সন্ধ্যা,দিন-রাত্রির সন্ধিক্ষণ। প্রকৃতির নিয়মেই সূর্যের আলোর তীব্রতা ক্রমশ প্রশমিত হয়ে গোধূলির হাত ধরে নামে সন্ধ্যা এবং দিন কে নিয়ে যায় রাতের নিঝুম গভীরতায়। সন্ধ্যার এ সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কবি ও সাহিত্যিকেরা লিখে গেছেন কতশত গল্প, কবিতা ও উপন্যাস। কিন্তু আমেরিকান সাহিত্যিক টি. এস. এলিয়ট যদি দক্ষিণ ভারতের কদরুপকা নামক গ্রামে যদি আসতেন তাহলে বোধহয় তার The Love Song of J. Alfred Prufrock কবিতায় বলতেন না “Let us go there you and I / Where the evening is spread out against the sky”। এটি এমন একটি গ্রাম যেখানে গ্রামবাসী কখনও সন্ধ্যার মুখ দেখেনি। এলিয়ট না যেতে পারলেও চলুন আমরা গ্রামটির ভেতরে অগ্রসর হয়ে রহস্য নিরুপন করি।
কদরুপকা দক্ষিণ ভারতের অন্যতম পুরাতন সবুজে ঘেরা, নির্মল ছোট একটি গ্রাম যেটি তেলেঙ্গানা রাজ্যের পেদাপল্লী জেলায় অবস্থিত। মানচিত্রে এর অবস্থান অক্ষাংশ ১৮° ৩৪’ ৫৯.৩৮৬৮” উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৭৯° ১৯’ ৪১.৯৩৭৬” পূর্ব। রাজস্থান থেকে চার থেকে পাচ ঘন্টা দূরত্বে এটির অবস্থান। নিজাম শাসনামলে গ্রামটির নাম ছিলো পদলাপকা, পরবর্তীতে নাম বদলিয়ে রাখা হয় কদরুপকা। কদরুপকা কে ঘিরে অবস্থান করছে একাধিক পাহাড়। পাহাড়ের মাঝে অবস্থান করার কারণে গ্রীষ্মকালে কদরুপকার তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়। গ্রামের মানুষজন তেলেগু ভাষায় তাদের ভাবের আদান প্রদান করে থাকেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এমন সাধারণ একটি গ্রামে কী এমন আছে যার কারণে এখানে কখনও সন্ধ্যা হয় না? উত্তর পাওয়া যাবে কদরুপকাকে ঘিরে যে পাহাড়গুলি রয়েছে তাদের বিশালতার কাছে। কদরুপকা এর চারদিকে চারটি পাহাড় অবস্থিত- গ্রামটির পূর্বে রয়েছে গোলা গুট্টা, পশ্চিমে রঙ্গনায়াকূলা গুট্টা, দক্ষিণে পামুবান্দা গুট্টা এবং উত্তরে নাম্বুলদ্রী স্বামী গুট্টা পাহাড়। এই পাহাড়গুলোই মূলত সময়, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে প্রভাব ফেলে। ছোটবেলায় পড়া চিরন্তন সত্যের মত যেভাবে সূর্্য পূর্ব দিকে ওঠে ও পশ্চিম দিকে অস্ত যায়, সেভাবে সূর্যাস্তের সময় গোল গুট্টা পাহাড় দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় এবং সূর্যের আলো কে বাধা দেয়। আলো বাধাগ্রস্ত হওয়ার জন্য পৌছাতে দেরী হওয়ায় স্বাভাবিক সময়ের থেকে একঘন্টা পরে আলো পৌছায়। অনুরূপভাবে, সূর্য যখন পশ্চিমে অস্ত যায়, পশ্চিমে অবস্থিত রঙ্গনায়াকূলা গুট্টা পাহাড় একে আবৃত রাখে, ফলে দ্রুত অন্ধকার নেমে আসে। কদরুপকা গ্রামে এ কারনে বিকাল তিনটা থেকে চারটার মধ্য অন্ধকার নেমে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই অনন্য ভৌগলিক অবস্থান, আলোর প্রতিফলন আর আলোর প্রতিসরণ এর জন্য এরকম অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত সকাল, দুপুর/বিকাল, সন্ধ্যা ও রাত নিয়ে একটি দিন হয়ে থাকে। কিন্তু এই যে কদরুপকা তে সকাল, বিকাল ও রাত হয়, একটি ভাগ কিন্তু অদেখা রয়ে যায়। এজন্য কদরুপকা কে স্থানীয়রা “মদু জমুলা কদরুপকা” ডাকে। যার অর্থ হল তিন ভাগ কদরুপকা।
কদরুপকাতে এই সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে দিনের আলো অন্ধকারের যে খেলা চলে, এর প্রভাব গ্রামটির সাধারণ মানুষের জীবনধারা কে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। যেহেতু খুব দ্রুত ই দিনের আলো ফুরিয়ে যায়, গ্রামের মানুষেরা বিকাল তিনটা থেকে চারটার মধ্য তাদের সারাদিন এর কাজকর্ম শেষ করে ফেলে। বিকাল চারটার মধ্য গ্রামের প্রতিটি ঘরবাড়ি, দোকানপাট এবং রাস্তা বাতিতে আলোকিত হয়ে পড়ে। গ্রামবাসীও প্রকৃতির এই লীলাখেলার সাথে মানিয়ে নিয়েছে। তারা সকালে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে- সকাল দ্রুত হবে, এই ব্যস্ততা না থাকায়। কদরুপকার সবকিছুর মত ঘুমের সময়সূচীও গ্রামবাসীদের ভিন্ন। দিনে কাজ করার জন্য সময় কম পাওয়ায় তারা সূযার্স্তের পর বেশ খানিক সময় ধরে কাজ করে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘুমোতে যেতে তাদের সাধারণ মানুষ থেকে সময় বেশি লাগে।
কদরুপকার এই অনন্য সুন্দর সবুজ, পাহাড়ে ঘেরা নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যের জন্য পর্যটন স্থান হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে। প্রতিবছর বহু পর্যটক কদরুপকায় পাড়ি জমান এই সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত নিজ চোখে অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য। সন্ধ্যাবেলা চায়ের কাপে চুমুকের সাথে বই পড়ার জন্য না হোক, প্রকৃতির এই অনবদ্য বৈশিষ্ট্যের স্বাদ নেওয়ার জন্য কদরুপকায় ভ্রমণ করা যেতে ই পারে.
লেখক
নাজমুস শাকিব জিতু
Intern,Content Writing Department