পড়াশোনা সবে শেষ হয়েছে তন্নিষ্ঠার। মা ঠিক বাগিয়ে এনেছেন বড়লোক পরিবারের প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার ছেলে। এই অঘ্রাণেই বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়ে ছিল। কিন্তু মাঝখানে বাধ সাধলো কালাশৌচ। শৌনক, যার সাথে তনিষ্ঠার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, তার দাদু মারা যাওয়ায় আসছে অঘ্রাণ পর্যন্ত পিছিয়ে গেল তন্নিষ্ঠার বিয়ে। তন্নিষ্ঠার বিয়ে পেছালে কি হবে, বিয়ের নিমন্ত্রণ তো আর থেমে থাকে না। বান্ধবী মালবিকার বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে তন্নিষ্ঠার পরিচয় হয় অভিমন্যুর সঙ্গে। অভিমন্যু কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে এখন পারফিউমের ফ্যাক্টরি চালায়, নানারকম পারফিউম তৈরি করে। তাই তন্নিষ্ঠা তাকে সম্বোধন করে গন্ধবিশারদ নামে। অভিমন্যু ঠিক যেন শৌনকের বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। শৌনক উত্তর মেরু হলে অভিমন্যু  দক্ষিণ মেরু। 

 

শৌনকের জীবনে রয়েছে উচ্চাশা, অ্যাম্বিশন, অনেককিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। ক্যারিয়ারের ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস শৌনক, ক্যারিয়ারের অগ্রগতির জন্য কোনোকিছুর সাথে আপোষ করতে রাজি নয় সে। অন্যদিকে অভিমন্যু চালচুলোহীন এক যুবক যে অ্যাম্বশনের পেছনে ছোটে না, যার নিজের ব্যবসা বাড়ানোর গরজ নেই। জীবনের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের প্রয়োজনটুকু মিটে গেলেই সে খুশি।

পারফিউম তৈরি করা শুধু তার জীবিকা নয়, এতে একধরণের সুখ মিশে আছে অভিমন্যুর। আর ব্যবসা বাড়ানোর নেশায় সেই সুখটুকু হাতছাড়া করতে রাজি নয় সে। কেন চোখের পাতায় স্বপ্ন মিশে থাকা এই তরুণের এই তীব্র অনীহা অ্যাম্বিশানের প্রতি? তন্নিষ্ঠাই বা কাকে বেছে নেবে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে? অভিমন্যু নাকি শৌনক? জানতে হলে পড়তে হবে সূচিত্রা ভট্টাচার্য রচিত উপন্যাস- অন্য বসন্ত।

 

এই উপন্যাসে সূচিত্রা ভট্টাচার্য তন্নিষ্ঠার সীদ্ধান্তহীনতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন আর উচ্চাকাঙ্খার মধ্যকার তফাতটাও খুব সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। আমরা ভাবি, অ্যাম্বিশান না থাকলে জীবন অর্থহীন। ক্রমাগত একটার পর একটা লক্ষ্য নির্ধারন করা আর তা অর্জন করার জন্য  ক্রমাগত ছুটে চলার নামই বোধহয় জীবন। অ্যাম্বিশান না থাকলে মানুষ বাঁচবে কি নিয়ে? ঠিক এই জায়গাটাতেই অন্য বসন্তের অভিমন্যু যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় অ্যাম্বিশানের পেছনে অন্ধভাবে ছোটার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে। অভিমন্যুর মতে, মানুষ বেঁচে থাকবে তার স্বপ্ন নিয়ে। যেমন অভিমন্যুর জীবনের স্বপ্ন হচ্ছে এমন একটা পারফিউম তৈরি করা যা এর আগে কেউ কখনো তৈরি করতে পারেনি।

তীব্র খরার পর জঙ্গলে প্রথম বৃষ্টি হলে বুনো লতায় যে গন্ধ ওঠে, অভিমন্যু তার পারফিউমে সেই সুগন্ধটাই তুলে আনতে চায়। ঠিক তেমনি অভিমন্যুর কোম্পানির সেলসম্যান সমীরণ প্রতিদিন দুঃখ দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করতে করতেও ক্লান্ত হয় না, জীবনবিমুখ হয় না; কারণ তার একটা স্বপ্ন আছে- একদিন এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখবে সে। অন্য বসন্ত উপন্যাসটি গভীর জীবনবোধের গল্প শোনায়, আমাদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করে, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটায়। তাই যেকোনো বইপ্রেমীর জন্যই সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে সূচিত্রা ভট্টাচার্যের এই উপন্যাসটি।

 

বিহারের ভাগলপুরে জন্ম নেয়া সূচিত্রা ভট্টাচার্য একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। কিন্তু লেখক হিসেবে সম্পূরণরূপে আত্মপ্রকাশের পর তিনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তার রচনাসমূহের মূল উপজীব্য বিষয় হলো নারীর চলার পথের দুঃখ-কষ্ট, মধ্যবিত্তদের জীবনযাপন এবং তাদের সম্পর্কের নানান টানাপোড়েন। সূচিত্রা ভট্টাচার্যের রচানাগুলোর মধ্যে কাছের মানুষ, যখন যুদ্ধ, আমি রাইকিশোরী, কাচের দেয়াল, দহন, হেমন্তের পাখি, গভীর অসুখ অন্যতম। জনপ্রিয় মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র মিতিন মাসির স্রষ্টাও তিনি।

জীবদ্দশায় তিনি ঞ্জাগুডু থিরুমালাম্বা জাতীয় পুরস্কার (ব্যাঙ্গালোর), কথা পুরস্কার, ত্রিবৃত্ত পুরস্কার, সাহিত্যসেতু পুরস্কার, তারাশংকর পুরস্কার, দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কারসহ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৫ সালের ১২ মে জনপ্রিয় এই ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক পরলোকগমন করেন।

 

ঐ একই বছর অন্য বসন্ত উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। সিনেমাটি পরিচালনা করেন ভারতীয় পরিচালক অদিতি রায়। সিনেমাটি দেশে বিদেশে প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছে।

 

বই : অন্য বসন্ত

লেখক : সূচিত্রা ভট্টাচার্য

প্রকাশনী : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (কলকাতা)

পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১১৯

পার্সোনাল রেটিং : ৮/১০

এরকম আরও অনেক ব্লগ পড়ার  জন্য ক্লিক করুন

 

লেখিকা, 

আতিয়া আলম নিসা 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমন্ট। 

YSSE