আমরা অনেক সময়ই টেলিভিশনের পর্দায় স্বাস্থ্যবিষয়ক টকশোগুলো দেখে থাকি, যেখানে বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ কিংবা মনোবিশেষজ্ঞগণ আমাদের নানারকম পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন? এই মানুষগুলো যদি ভালোর মুখোশ পড়ে মানুষের ক্ষতি শুরু করে!
তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক এমনই একটি হৃদয়বিধারক ঘটনা।
১৯৮৩ সাল, Granada Television এর কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডকুমেন্টারি “World In Action” এ সমাজে মানসিক রোগীদের সাথে কি রকম আচরণ করা উচিত তা নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো হাইডের একজন সম্মানিত General Practitioner কে। টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসে থাকা দর্শকেরা হয়তো ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করেননি যে এই সম্মানিত ব্যক্তিই নিরবে নিভৃতে তার নিজস্ব রোগীদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছেন।
বলছি, ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার চিকিৎসক Dr.Death অর্থাৎ, Harold Shipman এর কথা।
Harold Shipman এর বেড়ে উঠা
Shipman এর জন্ম ১৯৪৬ সালে নটিংহ্যামের একটি কাউন্সিলের বেস্টউড এস্টেটে। লরি ড্রাইভার, Frederick Shipman এবং Vera Brittain এর তিন সন্তানের মাঝে দ্বিতীয় ছিলেন Harold Shipman। ছোট থেকেই Harold Shipman বেশ ভালো শিক্ষার্থী ও খেলোয়াড় ছিলেন। বেড়ে উঠার সময়, Shipman যুবলীগে একজন দক্ষ রাগবি খেলোয়াড় ছিলেন।
Shipman বেশ ভালো দৌড়বীদ ছিলেন, স্কুলে তার শেষ বছরে তিনি অ্যাথলেটিক্স দলের সহ-অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
২১ জুন, ১৯৬৩
১৭ বছর বয়সের Shipman এর মা তখন ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত। ছোট থেকেই Shipman মায়ের বেশ ভক্ত ছিলেন, মায়ের এই খারাপ সময়েও তিনি তার রোগাক্রান্ত মায়ের পাশেই থাকতেন। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত Vera Brittain ব্যাথায় কাতরাতে থাকেন, অবশেষে তিনি ব্যাথা কমানোর জন্য বাড়িতে এক ডাক্তারের পরামর্শে মরফিন সেবন করেন। মরফিন সেবনের কিছুক্ষণ পরেই তার ব্যাথা কমতে থাকে। Shipman তার মায়ের পাশে বসে তার ব্যাথাকমা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, যতক্ষণ না তার মায়ের মৃত্যু ঘটে। সেদিনই মরফিনের ব্যবহারে মারা যায় Shipman এর মা। কিন্তু মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মায়ের ব্যাথা কমতে দেখেছিলো Shipman, এই পর্যবেক্ষণই তার ভবিষ্যতে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
৫ নভেম্বর, ১৯৬৬
এই দিনটি ছিলো Shipman এর জন্য বিশেষ একটি দিন। Harold Shipman এর সাথে Primrose May Oxtoby এর বিয়ে সম্পন্ন হয়। তাদের বিবাহ জীবন সুখের ছিলো এবং এই দম্পতির ঘরে পরবর্তীতে চারজন সন্তান জন্মলাভ করে।
শিক্ষাজীবন
১৯৭০ সালে, Leeds School of Medicine, University of leeds হতে Shipman মেডিসিন বিষয়ের উপর গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে।
Shipman এর কর্মজীবন
আমরা একটা বাক্য সবাই জানি, “শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।” হ্যাঁ, এই কথাটি সঠিক, তবে শুধু তখনই যখন এই শিক্ষাকে ভালো কাজে লাগানো হয়। শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে যেমন একটা জাতিকে গড়ে তোলা সম্ভব, ঠিক তেমনি মেধা আর শিক্ষা হতে অর্জিত জ্ঞানকে হাতিয়ার বানিয়ে একটি জাতিকে ধ্বংস করাও সম্ভব। ঠিক এরকমটাই দেখা গিয়েছিলো Harold Shipman এর জীবনে আর এই হাতিয়ার কাজে লাগানোর মূল জায়গা ছিলো তার কর্মক্ষেত্র।
১৯৭৪ সাল
Pontefract General Infirmary, Pontefract থেকে Shipman তার কর্মজীবন শুরু করে। এই বছরেই Abraham Ormerod Medical Centre, Todmorden এ তিনি General Practitioner হিসেবে প্রথম স্থান অর্জন করেন। General Practitioner হিসেবে কাজ শুরু করার পর থেকেই Shipman এর কারনামা শুরু হয়, প্রথমে তিনি নিজেকে দিয়েই শুরু করেন।
তিনি নিজের ব্যবহারের জন্য Pethidine এর জাল প্রেসক্রিপশন তৈরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। Pethidine হলো ব্যথানাশক ওষুধ, এটি সাধারণত ব্যথা কমানোর জন্য এবং বাচ্চা ডেলিভারির সময় প্রসব যন্ত্রণা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ওষুধ নেশা করার উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হতে পারে। Shipman এর এই কর্মকান্ড প্রকাশ পাওয়ার পর তাকে জরিমানা করা হয় এবং ইয়র্কের একটি মাদক পুনর্বাসন ক্লিনিকে পাঠানো হয়।
১৯৭৭ সালে
গ্রেটার ম্যানচেস্টারের হাইডে ডনিব্রুক মেডিকেল সেন্টারে General Practitioner হিসেবে যোগ দেন। পুরো ১৯৮০-র দশক জুড়ে হাইডে তিনি G.P. হিসেবে নিজের সেবা প্রদান করেন। এসময়ে বয়স্ক মহিলাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর হার হঠাৎ বেশ বেড়ে গিয়েছিলো, কীভাবে বেড়ে গিয়েছিলো তা বুঝতে হয়তো আপনার অসুবিধা হবে না। তবে সেসময়ে কর্মরত চিকিৎসক এবং অন্যান্যদের চোখে বালি দেয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিলো Shipman এর জন্য।
১৯৯৩ সালে, Shipman 21 Market Street এ নিজস্ব সার্জারি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে Community এর একজন সম্মানিত সদস্য হয়ে উঠেন। নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় ভালোর মুখোশ পড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো আরো বেশি সহজ হয়ে যায় তার জন্য।
মার্চ, ১৯৯৮
সত্য কখনো লুকানো থাকে না, একদিন না একদিন তা সবার সামনে উন্মোচিত হবেই। ঠিক তেমনই সত্য উন্মোচনের রাস্তার বন্ধ দরজা খুলে দিতে চেয়েছিলেন হাইডে ব্রুক সার্জারির সার্জন Linda Renolds। তিনি Shipman এর রোগীদের মাঝে উচ্চমৃত্যুর হার সম্পর্কে দক্ষিণ ম্যানচেস্টারের জেলার John Bollard এর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বয়স্ক মহিলাদের Cremantion Forms এর জন্য Shipman এরই স্বাক্ষরের প্রয়োজন ছিলো, ফলে Shipman যদি তাদের কোনো ক্ষতিও করে থাকে তাহলে তা বুঝে উঠার ক্ষমতাও কারো নেই। পুলিশ তাদের তদন্ত শুরু করলেও, অভিযোগ আনার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ খুঁজে না পাওয়ায় ১৭ এপ্রিল তদন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়।
Shipman, তদন্ত বন্ধ হওয়ার পর,পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে এবং সত্যের দরজা পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি তার হত্যাযজ্ঞ পুনরায় আরম্ভ করেন।
কয়েক মাস পরের ঘটনা,
ট্যাক্সি চালক John Shaw পুলিশ কর্মকর্তাদের জানান যে তিনি Shipman কে ২১ জন রোগীর মৃত্যুর জন্য সন্দেহ করছেন। কারণ, তিনি প্রায়ই বয়স্ক মহিলাদের সুস্থাবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু Shipman এর তত্ত্বাবধানে তারা সবাই মারা যায়।
২৪ জুন, ১৯৯৮
হাইডের Former Mayor, Kathleen Grundy কে তার নিজ বাড়িতে মৃতাবস্থায় পাওয়া যায়। Grundy মূলত Shipman এর কাছে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছিলেন। Grundy এর মৃত্যু আকস্মিক কিন্তু স্বাভাবিক ছিল। Shipman তার Death Certificate এ স্বাক্ষর করেন এবং কারণ হিসেবে বৃদ্ধ বয়স উল্লেখ করেন। Shipman শেষ ব্যক্তি ছিলেন যিনি Grundy কে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান।
মূল ঘটনা শুরু হয় যখন Grundy-র মেয়ে, Solicitor Angela Woodruff এর সহকর্মী Solicitor Brian Burgress তাকে জানান যে, তার মা একটি উইল তৈরি করেছে যেখানে Woodruff এবং তার বাচ্চাদের কিছু দেয়া হয়নি অথচ Shipman এর নামে ৩ লক্ষ ৮৬ হাজার পাউন্ড দেয়া হয়েছে। Woodruff এ ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়লেও কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাননি, অবশেষে Burgress এর জোরাজোরিতে Woodruff পুলিশের কাছে সাহায্য চায় এবং তদন্ত শুরু হয়। Grundy-র মৃতদেহ বের করা হয় এবং শুরু হয় ময়নাতদন্ত। Grundy-র শরীরে Diamorphine (হেরোইন) এর চিহ্ন পাওয়া যায়।
Shipman দাবি করেন যে, Grundy মাদকাসক্ত ছিলেন এবং তিনি তার মেডিকেল জার্নালে Grundy-র শারীরিক অবস্থার বিস্তারিত লিখে রেখেছেন। পরবর্তীতে পুলিশ তার কম্পিউটার চেক করে জানতে পারেন, Grundy-র মাদকাসক্তের সমস্ত তথ্য তার মৃত্যুর পর Entry করা হয়েছে। Shipman এর এই ছোট ভুল সত্যের দরজাকে খুলে দিতে সাহায্য করে। অবশেষে ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮ তারিখে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্তের এক পর্যায়ে জানা যায়, তার এরকম অসংখ্য জাল উইল তৈরি করে দিতো Brothers Typewriter এর একজন টাইপরাইটার।
Shipman এর এই তদন্তে সন্দেহভাজন আরো ১৫ টি নমুনার ময়নাতদন্ত করে পুলিশ, এতে কীভাবে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে Shipman তার হত্যাযজ্ঞ চালাতো তা সবার সামনে উঠে আসে।
Shipman এর হত্যাযজ্ঞের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ছিলো,
১. বয়স্ক মহিলাদের Diamorphine এর লিথাল বা প্রাণঘাতী ডোজ প্রদান
২. হত্যাকৃত রোগীদের Death Certificate এ নিজ হাতে স্বাক্ষর
৩. তাদের স্বাস্থ্য খারাপ ছিলো বলে মিথ্যা মেডিকেল রেকর্ড তৈরি
একইভাবে তিনি Grundy কেও হত্যা করে। তার বাড়িতে চিকিৎসা সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে Shipman তাকে Diamorphine এর লিথাল ডোজ দিয়ে তাকে হত্যা করে। তারপর টাইপ রাইটারের সহযোগিতা নিয়ে জাল উইল তৈরি করে।
মামলার বিচার শুরু
৫ অক্টোবর, ১৯৯৯ সালে প্রেস্টন ক্রাউন কোর্টে Shipman এর বিচার শুরু হয় এবং ছয়দিনের আলোচনা শেষে, ৩১ জানুয়ারি, ২০০০ তারিখে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এরই ১১ দিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি, General Medical Council দ্বারা Shipman এর মেডিকেল রেজিস্ট্রার বন্ধ করে দেয়া হয়।
এই পুরো বিচারকার্য চলাকালীন, এমনকি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, Shipman কখনই তার দোষ স্বীকার করেননি। এমনকি তার স্ত্রী Primrose ও সরল মনেই Shipman কে ভালোবেসে বিশ্বাস করে গেছেন এবং পুরোটা সময়ই তিনি Shipman এর পক্ষে ছিলেন। Shipman এধরনের কাজ করতে পারে তা Primrose কখনো কল্পনাও করতে পারেননি।।
Shipman এর সাথে থাকা এক কয়েদির মতে, বিচারকার্য শেষ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর Primrose তার স্বামী Shipman কে একটি চিঠি লিখে পাঠায়, তাতে লেখা ছিলো, “সত্য যেটাই হোক, তুমি আমাকে সম্পূর্ণটা জানাতে পারো।” Primrose এর এই চিঠি পেয়ে Shipman বুঝতে পারে যে তার স্ত্রীও তার প্রতি সন্দেহভাজন হয়ে উঠেছে।
Shipman জেলে থাকাকালীন অবস্থায় তার Probation Officer কে বারবার বলতে জানা যায় যে, সরকার তার জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা পেনশন কেড়ে নেওয়ার পর, তিনি তার স্ত্রীর স্বাস্থ্য ও আর্থিক সুরক্ষার জন্য আত্মহত্যার কথা বিবেচনা করছেন।
১৩ জানুয়ারি, ২০০৪, সকাল ৬:২০ মিনিট
Home Secretary David Blankett এর কাছে একটি ফোন আসে, ফোন রিসিভ করে তিনি জানতে পারেন, HM Wakefield জেলে থাকা ৫৭ বছর বয়সী এক লোক তার বিছানার চাদর দিয়ে জানালার সাথে ফাসি দিয়েছেন, সেই লোকটি আর কেউ নয়, বরং নীরবে বহু নিরীহ লোকের প্রাণ হননকারী Harold Shipman।
Shipman এর স্ত্রী Primrose ‘NHS pension’ এর পুরো টাকাটা পেয়েছিলেন, যদি Shipman এর বয়স ৬০ এর ঊর্ধ্বে চলে যেতো তাহলে Primrose এই টাকা আর কোনোদিনও লাভ করতে পারতেন না।
তার এই আত্মহত্যায় বহু জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলো, তারা বলেন তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। তবে এই খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে দুইভাবে বিভক্ত করে দেয়, কোনো মাধ্যমে একে আনন্দের বার্তা হিসেবে আবার কোনো মাধ্যম একে জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে বলে প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে পুরো তদন্তের রিপোর্টে উঠে আসে, Shipman তার পুরো কর্মজীবনে প্রায় ২৫০ বা এরও বেশি রোগীকে হত্যা করেছেন এবং অনেক ভুক্তভোগীর সম্পদ তার গ্যারেজে পাওয়া যায়।
একই মানুষ যিনি অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছেন, আবার সেই মানুষটাই তার স্ত্রী সন্তানের কথা চিন্তা করে নিজের জীবন হনন করেন, খুব অদ্ভুত তাই না? তবে Shipman এর মতই এরকম অসংখ্য মানুষ ভালোর মুখোশ পড়ে নানারকম খারাপ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে নীরবে নিভৃতে, তবে আমরা তো জানি, সত্য কখনো চাপা থাকে না, তাই না?
আরোও ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Writer,
Diderul Islam
Intern, Content Writing Department
YSSE