বিশ্বে ক্রিকেট জগতে কতো নক্ষত্রের আগমন হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যৎ আরো হবে। কিন্তু দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা, কঠোর পরিশ্রম আর লড়াকু মনন এসব গুন কয়জন ক্রিকেটারের মধ্যেই বা আছে ? তবে কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমিক জানে আমাদের বঙ্গভূমি তে আছে এমন একজন।
বাংলাদেশের সেরা প্রজন্মের সেরা তারকাদের একজন রঙিন কিংবা সাদা পোশাকে আবির্ভূত আনন্দ আর বিষাদের সাক্ষী মুশফিকুর রহিম। মি. ডিপেন্ডেবল কিংবা মি. ইমোশনাল সবই ৫ ফুট ২ ইঞ্চির বাজপাখি কিপার ব্যাটসম্যান। তবে ছোট গড়নের মানুষটার অর্জন আকাশ ছোয়া নক্ষত্রের মতো উজ্বল।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র বগুড়ায় ১৯৮৭ সালের ৯ মে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা মাহবুব হামিদ তারা এবং মা রহিমা খাতুন। মুশফিকুর রহিমের ডাকনাম “মিতু”। তিনি বগুড়া জিলা স্কুলে মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ করেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ২০১২ সালে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে তিনি জান্নাতুল কিফায়াত কে বিয়ে করেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুশফিকের অভিষেক :
মুশফিকুর রহিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় টেস্ট ম্যাচের মধ্য দিয়ে। ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ড এর মাটিতে ৪১ নং ক্যাপ দিয়ে তার অভিষেক হয়। যদিও শুরুর দিকে তাকে কেবল উইকেট-কিপার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল, গা গরমের ম্যাচগুলোতে তার ক্রীড়া প্রদর্শন নির্বাচকদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ফলশ্রুতিতে লর্ডসে অনুষ্ঠিত সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে তিনি স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে ঐ দলে জায়গা করে নেন।
২০০৬ সালের ৬ আগস্ট জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮০ নাম্বার ক্যাপের মাধ্যমে তার ওডিআই অভিষেক হয় এবং ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৫ নাম্বার ক্যাপ এর মাধ্যমে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়।
মুশফিকুর রহিম এর অর্জন :
টেস্ট ক্রিকেটে সফল হওয়া কোনো ক্রিকেটারের পক্ষেই সহজ বিষয় নয়। কারণ টেস্টে ধৈর্য ধরে লম্বা সময় নিয়ে ক্রিজে টিকে থাকতে হয়। মুশফিকুর রহিম তার অভিষেক টেস্ট রঙ্গিন করতে পারেনি। ২০০৫ সালের অভিষেকে মাত্র ১৯ রানে তার ইনিংস শেষ হয়। কিন্তু সেই মুশফিক আজ তার কঠোর পরিশ্রম দ্বারা টেস্টৈ একজন সফল বাংলাদেশী খেলোয়াড়। মুশফিকুর রহিম প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করেন। ৩২১টি বল মোকাবিলা করে ২২ বার চার ও ১টি ছয়ের সাহায্যে ২০০ রান করেন। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে তিনি এই রেকর্ডটি করেন।
২০১৮ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২য় টেস্টে তার ব্যক্তিগত দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নেন এবং সেটি বাংলাদেশের হয়ে কোন ব্যাটসম্যানের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি যেটি আগে কেউ করেনি। মুশফিকুর রহিমের এখন পর্যন্ত টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ড রয়েছে ৩ টি। যার ফলে বাংলাদেশ এর মধ্যে সর্বোচ্চ ডাবল সেঞ্চুরির মালিক মুশফিক। তার টেস্ট এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান ২১৯*।
মুশফিকুর রহিমের ওয়ানডেতে খেলার যাত্রা শুরু হয় জিম্বাবুয়ের সাথে। এখন পর্যন্ত তার ৯ টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি রয়েছে ৪৬ টি অর্ধ-শতক। ওয়ানডেতে তার মোট রান এখন পর্যন্ত ৭৩৮৮*।
মুশফিক তার ক্যারিয়ারে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে ১০২ টি। টি-টোয়েন্টিতে ২০১৮ সালের মার্চে নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলংকার বিপক্ষে ৩৫ বলে ৫ টি চার ও ৪ টি ছক্কায় ৭২ রান করেন মুশফিক। সেটি ছিলো তার টি-টুয়েন্টিতে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস।
৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ তিনি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন।
বাংলাদেশের সাবেক কোচ জেমি সিডন্সে বলেছেন, “রহিমের ব্যাটিং এতটা বহুমাত্রিক যে তিনি এক থেকে ছয় পর্যন্ত যেকোনো অর্ডারে খেলতে পারেন”।
সহ অধিনায়ক :
২০০৯ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে মুশফিক বাংলাদেশের সহ-অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। তৎকালীন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে সাকিব তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং সহ-অধিনায়ক সাকিবের দায়িত্ব পান মুশফিক।
অধিনায়ক :
২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে মুশফিক বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেন। অন্যান্যদের মধ্যে এই দলে ছিলেন ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক তারকা সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবাল। মুশফিকের নেতৃত্বে দলটি কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যেতে সমর্থ হয়।
জাতীয় দলে মুশফিকুর রহিম এর অধিনায়ক হিসাবে যাত্রা ছিলো (২০১১ -২০১৪) সাল পর্যন্ত।
২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এশিয়া কাপে নিজেদের সেরা সাফল্য “রানার্সআপ” অর্জন করেন।
টেস্ট ক্রিকেটে মুশফিকের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলংকাকে পরাজিত করে।
ঘরোয়া ও টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্যারিয়ার:
জাতীয় ক্রিকেট লীগ, বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ, আফগানিস্তান প্রিমিয়ার লীগ, ববঙ্গবন্ধু প্রিমিয়ার ক্লাবের হয়ে খেলেছেন এবং এখনো খেলে যাচ্ছে ও প্রতিনিয়ত দলকে প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছে।
উইকেট কিপার মুশফিক :
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনিই প্রথম এবং একমাত্র উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান যিনি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। ২০২২ সালের জানুয়ারি বার্ষিক আইসিসি পুরস্কারে তাকে, ২০২১ সালের জন্য আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলে মনোনীত করা হয়। তিনি দেশ সেরা উইকেট কিপার হিসেবে পরিচিত।
টপ অর্ডার ভেঙ্গে চুরমার? ত্রাতার ভূমিকায় তিনি আছেন অবশ্যই। কোটি ক্রিকেট ভক্তের আশা ভরসা। ক্রিকেট মাঠে যখন দলের নাজেহাল অবস্থা থাকে, তখন এই মুশফিককে দেখা গেছে দলকে জয়ী করে তুলতে।
তাই তো আজ সে “মি. ডিপেন্ডেবল’’। কখনো উইকেটরক্ষক হিসাবে ব্যাসটম্যানকে ফাদে ফেলে উইকেট তুলে নেয়, নাহলে বাজপাখির মতো ক্যাচ ধরে ব্যাসটম্যানকে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়ে দেয়।
আমাদের প্রত্যাশা :
মুশফিকুর রহিম খুব আবেগ প্রবণ সেটা ক্রিকেট প্রেমীরা যেমন বুঝতে পারে তেমনি তার সতীর্থরাও স্বীকারোক্তিমূলক। মুশফিক নিজে আবেগপ্রবণ কিন্তু তার ভক্তদের কাছে অর্থাৎ ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে তিনি নিজেই এক আবেগের নাম। তার কাছে সবার আশাও থাকে সর্বোচ্চ। মুশফিক যতোদিন ক্রিকেট মাঠে থাকবে ততোদিন তার সেরা পারফরম্যান্স সবাই আশা করে। “মি.ডিপেন্ডেবল“ এর ব্যাটে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য উপন্যাস। ভবিষ্যতে যেনো অতীতকেও ছাড়িয়ে যায় সেই শুভ কামনা রইল “মি. ডিপেন্ডেবল” এর জন্য।
এরকম আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখক,
তাবাসসুম আক্তার তাবা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE