ছন্দের জাদুকর, রূপসী বাংলার কবি, নির্জনতম কবি এমন বহু নাম ও উপাখ্যানেও মুহূর্তের মধ্যে যাকে শনাক্ত করে ফেলা সম্ভব, বাংলা সাহিত্যের এক অমর মহামানব- জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দ-যার লেখনিতে ছড়িয়ে আছে নব কুঁড়ির সুবাস, যার কাব্যিক ছন্দে অন্ধকার রাত্রি তে জোছনারা উন্মত্ততা ও নতুনের আশায় আলো বিলি করে, যার কল্পনার রাজ্যে প্রেয়সীর রূপ-লাবণ্যের মিশেল ঘটে সবুজ লতা-গুল্মের সাথে।
তিনি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের এমন একাকী নক্ষত্র, যিনি নিঃসঙ্গতার ও নির্জনতার রঙকে নিজের কবিতার ক্যানভাসে পাঠকের জন্য অঙ্কিত করেছেন। যাতে পাঠক হৃদয় উপলব্ধি করতে পারে, এই নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের মাধ্যেই লুকায়িত আছে এক অপূর্ব শান্তি ।
আলো আর অন্ধকারের মিলনে তিনি গেঁথেছেন এমন এক সুর, যা জানান দেয় যে অস্তমিত সূর্যের অর্থ কেবল অন্তিমতা নয়; এটি হলো পুনরায় জেগে ওঠার, নতুন উষার প্রদীপে ফিরে আসার এক নব অভিলাষ।
১.নিঃসঙ্গতার প্রতিধ্বনি : এক চিরচেনা সুর
জীবনানন্দ আমাদের কাছে পরিচিত তাঁর প্রকৃতির অপূর্ব বিবরণ এর জন্য, প্রেয়সীর সাথে তার খুনসুটি আর আবেগে শিক্ত ভালেবাসার জন্য। তবে, তাঁর কাব্যের একটি বিষেষ এবং নিগূঢ় চিত্র হলো একাকিত্ব।
যেমন তিনি লিখেছেন,
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সমুদ্রের পর সমুদ্র পেরিয়ে।” (বনলতা সেন)
কবিতার এ চরণ দুটি যেন মানুষের অনন্ত যাত্রার যে নিঃসঙ্গতা, তাকেই ফুটিয়ে তোলে। জনসমাগমের মধ্যেও যেন কবির মনে জেগে ওঠে একাকিত্বের পরিচিত এক সুর। কিন্তু কবির এই অনুভূতিকে মোটেও নেতিবাচক বলা যায় না। বরং এর মাধ্যমেই তার দৃষ্টি খো্ঁজ পায় নাটোরের সেই বনলতা সেনের, যার চোখ দুটো যেন কত যুগ আগেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। কবি সেখানে সন্ধান পান নতুন ভালোবাসার অবয়ব এর।
২. নীরব আলাপনে কবি ও প্রকৃতি :
“আবার আসিবো ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়,
হয়তো মানুষ নয়, হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে।”
রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের এই কালজয়ী কবিতার চরণই কবির জীবনে প্রকৃতির ভালোবাসার পরিমাপক হওয়ার সক্ষমতা রাখে। জীবনানন্দ প্রাকৃতিক রং,,নদীর ক্ষীপ্র স্রোত, কিশোরীর মিষ্টি হাসি,ধানক্ষেতে বয়ে যাওয়া বাতাসের শান্ত সুর – সবকিছুকে নিজের কবিতার ভুবনে মিশিয়ে দিয়ে পাঠকের হৃদয়কে এক করে দিয়েছেন প্রকৃতির মাধুর্যতা আর ভালোবাসায়।
শব্দের আর ছন্দের ক্যানভাসে কবি, জীবনের নীরব – শান্ত আলোর খেলা, একাকিত্বের গাঢ় রং আর প্রকৃতির ছোঁয়া, এই সব কিছুকে মিশিয়ে দেন। আর তার পরিণামে জীবনানন্দের কবিতা হয়ে ওঠে এক অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা। পাঠকের মনকে তার লেখনী কেবল স্পর্শই করে না, বরং তাদের চিন্তার বিভিন্ন দরজা খুলে দেয়। অনুভব করায় যে নিঃসঙ্গতার মধ্যেও আলোর উপস্থিতি বিদ্যমান, সন্ধান লাভে প্রয়োজন শুধু মাথা তুলে দেখার।
৩. রঙিন অন্ধকারের বিরল দৃষ্টান্ত
কবি যখন তার ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি‘ গ্রন্থে বলেন,
“আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার।” -কবিতা(মৃত্যুর আগে)
এর মাধ্যমে তিনি তার পাঠকদের আশ্বস্ত করেন যে, ধানের গুচ্ছের মতোই সবুজে সতেজ ভোর প্রতিদিনেরই চিরন্তন সত্যচিত্র। তা এই প্রকৃতিকে আলোকিত করতে আসবেই । তবে, অন্ধকারাচ্ছন্ন দীর্ঘ শীতের রাতগুলিও একই মহত্ত্ব বহন করে, একই রূপকতার জানান দেয়।
এর সাথে সাথেই কিন্তু কবি প্রকাশ করতে চান যে প্রকৃতির প্রতিটি দৃষ্টান্তই আমাদের এক কঠিন বাস্তবতার দুয়ারে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যায়।তাই এই কবিতারই শেষে যখন তিনি জানান-
“কি বুঝিতে চাই আর? রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!”
সেই মুহুর্তে কবি পাঠক কে বোঝাতে চান যে জীবনের অন্তিমতার আঁধারে প্রকৃতির রঙিন রূপে কখনো বিবর্ণতা আসে না, তা শাশ্বত মহিমায় আলোকিত থাকে অনন্তকাল ধরে। এমনকি, যখন সেখানে কবির নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে যায়, সেই বিদারক ক্ষণেও।
এ যেন কবির দৃষ্টিতে এক রঙিন অন্ধকার, যেখানে ক্ষুদ্র মানবজীবনের পরিসমাপ্তি কোনো দাগ কাটতে পারে না এই বৃহৎ পৃথিবীর উন্মুক্ত খাতায়।
৪.কল্পনার আকাশে জীবনানন্দ, সীমাহীন মুক্তি যেখানে বাস্তবতা
জীবনানন্দ দাশের কবিতার রাজ্যে কল্পনার আকাশের বিশালতা অনেক। তার এই আকাশের রঙে মিশে আছে তার স্বপ্ন, একাকিত্ব, বেদনা আর আশার আলো। এখানে যেমন আছে চাঁদের স্নিগ্ধতার সাথে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ শান্তি, তেমনি আছে মৃত্যুর তীব্র অন্ধকারের মাঝেও পুনরায় ফিরে আসার অভিব্যক্তি।
কবি প্রকৃতির সাথে ভালোবাসায়, নীলাঞ্জনার ফিরে আসার আবদারে, বনলতা সেনের সেই চোখের মায়ায়, জীবনের বসন্তের কল্যাণে, সূর্যালোকিত সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শোনেন। তার কাব্যের আকাশে শঙ্খচিল হয়ে উড়ে বেড়ান অনন্তকাল জুড়ে।
তাইতো কবির আকাশই যেনো তাঁর নিঃসঙ্গতার এক বৃহৎ ক্যানভাস, যাকে তিনি ভালোবাসার আলোর রঙে আর নিঃসঙ্গতার তুলির ছোয়ায় রাঙিয়ে তোলেন।
জীবনানন্দ দাশ, যিনি শুধু বাংলা কাব্যের পাতায় বেঁচে নেই, বরং তিনি অমর হয়ে আছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের সিন্দুকে। তার কবিতায় নিঃসঙ্গতা মানে শুধু শূন্যতা নয়, প্রকৃতপক্ষে, এটি হলো জীবনের এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি। আর সেখানে আলো কেবল আশার প্রতীক হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রকৃতির অমর সঙ্গীত। কবির ভুবনে অন্ধকার যতই গভীর হোক না কেনো, অবশেষে আলোর আগমনঘটবেই। সেখানে একাকিত্ব যতই তীব্র হোক না কেন, তার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সুর।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখিকা,
ফেরদৌস জাহান
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE