সূর্যের আলোর জন্যই পৃথিবীতে প্রাণ আছে। এই আলোর অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল ইতালির ‘ভিগানেলা’ গ্রামের বাসিন্দারা। তাদের সমস্যার সমাধানে পাহাড়ের চূড়ায় বসানো হলো বিশাল এক আয়না, যার প্রতিফলন করবে গ্রামকে আলোকিত। ব্যস্! এতেই হলো ভিগানেলা গ্রামে সূর্যের আগমন।
ইতালির ভিগানেলা নামক ছোট্ট গ্রামের অবস্থান দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটা উপত্যকায়। এই গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ২০৬ জন। মনোরম প্রাকৃতিক স্থানের এই গ্রামে কম জনসংখ্যার কারণ এই গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান। এই অবস্থানের কারণেই শীতকালে প্রায় তিন থেকে চার মাস সূর্যের আলো এই গ্রামে পৌঁছায় না। গ্রামবাসী নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সূর্যের উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত হন।
এই সমস্যা থেকে গ্রামবাসীকে উত্তোলনের জন্য তৎকালীন মেয়র পিয়েরে ফ্রাঙ্কো মিডালি এক উদ্যোগ নেন। তিনি এক আয়না স্থাপনের পরিকল্পনা করেন যার প্রতিফলন গ্রামকে আলোকিত করবে। মিডালি তাঁর স্থপতি বন্ধু গিয়েকোমো বোনজানি -কে তার পরিকল্পনার কথা জানান এবং বোনজানি -কে এই প্রকল্পে কাজ করার প্রস্তাব দেন।
মেয়রের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগে প্রায় পাঁচ বছর। ইতোমধ্যে ভিগানেলা গ্রাম এবং মেয়রের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম গ্রামে শীতকালে সূর্যের আলো এসে পড়ে এবং দিনটি গ্রামবাসী উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপন করে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয় প্রায় ১,০০,০০০ ইউরো। বড় বড় সংবাদ মাধ্যম এই খবর প্রচার করে।
গ্রাম থেকে প্রায় ১১০০ মিটার উপরে পাহাড়ের চূড়ায় ৮ বাই ৫ মিটার একটি স্টিলের পাত স্থাপন করা হয় যা আয়নার মত কাজ করে। প্রকৌশলগত কারণে পাতটি সূর্যের সাথে আবর্তন করে। গ্রামের চার্চ স্কয়ারে প্রায় ৩০০ বর্গফুট জায়গায় প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার জন্য আলো প্রতিফলিত করে থাকে এই আয়নাটি।
মিডালি বলেন, “এই প্রকল্পের পিছনে বৈজ্ঞানিক কোনো কারণ ছিল না,শুধু মানবিক কারণ ছিল।”
গ্রামের মানুষ শীতকালে কাজের শেষে সোজা বাড়ি চলে যেত কিন্তু এখন বাইরে সহজে চলাফেরা করতে পারে। গ্রামবাসীরা জানায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ত অনেক দিন রোদের দেখা না পাওয়ায় কিন্তু এখন তা কমেছে অনেকাংশে। এলাকায় চুরি ছিনতাই এবং অপকর্মের হার কমেছে আলো আসায়। এই প্রতিফলিত আলো হয়ত সূর্যের আলোর মত প্রখর না কিন্তু এই আলোতে তাদের অনেক দিনের আশা পূরণ হয়েছে।
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান ভিগানেলা। এই গ্রামে রয়েছে শত বছরের পুরনো বাড়িঘর। ইতালির মিলানে শহর থেকে মাত্র ১৩৩ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই গ্রামে লোকসংখ্যা কম হওয়ার কারণ এই গ্রামের অবস্থান,এবং পাহাড়ে ঘেরা হওয়ার কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা বা জরুরি সেবা গ্রহণ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
আল্পস পর্বতমালার কিছু অংশ এই অঞ্চলে পড়েছে এবং অনেক দর্শনার্থী আকর্ষণ করে এই অঞ্চল। এই আয়না স্থাপনের পর থেকে পর্যটক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এই গ্রামে। এছাড়াও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা অফার এর মাধ্যমে দর্শনার্থী আকর্ষণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে এই এলাকার প্রশাসন। ইটালিয়ান চলচিত্র “lo Specchio” চিত্র ধারণ করা হয়েছে এই গ্রামেই, যা এই আয়নাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে।
আয়নাটি শীতকালে সূর্যের সাথে প্রদক্ষিণ করে এবং আলো প্রতিফলিত করতে থাকে। শীতকালে আলোর কারণে অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এ এসেছে বিপুল পরিবর্তন। এই স্টিলের পাতটি বর্তমানে আরো উন্নত হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তির সংযোজনের জন্য। ১৭ বছর পরেও সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে এই আয়না। গ্রামের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে আমূল পরিবর্তন এনেছে এই সংযোজন, মেয়র মিডালি তাঁর নাম অমর করলেন এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
নরওয়ের একটি শহরেও একই পদ্ধতিতে ছয় মাস আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ২০১৩ সালে, সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে তিনটি আয়নার। খুব সহজ কিন্তু যুগান্তকরী এই উদ্ভাবনে পথ নির্দেশক হয়ে থাকবে ভিগানেলার এই “নিজস্ব সূর্য”
এরকম আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নুসরাত জাহান সোনিয়া
ইন্টার্ন,
কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE