ডিপফেক প্রযুক্তি কী?

ডিপফেক হলো বাস্তবসম্মত দেখতে কিন্তু নকল বা কিছুটা পরিবর্তিত কন্টেন্ট যা ভিডিও বা অডিওর উপাদান সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়। ডিপফেক ভিডিওতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন ব্যক্তির মুখের অবয়ব বা ভয়েসকে অন্য কারোর সাথে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়।

ডিপফেক প্রযুক্তির সহায়তায় একজন ব্যক্তির এমন কিছু ভিডিও বা অডিও কন্টেন্ট তৈরি করা সম্ভব যা তিনি নিজে বলেননি বা করেননি।

ডিপফেক প্রযুক্তির উৎপত্তি:

ডিপফেক এর বিবর্তন ১৯৯৭: ভিডিও রিরাইট প্রোগ্রাম

ডিপফেক ভিডিওর প্রথম উদ্ভাবনটি ১৯৯৭ সালে ভিডিও রিরাইট প্রোগ্রামের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল৷ সফ্টওয়্যারটি এই ধরণের প্রথম কয়েকটি সফ্টওয়্যারের মধ্যে একটি যা একজন ব্যক্তির কথা বলার ভিডিওকে সংশোধন (মোডিফাই) করতে সক্ষম হয়েছিল৷ এটি আসল ভিডিওতে একটি অডিও ওভারলে (overlay) বসিয়ে, আসল ভিডিওর ব্যক্তির দ্বারা লিপ-সিঙ্ক এর মাধ্যমে নতুন ধরণের শব্দ বলাতে সক্ষম হয়েছিল৷

 

এছাড়াও এটি (ভিডিও রিরাইট ) এই ধরণের প্রথম সফ্টওয়্যার যা একটি ভিডিওতে “ভুয়া অডিও” যুক্ত করতে পারে। সফ্টওয়্যারটির জন্য ব্যবহৃত কৌশলটি ছিল মেশিন লার্নিংয়ের উপর ভিত্তি করে। মূলত, কৌশলটি সিনেমায় ডাবিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, যা ভিডিও রিরাইট সফ্টওয়্যার টুলের স্বয়ংক্রিয় ফিচারের কারণে অত্যন্ত দ্রুত করা যেত।

 

বিংশ শতকের শুরুর দিকে: একাডেমিক গবেষণা

মাত্র কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কৌশলটি মূলত একাডেমিক বিশ্বে এআই এবং মেশিন লার্নিং সম্পর্কে শেখার উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে প্রযুক্তিটি নিয়ে ব্যপক একাডেমিক গবেষণা করা হয়। ডিপফেক সম্পর্কিত একাডেমিক গবেষণা মুলত কম্পিউটার ভিশন নিয়ে করা হয়েছে, যা কম্পিউটার বিজ্ঞানের-ই একটি উপশাখা।

২০১৭: ‘ডিপফেক’ শব্দটির প্রচলন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “ডিপফেক” বিষয়টি খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালে, “ডিপফেক” শব্দটি একই নামের একটি রেডডিট ব্যবহারকারী দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল।

 

ডিপফেক শব্দটি “ডিপ লার্নিং” এবং “ফেক” শব্দের সংমিশ্রণ, অর্থাৎ নকল মিডিয়া কন্টেন্টস। ডিপফেক-এর প্রয়োগ প্রাপ্তবয়স্কদের কন্টেন্টে, বিনোদন জগতে, রাজনীতি, পাশাপাশি সমাজে জনপ্রিয় আরও অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়।

 

ডিপফেক প্রযুক্তি কে আবিষ্কার করেছে?

ডিপফেক প্রযুক্তির কোনও একক উদ্ভাবক নেই। যদিও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি হিসাবে ডিপফেকের ভিত্তি ১৯৯০ এর দশকে স্থাপন করা হয়েছে। তবে ডিপফেকের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় (উপাদান) এর একটি জেনারেটিভ অ্যাডভারসারিয়াল নেটওয়ার্ক (GAN), যা ২০১৪ সালে পিএইচডি স্নাতক ইয়ান গুডফেলো দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল। যিনি পরে অ্যাপল-এ কাজ শুরু করেন।  GAN-এর ব্যাপক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, ডিপফেক প্রযুক্তিটি অনেক পণ্ডিত এবং শিল্প ব্যক্তিত্বদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

 

ডিপফেক কিভাবে কাজ করে:

ডিপফেক বিভিন্ন মাধ্যমে কত ধরণের ভুল তথ্য ছড়ায় যেমন : ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রধানত তিন ধরণের ভুল তথ্য ছড়ায়।

 

১.তথ্যগত – তথ্য অল্প পরিবর্তন, ভুলভাবে ব্যবহার, অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্যবহার, পুরোপুরি পরিবর্তন করে কিংবা একেবারেই ভিত্তিহীন তথ্য ব্যবহারের মাধ্যমে।

 

২.ছবির মাধ্যমে – ভিন্ন ঘটনার ছবি, পুরনো ছবি, হুবহু দেখতে একইরকমের ছবি কিংবা এডিটেড ছবির ব্যবহারের মাধ্যমে।

 

৩.ভিডিওর মাধ্যমে – ভিন্ন ঘটনার ভিডিও, পুরনো ভিডিও, একই ধরণের ভিডিও, এডিটেড ভিডিও কিংবা ডিপফেক ভিডিও ব্যবহারের মাধ্যমে। এছাড়াও, অডিওর মাধ্যমেও ভুল তথ্য ছড়াতে পারে।

ডিপফেক এর প্রভাব কী এবং কীভাবে এই প্রযুক্তি আমাদের সমাজকে প্রভাবিত করে:

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এআই ফার্ম ডিপট্রেস সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে অনলাইনে ১৫,০০০ ডিপফেক ভিডিও খুঁজে পেয়েছে, যা নয় মাসের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ। আশ্চার্যজনক হলেও সত্য যে, এর মধ্যে ৯৬% পর্নোগ্রাফিক ভিডিও এবং এর ৯৯% হলো নারী সেলিব্রিটিদের চেহারা পর্ন তারকাদের চেহারা দ্বারা পরিবর্তিত করা। 

 

বোস্টন ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ড্যানিয়েল সিট্রন বলেছেন: “ডিপফেক প্রযুক্তি নারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে।” এই প্রযুক্তিতে পর্নের বাইরেও প্রচুর মিথ্যা, ফাঁকি, ব্যঙ্গ এবং অনিষ্টের সুযোগ রয়েছে।

ডিপফেকের ফলাফল খুবই ভয়ানক হতে পারে। বিশেষ করে পাবলিক ফিগার এবং সেলিব্রিটিদের জন্য এটি বিপর্যয়কর পরিণতি হতে পারে। এর প্রভাবে ক্যারিয়ার এবং জীবন আপস করা হতে পারে, কিছুক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েও যেতে পারে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ঘটনা এমনকি যুদ্ধ শুরু করার জন্য বিশ্ব নেতাদের নকল ভিডিও ব্যবহার করতে পারে। এই প্রযুক্তি একজন ব্যক্তির খ্যাতি ক্ষুন্ন করতে পারে বা কাউকে দিয়ে অপ্রয়োজনীয় কিছু বলাতে বা করাতে পারে (ভার্চুয়ালে)। এটি স্ক্যামারদের একটি নিখুঁত অস্ত্র।

 

ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদাহরণ:

 

ডিপফেকের সাথে জড়িত জালিয়াতির প্রথম ঘটনাটি হলো স্ক্যামাররা যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক একটি এনার্জি কোম্পানির সিইওকে তার জার্মান বসের ভয়েস নকল করে তাকে একটি তৃতীয় পক্ষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে €২২০,০০০ (ইউরো) স্থানান্তর করার নির্দেশ দেয় এবং ডাকাতি করে। 

 

নকল পর্নো ভিডিও দিয়ে ডিপফেকের বিস্তার শুরু হয়। অনেক মহিলা সেলিব্রিটি ডিপফেক পর্নের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ডেইজি রিডলি, জেনিফার লরেন্স, এমা ওয়াটসন এবং গ্যাল গ্যাডট। বিষয়টি মিশেল ওবামা, ইভানকা ট্রাম্প এবং কেট মিডলটনের মতো বিভিন্ন দেশের নেতাদের সাথে যুক্ত নারীদেরও প্রভাবিত করেছে। ২০০৯ সালে DeepNude নামে একটি ডেস্কটপ অ্যাপ্লিকেশন প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ব্যক্তির পোশাক অপসারণ করতে সক্ষম ছিল। পরবর্তীতে, এটি ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।

 

এছাড়াও যেসব ক্ষেত্রে ডিপফেক প্রযুক্তি অসৎ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় সেগুলো হলো :

➤রাজনীতিবিদদের বিকৃতি

➤ব্ল্যাকমেইল

➤রাজনৈতিক

➤শিল্পে

অভিনয়ে

সিনেমায়

➤সক পাপেটস-এ

সামাজিক মাধ্যমে

ডিপফেক প্রযুক্তি আইন  :

যেহেতু ডিপফেক শুধুমাত্র গত কয়েক বছরে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তাই এর প্রয়োগ সংক্রান্ত আইন এখনও সব দেশে নেই। যেসব দেশে ডিপফেক ব্যবহারে আইন আছে তার মধ্যে একটি হলো চীন। চীনা সাইবারস্পেস প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে ডিপফেক ব্যবহার করে তৈরি ভুয়া খবর অবৈধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, প্রায় সব রাজ্যেই ডিপফেক পর্ন সম্পর্কিত আইন রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশও ডিপফেক প্রযুক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইন গঠিত হচ্ছে। 

 

ডিপফেইক ভিডিও যাচাইয়ের উপায়:

সময়ের সাথে সাথে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করার উপায়ও আবিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে।

দ্বিতীয়ত, ছবির মেটাডেটা থেকে কিংবা ভিডিও মেটাডেটা টুলস ব্যবহার করা হয়। সাধারন ভিডিওর ক্ষেত্রে ইনভিড (inVid) ও ইউটিউব ভিডিওর ক্ষেত্রে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর “ইউটিউব ডেটা ভিউয়ার” ব্যবহার করা যেতে পারে।

 

 এছাড়াও কোনো স্থানের প্রচারিত ছবি যাচাইয়ে গুগল স্ট্রিট ভিউ, গুগল ম্যাপ ব্যবহার করা যায়। 

খালি চোখে সাধারণ মানের ডিপফেক ভিডিওগুলো শনাক্ত করা এখনও সম্ভব হতে পারে।যেমন:

.অস্বাভাবিক মুখভঙ্গি,

.চোখের পাতার অস্বাভাবিক নড়াচড়া কিংবা

. মাথার অস্বাভাবিক গতিবিধি বা নড়াচড়া, 

.অবাস্তব ত্বকের রঙ বা ত্বকের অস্বাভাবিক পরিবর্তন;

. ঝাঁকুনি, ঠোঁট নড়ার সাথে কথার কম মিল, 

.ব্যাকগ্রাউন্ডের চেয়ে ব্যক্তির মুখ অস্পষ্ট,

. সাবজেক্টে আলো সমস্যা, 

.ফ্রেমে অতিরিক্ত পিক্সেল ইত্যাদি (তথা ক্রিটিকাল থিংকিং বা যুক্তিনির্ভর চিন্তাশীলতা) দেখে প্রাথমিকভাবে  ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা যায়। 

এছাড়াও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন টুলস ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রেই ডিপফেক ভিডিও যাচাই করা যায়। 

 

এরকম আরো ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন। 

লেখিকা,

ফারিহা আলিফ

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE