের ঘাড় কেঁটে তা থেকে এক কাপ রক্ত নিয়ে পান করতেন। তিনি প্রতিটি হত্যাকান্ডের আগে যে স্বপ্নটি দেখতেন তা হলো, একটি ক্রুশবিদ্ধ গাছ হতে রক্ত ঝরে পড়ছে এবং তিনি সেই রক্ত পান করতেন যা পুনরায় তার রক্তের পিপাসাকে জাগিয়ে তুলতো। তিনি প্রতিটি দেহকে সালফিউরিক এসিডের গ্যালনে ডুবিয়ে নিঃশেষ করে দিতেন যার প্রমাণ হিসেবে তদন্তকালীন সময়ে প্রতিটি হত্যাকারী ব্যক্তির বাড়ির পিছনের মাটি থেকে হিউম্যান বডির ফ্যাটি এসিড এবং এক খন্ড পায়ের অংশ পাওয়া যায়। তার সমস্ত খুনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো রক্তের প্রতি অপ্রতিরোধ্য তাগিদ।

Richard Chase (Vampire of Sacramento)

রিচার্ড ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার ৫ বছর বয়সেই Macdonal triad এর তিনটি অংশ প্রদর্শন করে যা ভয়াবহ Psychopath হওয়ার সম্ভাবনা তুলে ধরে। Chase প্রায়ই অভিযোগ করতো যে তার হার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা কেউ তার পালমোনারি ধমনী চুরি করে নিয়ে যাবে। Chase তার মাথার উপর কমলা ধরে রাখতো যাতে তার ব্রেইনে ভিটামিন সি পৌঁছায়। Chase মনে করতো তার মা তাকে খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলবে, তাই সে ঘর থেকে পালিয়ে যায়। Chase তার কর্মক্ষেত্রে এবং তার আবাসস্থলে এক পর্যায়ে নগ্নাবস্থায় চলাফেরা শুরু করলে তার বন্ধুরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে সে মদ, মারিজুয়ানা ও LSD গ্রহণ করতো। মাদকের নেশা থেকে মুক্ত করার পর এক পর্যায়ে অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকাকালীন সে বিভিন্ন জীবিত প্রাণীকে কাঁচা খাওয়া শুরু করে এবং মাঝে মাঝে কোকাকোলার সাথে ব্লেন্ড করে খেতে থাকে। 

ধীরে ধীরে সে মানুষ হত্যা শুরু করে এবং মৃতদেহের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয় এবং সেই দেহ থেকে রক্তপানসহ বিভিন্ন অংশ কেঁটে খাওয়া শুরু করে। Chase ৩ মাসের এক গর্ভবতীকে ৩ বার গুলি করে হত্যা করার পর তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, নিতম্ব কেঁটে ফেলে তা থেকে রক্তপান করে এবং বের হয়ে যাওয়ার আগে নারীটির মুখে কুকুরের মল রেখে যায়। জানা যায় যে Chase কারাগারে থাকাবস্থায় জানালায় এসে বসা পাখির ঘাড় ভেঙে রক্ত পান করতো ভয়াবহ এই মানসিক রোগী ধরা পড়ার পর অনুসন্ধানকারী দল তার বাসন-কোসন ও ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্র রক্তমিশ্রিত অবস্থায় পান।

Chase এর ধারণা ছিলো, সে রক্তপান না করতে পারলে তার হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাবে এবং সে মারা যাবে। তাই নিজেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই সে এই হত্যাগুলো করে যা কিনা যেকোনো সাধারণ মানুষই করে থাকবে (Chase এর ভাষ্যমতে)।

১৯৭৮ সালে Chase কারাগারে আত্মহত্যা করে।

এরকমই বিভৎস আরো অনেক Vampirist এর খোঁজ মিলেছে সময়ের পরিক্রমায়, তবে এ রোগের কোনো উপযুক্ত চিকিৎসা খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি এখনো। অনেকে Vampirsm কে Schizophrenia  বা paraphilia এর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু Clinical vampirism এ আক্রান্ত রোগী আরো বেশি ভয়াবহতা প্রদর্শন করে। তবে আফসোস এই যে, এই রোগের চিকিৎসা না থাকায় এই রোগীগুলো সমাজে বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসাথে, সমাজে সৃষ্ট ভ্যাম্পায়ার কালচার বিকৃত মস্তিষ্কের মানসিক রোগীদের আরো বিকৃত করে তুলছে যা সাধারণ মানুষের জন্য অনেক বেশি উদ্বেগজনক। 

Writer 

Dide Islam 

Intern, Content Writing Department,

YSSE

“আমাদের আরও ব্লগ পড়তে এখানে #ক্লিক করুন।