যদি একটা কাঁথা বোনা যায়, যেখানে প্রতিটি সুতা এক একটি ভাষার প্রতীক হয়, কতটাই না ভালো লাগবে সেই কাঁথার প্রানবন্ত রঙের ছোঁড়াছুঁড়ি? কিন্তু যদি ভাষাই থাকে হাতে গোণা কয়েকটি মাত্র; তাহলে কাঁথাটা হয়ে যাবে মলিন এবং নিরস। কাঁথার রঙিন আবেশের মতোই মানব জাতি। এদিকে আবার প্রতিটিভাষা হারানোর সাথে সাথে যদি তার সুতাটাও ছিড়ে যায়, তবে কাঁথার কি করুন দসা হবে ভেবে দেখেছেন কি? ঠিক তেমনটাই হবে মানব কুলের সাথে। প্রাণোচ্ছল সব সংস্কৃতি বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে চলে আসবে একঘেয়ে একটা “মনোসংস্কৃতি”। প্রজন্মের পর প্রজন্মগুলোতে চলে যাওয়া গল্পগুলি অদৃশ্য হয়ে গিয়ে রেখে যাবে শুধু বোঝার শূন্যতা। এমনাবস্থায় ইতিহাস তার কন্ঠ হারিয়ে ফেলবে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথের বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্যবশত, এটাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ যদি আমরা আমদের ভাষা, আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তি স্তম্ভ, হারিয়ে ফেলি।
ভাষা কেবল একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি একটি জাতির আত্মা, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং পরিচয় ধারক ও বাহক। এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের হাসি এবং তাদের সংগ্রামের প্রতিনিধি বহন করে। মাতৃভাষা আমাদের বর্তমানের গল্পগুলি ফিসফিস করে বলে এবং এঁকে যায় আমাদের ভবিষ্যতের সপ্নগুলিকে। ভাষার মাধ্যমেই আমরা বিশ্বকে বুঝি এবং নিজেদেরকে তাদের সামনে আসলরুপে প্রকাশ করি।
অতএব, প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পালিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্যই উদযাপন করি না, ভাষা এবং জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে গভীর সংযোকেও স্বীকার করি। এই দিনে আমাদের সবার উচিৎ মাতৃভাষাকে রক্ষা করার সব উপায় অন্তর বের করে সব ভাষাকে উদযাপন করা।
বিশ্ব থেকে হারিয়ে যাওয়া কিছু ভাষা:
ইতিহাস জুড়ে এমন অনেক ভাষার খোঁজ মিলেছে যেগুলো সময়ের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চলুন জেনে নেই এমন উল্লেখযোগ্য কিছু ভাষা:
আক্কাদীয়: মেসোটেমিয়ার একটি প্রধান ভাষা যা প্রায় ৩০০০ বছর ধরে প্রচলিত ছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর আশে পাশে এর পতন ঘটে।
প্রাচীন মিশরীয়: মিশরের বিভিন্ন পিরামিড এবং মন্দির সজ্জিত ছিল হায়ারোগ্লিফিক দিয়ে, যেগুলোকে ধরে নেয়া হয় সেই আমলের ভাষা হিসেবে। চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই ভাষা ব্যবহারের বাইরে চলে যায়।
গথিক: পুরো ইউরোপজুড়ে জার্মানীয় গোষ্ঠীগুলোর মাঝে প্রচলিত ছিল এই ভাষাটি। ১৮তম শতাব্দীর দিকে অদৃশ্য হয়ে যায় এই ভাষাটি। কিন্তু যাওয়ার আগে রেখে যায় বাইবেলের এই অনন্য অনুবাদ।
মোচে: প্রাক – কলম্বিয়ান পেরুতে গড়ে উঠা মোচে সভ্যতার ভাষা। দুর্ভাগ্য বশত তাদের এই ভাষার বেশিরভাগই এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়নি, ফলে তাদের সঙ্কৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অনেক সল্প।
পিউনিক: ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য ও যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত পিউনিক ছিল প্রাচীন কার্থেজীয়দের ভাষা। রোমের কাছে তাদের পতনের পর পিউনিক ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং এক পর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমরা এ পর্যায়ে বুঝতে পেরেছি যে, উপ্রুক্ত ভাষাগুলো তাদের জাতিকে সাথে নিয়ে বিলীন হয়ে গিয়েছে। একটা জাতিকে এই বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে তার একটি বহুল প্রচলিত ভাষার প্রয়োজন।
আমাদের করনীয়:
ভাষাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের দায়িত্ব শুধু উদযাপনে থাকলে চলবে না। সত্যিকারের অঙ্গীকারের জন্য আমাদের মাতৃভাষার গুরত্ব স্বীকার করার পাশে পাশি কিছু কর্তব্য পালন করতে হবে। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি বিশ্বাস করি নিচের দেয়া পদক্ষেপগুলো নিতে পারলে আমরা আমাদের ভাষার মর্যাদা বজায় রাখতে পারবো:
মাতৃভাষাকে গ্রহণ করা: আমাদের ভাষাকে গর্বের সাথে বলতে হবে, পড়তে হবে এবং চর্চায় রাখতে হবে। শুধু নিজে না অন্যদেরকেও এই ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে হবে।
বিনোদনের মাধ্যম যেনো হয় মাতৃভাষা: আমাদেরকে আমাদের নিজেদের ভাষায় গল্প, গান ও সাহিত্য উপভোগ করতে হবে। এর জন্য বেশি বেশি করে মাতৃভাষায় সুন্দর ও উপভোগ্য কলা তৈরি করতে হবে।
পরিবর্তনের জন্য লড়াই করুন: বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে আমরা আমাদের ভাষার প্রতীক হতে পারি। অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, রালি, সভার মাধ্যমে আমরা এই কর্মে সাফল্য অর্জন করতে পারি।
অবদান রাখুন: রেকর্ডিং, অনলাইন অভিধান এবং লিখিত উপকরণের মাধ্যমে নিজনিজ ভাষাকে সংগ্রহ করুন। শিল্প ও সাহিত্য রচনা করুন যা আপনার ভাষার সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে পড়ে।
আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে যে, ছোট থেকে ছোট কর্মও অনেক বড় অবদান রাখে। ব্যাক্তিগত পছন্দও করতে পারে অনেক বড় একটি প্রভাব। চলুন, এই একুশে ফেব্রু়ারিতেই শুরু করে দেই আমাদের ভাষাকে সংগ্রহ করার মহান প্রকল্প।
এরকম আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন।
লেখিকা
রিফাহ্ জাকিয়াহ্
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট।
YSSE