মার্শাল আর্টের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন কিংবা বলা যায় কিংবদন্তী ব্রুস লি যিনি একজন চীনা মার্শাল আর্ট শিল্পী, তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও অনেকেই মার্শাল আর্ট দেখে থাকবেন।
এই মার্শাল আর্টের মাধ্যমে নিজের সেরাটা দিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত “Vatara Taekwon-Do Association” মাধ্যমে নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন জহুরা আক্তার মিম। আজকে সেই জাতীয় মার্শাল আর্ট খেলোয়াড় জহুরা আক্তার মিম, YSSE এর সৌজন্য সাক্ষাৎকারে আমাদের সাথে যুক্ত আছেন। আজ সাক্ষাৎকারের ২য় পর্বে আমরা তার সম্পর্কে ও তার কাজের ব্যাপারে বিস্তারিত জানবো।
YSSE: কোন জিনিস আপনার Martial Arts School- “Vatara Taekwon-Do Association” অন্য সকল উদ্যোগ থেকে আলাদা করে বলে আপনার মনে হয়?
যদি অন্যান্য মার্শাল আর্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনা করি তাহলে বলবো আমাদের শিক্ষার্থী শুধু মেয়ে এবং এখানে ইনসট্রাক্টর থেকে স্টাফ সবাই মেয়ে। মেয়েরা তাই নিরাপদ অনুভব করে। প্রতিমাসে একবার সেলফ ডিফেন্স এর ক্লাস নিয়ে থাকি। এছাড়াও স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলো শেয়ার করে, তা শুনে থাকি এবং মানসিকভাবে সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করি। আমরা মোটিভেশনাল এবং কাউন্সিলিং একটা ক্লাস থাকে সেখানে এটা করে থাকি। যার ফলে শিক্ষার্থীর কাজে উৎসাহ পায়। আমরা ছোটখাটো ট্রীপ দিয়ে থাকি। যেখানে শিক্ষার্থীদের বলে থাকি আশেপাশের জায়গায় পর্যবেক্ষণ করতে। যা তাদের ব্রেন ডেভেলপমেন্টে সাহায্য করে। শুধুমাত্র আত্নরক্ষার দিক থেকেও নয় অন্যান্য দিক থেকেও আমার প্রতীষ্ঠান ভিন্ন। তাই শিক্ষার্থীরা যেন অনুভব করে যে এখানে ভিন্নভাবে পরিচালনা করা হয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য পুরস্কার দিয়ে থাকি এবং ভলান্টিয়ার ইনসট্রাক্টর যারা আমার আসতে দেরি হলে ক্লাস মেইনটেইন করে, কন্ট্রোল করে। এই সবকিছুর জন্য তাদের পুরস্কার প্রাপ্য, যার মাধ্যমে তারা কাজের অনুপ্রেরণা বাড়ে। এই জিনিসগুলো আমার প্রতিষ্ঠান করে থাকে।
YSSE: আপনার এই কাজের জন্য যদি কোনো স্লোগান লিখতে বলা হয় সেটি কী হবে?
“আত্নরক্ষায় কৌশল জানা থাকলে আমাদের আত্নবিশ্বাস বেড়ে ওঠে”
এই আত্নবিশ্বাস শুধু নিজেকে রক্ষা করার আত্নবিশ্বাসই নয় বরং সকল পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলানোর আত্নবিশ্বাস।
YSSE: মার্শাল আর্টের মাধ্যমে আপনার একাডেমিক বা ব্যক্তিগত কোন প্রভাব পরেছে?
মার্শাল আর্টের মাধ্যমে আমার একাডেমিক বা ব্যক্তিগত ভাবে পজিটিভ প্রভাব পরেছে। অনেকে এটা ভালোভাবে নিচ্ছেনা, সেটা থাকবেই। এটাকে আমি নেগেটিভ বলবো না। অনেকে দেখা যায় এই ব্যাপারগুলোতে উপহাসের শিকার হয়। কিন্তু আমার চার-পাঁচ বছরে আমি উপহাসের শিকার হয়নি বা আমার কান পর্যন্ত আসেনি। যারা আমার কাছে এসেছে, কাজ করেছে, পরিবার এবং আশেপাশের পরিচিত মানুষ সবাই এটাকে ভালোভাবে নিয়েছি। ২০২০ সাল পর্যন্ত আমি রাস্তা পার হতে পারতাম না। এখন আমার বয়স ২৫। আমার বাবা আমাকে রাস্তা পার করে দিতো। এরকম আমার সাথে তিন-চারজন বান্ধবী থাকতো, তারা আমাকে রাস্তা পার করে দিতো। এরপর যখন আমি মার্শাল আর্ট শিখি, শিখার পর আমার মাঝে আত্নবিশ্বাস আসে। এখন আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারি যেকোনো পরিস্থিতিতে। এইযে রাস্তা পার হওয়া ব্যাপারটা এটাও অটোম্যাটিক্যালি নিজের আত্নবিশ্বাসের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও আমি পাবলিক স্পিকিং, প্রেজেন্টেশনে দুর্বল ছিলাম। আমার পছন্দের বিষয় থাকলেও আমি ঠিকমতো বলতে পারতাম না। আমার আত্নবিশ্বাস লেভেল বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন অটোম্যাটিক্যালি আমি সবকিছুতে আত্নবিশ্বাসের সাথে কাজ করতে পারি। আমি ১৫০০ শিক্ষার্থী তৈরি করেছি। এরমধ্যে অনেকে ন্যাশনালও খেলেছে। এছাড়াও গোল্ড, ব্রোঞ্জ, সিলভার মেডেল ও পেয়েছে। আবার অনেকে শুধু নিজেকে রক্ষার জন্যই নয় বরং অন্যান্য ভাবে কাজে লাগাচ্ছে। তাই আমার এই আত্নবিশ্বাস যেভাবে বেড়েছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের আত্মরক্ষামূলক কৌশল ছাড়াও বিভিন্ন মোটিভেশোনের মাধ্যমে তাদের আত্নবিশ্বাস বৃদ্ধি করা হয়।
YSSE: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
আমি পেছনে ফিরে তাকাতে চাইনা। আমার চেষ্টা থাকবে সামনে এগিয়ে যাওয়া। যেহেতু মেয়েদের নিয়ে কাজ করছি এটা চলমান থাকবে। আমার একাডেমির হয়ে আমি অন্য দেশে বিশ্ব চ্যাম্পীয়নশীপে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। তাই ভবিষ্যতে আমার চেষ্টা থাকবে একাডেমি থেকে আমার শিক্ষার্থীদের থেকে জেনো একটি টিম বিশ্ব চ্যাম্পীয়নশীপে যায় এবং রেজাল্ট নিয়ে আসে যা বাংলাদেশের জন্য গর্ব। এটা আমার একাডেমির জন্য পরিকল্পনায় আছে।
আমি ৪টি শাখাতে মার্শাল আর্ট শিখাই, মিরপুর, ভাটারা, উত্তরা, আগারগাঁও। আমি যদি ৪টি শাখা চালাতে পারি তাহলে আমার যে শিক্ষার্থী থাকবে তাদের মধ্যে যাদের ব্লাক বেল্ট থাকবে, যদি ৫০ জন শিক্ষার্থী এরকম ৪টি করে শাখায় মার্শাল আর্ট শিখায় তাহলে ২০০টা শাখা হয়ে যাবে। এভাবে ঢাকার ভিতরে এবং বাহিরে অনেক মার্শাল আর্টের শাখা তৈরি হবে। এতে করে যারা দূরে গিয়ে শিখতে অস্বস্তি অনুভব করে, তাঁরা তখন শিখার জায়গা পাবে। তাহলে আমি আমার কাজটাকে সফল মনে করবো।
এছাড়াও আমার ইচ্ছে আছে ঢাকার বাহিরে জেলা গুলোতে মার্শাল আর্ট শিখাবো, প্রতিদিন তো যাওয়া আসা হবেনা। তাই আমি মাসে ২ দিন একটি জেলায় যাবো সেখানে মেয়েদের মার্শাল আর্টের ট্রেনিং দিবো। এভাবে যদি মনে হয় যে তাদের ২ দিনে পূরণ হচ্ছেনা, তাহলে ২ মাসে ২ দিন রাখবো। এখানে প্রশ্ন হতে পারে ২ দিনে নিজের আত্নবিশ্বাস বাড়ানো, আত্নরক্ষা করা কি আসলেই সম্ভব? জি আসলেই সম্ভব। যেহেতু আমি প্রতিদিন যাবো না, তাই ২ দিনে সেলফ ডিফেন্স ৫০-৬০ টা ট্রিকস এর মাধ্যমে ট্রেনিং দিবো। এই ট্রিকস গুলো আমাদের প্র্যাকটিক্যাল জীবনে সাহায্য করে। এছাড়াও মোটিভেশান দিকটাও থাকবে। কারণ মানুষ যখন বিষন্ন থাকে তখন অন্য কারো কাছ থেকে ইতিবাচক ভাইভ পায় তখন সে ইতিবাচক ভাবনা করার মানসিকতা রাখে।
YSSE: সবার উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
আমি বলবো, যারা মার্শাল আর্ট শিখতে আগ্রহী তারা আশেপাশে একাডেমি আছে কিনা খোঁজ নেয়া, এডমিশন নেওয়ার আগে নিরাপত্তা ও যাচাই বাছাই করা। পূর্বের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে নিতে পারে। এছাড়াও মেয়েদের ক্ষেত্রে যদি মেয়ে ইনসট্রাক্টরের মাধ্যমে শিখতে চায় সে ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয়া।
সমাজের জন্য আমার বার্তা থাকবে, একজন মেয়ে ঘরে বা বাইরে কাজ করে। এখানে তাঁর নিজস্ব কিছু শখ থাকতে পারে। আমার মার্শাল আর্ট শিখা এটা প্যাশন থেকে নয় বরং শখ থেকেই শেখা। এটা ভালোলাগা থেকে শেখা। তবে এখন প্যাশন হয়ে গেছে। এরকম অনেক মানুষ আছে যারা শখগুলোকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু করতে পারে। যেমন: আর্ট, স্কেচ, ক্রাফট, রান্না, ফটোগ্রাফি এগুলো আমার শখ এবং করতে পছন্দ করি। এছাড়াও গ্রাফিক্স কাজ জানতাম, বিক্রি ও হয়েছে। অনেক সুন্দর ছবি এডিট করতে পারি যেহেতু গ্রাফিক্স কাজ জানি। আবার, সংসার ও করি। MARKS Dessert Queen কম্পিটিশন হলো আমি আঞ্চলিক পর্যায়ে চতুর্থ হয়েছিলাম । সবকিছু মিলিয়ে আমার অনেক শখ আছে। আমার একটা কাজ ভালো না লাগলে আমি অন্যটা করি যাতে আমি বিষন্নতা অনুভব না করি। সবকিছু মিলিয়ে আমরা মানুষরা চাইলেই মাল্টিটাস্কিং করতে পারি। এরকম অনেকের বিভিন্ন শখ থাকতে পারে। অবশ্যই সে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার উৎস পাবে। একটা মানুষ চাইলেই অনেক কিছু করতে পারে। তাই আমরা চাইলেই আমাদের শখগুলোকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু করতে পারি।
ধন্যবাদ সবাইকে।
ফেসবুক: https://www.facebook.com/mithilamimi.3190?mibextid=ZbWKwL
ফেসবুকপেজ: https://www.facebook.com/profile.php?id=100071914804769&mibextid=ZbWKwL
লেখক :
তৌহিদা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
Youth School for Social Entrepreneurs (YSSE)