সালটা ১৯১৮, চার বছরের বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে শেষ হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে, জার্মানি ছিলো অন্যতম সক্রিয় দেশ এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের অর্থনীতিকে খুব বাজে অবস্থায় আবিষ্কার করে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, হাইপার-ইনফ্লেশনের কারণে জার্মান মুদ্রা “মার্ক” খুব দ্রুত মান হারাতে থাকে।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে আবির্ভাব হয় “নটগেল্ড” বা জরুরী মুদ্রার। এই জরুরী মুদ্রা লোকাল অর্থনীতিতে বিশেষ প্রভাব রাখে যা আমরা এই ব্লগে জানবো।
ইতিহাস:
নটগেল্ড অর্থ জরুরী মুদ্রা। এই মুদ্রার প্রচলন হয় ১৯২০ সালের দিকে যখন জার্মান মার্ক উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে মান হারাতে থাকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, একটি পাউরুটির দাম ৩.৫ লাখ মার্কে পৌছে যায়। এই বিশাল পরিমাণ টাকা হিসাব রাখাও যেমন সমস্যা, তেমনই সেটা বহন করাও সমস্যা।
এছাড়াও মার্ক ছিলো অস্থিতিশীল, প্রতিদিন এমনকি প্রতি ঘন্টাতেও মূল্যমান পরিবর্তন হতো।
উপরোক্ত সমস্যার সমাধান হিসেবে আবির্ভাব হয় নটগেল্ড নামক মুদ্রা ব্যবস্থা।
ব্যাংকনোটের সাথে এই নোটের মূল পার্থক্য হলো, নটগেল্ড একটি লোকাল কারেন্সি যা শুধু নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে চলমান এবং ব্যাংকনোট মূলত পুরো দেশে চলমান থাকে।
একটি উদাহরণ এর মাধ্যমে বোঝানো যাক।
১৯২০ এর আগে জার্মান মুদ্রা ছিলো মার্ক যা পুরো দেশে চলমান বা প্রচলন ছিলো। ১৯২০ এর পর সে স্থানে আসে নটগেল্ড যা তৎকালীন ২২টি স্টেট এ প্রচলিত ছিলো। উল্লেখ্য, একটি স্টেট এর মুদ্রা অন্য স্টেট এ ছিলো মূল্যহীন।
থিম:
নটগেল্ডগুলো যেহেতু লোকালভাবে প্রস্তুত করা হতো, সেখানে তাই প্রায়শই স্থানীয় ল্যান্ডমার্ক এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে পৌরাণিক প্রতীক পর্যন্ত চিত্তাকর্ষক চিত্রাবলী দিয়ে সজ্জিত ছিলো।
উক্ত নকশাগুলো কেবল সনাক্তকরণের কারণই ছিলো না, বরং তা স্থানীয় গর্ব, সংস্কৃতি, সংহতি বাড়ানোর উপায় ও ছিলো। এমনকি কিছু নোটে রাজনৈতিক বার্তা বা হাস্যরসাত্মক চিত্র থাকতো। এছাড়াও লোকাল চার্চ বা গীর্জা থেকেও নটগেল্ড ছাপানো হয়েছিলো।
মোট কতো ধরনের নটগেল্ড ছিলো তা নিয়ে রয়েছে নানা মতামত। তবে অনুমান করা হয় প্রায় ৪৫,০০০ ধরনের নটগেল্ড ১৯১৫ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে ছাপানো হয়েছিলো।
নোটের উপকরণ ও উৎপাদন:
যেহেতু নটগেল্ড ইমারজেন্সি বা জরুরী অবস্থায় ছাপানো হয়েছিলো এবং স্থানীয়ভাবে তৈরী করায় বিধিনিষেধও কম ছিলো।
তাই উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের উপাদান যেমন: কার্ডবোর্ড, চামড়া, সিল্কের মতো অপ্রচলিত জিনিস ব্যবহৃত হতো। কিছু নোট সতর্কতার সাথে ডিজাইন ও মুদ্রণ করা হয়েছিলো, যেখানে কিছু নোট হাতে স্ট্যাম্পিং বা হাতে একেঁও মুদ্রণ করা হতো। উপকরণ ও উৎপাদন পদ্ধতির ভিন্নতা নটগেল্ডের আকর্ষণ ও স্বতন্ত্রতা যোগ করে।
সংগ্রহযোগ্যতা এবং বিরলতা:
নটগেল্ড নোটগুলি নোট-সংগ্রাহক এবং ইতিহাস উৎসাহিদের মধ্যে অত্যন্ত চাওয়া-পাওয়ার কিংবা সংগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। তাদের অভাব, বৈচিত্র্যময় এবং শৈল্পিক নকশার, তাদের অতীত যুগের মূল্যবান নিদর্শন করে তোলে।
এটা শুধু নোট ই ছিলো না, ছিলো তৎকালীন সময়ের স্থাপত্য, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। কিছু সংগ্রাহক নির্দিষ্ট থিম, অঞ্চল বা সময়কালে ফোকাস করে, এবং বেশিরভাগ নোটই বর্তমানে শতাব্দীর বেশি পুরোনো।
যদিও নোটগেল্ড অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে আবির্ভাব হয়েছিলো, এর উপযোগিতা আর্থিক ইতিহাসের সীমানা ছাড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে বহুদূর। এই জরুরি নোটগুলির নকশায় প্রদর্শিত সৃজনশীলতা প্রতিকূলতার মুখে জার্মান জনগণের স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজনযোগ্যতা প্রতিফলিত করে।
নোটগেল্ড চ্যালেঞ্জিং সময়ের একটি বাস্তব অনুস্মারক এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির বিস্তৃত আখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
নটগেল্ড সংকটের সময়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজনীয়তা থেকে জন্ম নেওয়া এই জরুরী মুদ্রাগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানির মুখোমুখি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলির উপর একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে।
নটগেল্ড নোটগুলির বৈচিত্র্যময় এবং শৈল্পিক প্রকৃতি সংগ্রাহক এবং ইতিহাসবিদদের কল্পনাকে সমানভাবে দখল করে চলেছে। এটি একটি অশান্ত সময়ের সাথে বাস্তব সংযোগ সরবরাহ করে।
এমন লেখা আরও পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখক
হাসিবুল আহমেদ পুলক
ইন্টার্ন, কন্টেন রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE