পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় ১৫ টি ভাষা

 

পৃথিবীর মানুষ বর্তমানে ঠিক কতটি ভাষায় কথা বলে? জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্ কো বলছে, সাত হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভাষা এই শতাব্দী শেষ হতে হতে চিরতরে হারিয়ে যাবে।ইউনেস্কোর মতে, প্রতি ১৪ দিনে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি  করে ভাষা।

 

একটি ভাষার মৃত্যু মানে তার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংস্কৃতি, প্রথা এবং আরও অনেক কিছুর। নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভল্যুশন সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে প্রায় দেড় হাজার ভাষা। এই ভাষাগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় আছে। চলুন জেনে নেয়া যাক এমন ১৫ টি ভাষা সম্বন্ধে যারা বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

 

রেসিগারো

বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর অন্যতম বিপন্ন একটি ভাষা হচ্ছে রেসিগারো যা একটি আমাজনীয় ভাষা। এ ভাষায় কথা বলতেন রোসা আন্দ্রেদ ওকাগান। ২০১৬ সালে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান তিনি। এখন তাঁর ভাই পাবলো এই ভাষায় কথা বলেন।

 

ছুলিম

ছুলিম তুর্কি অঞ্চলের ভাষা। রাশিয়ার ২০১০ সালের একটি আদমশুমারি থেকে জানা যায়, এ ভাষায় এখন মাত্র ৪৪ জন মানুষ কথা বলতে পারেন। তাঁদের বেশির ভাগই বাস করেন সাইবেরিয়ার গ্রামগুলোতে।  ১৯৫৯ সালে এই ভাষাভাষী মানুষকে সরকার নৃগোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে তাঁরা আবার স্বতন্ত্র নৃগোষ্ঠীর মর্যাদা ফিরে পান। 

 

পাটউইন

পাটউইন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার নেটিভ আমেরিকানদের কথ্য ভাষা। ২০১১ সালের এক জরিপ থেকে জানা যায়, ওই ভাষায় কথা বলতে পারা একজন ব্যক্তি আর অবশিষ্ট রয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে ভাষাটি শেখার চেষ্টা করছেন অন্যরা। তবে একটি আশাব্যঞ্জক ব্যাপার হচ্ছে, ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা হিসেবে পাটউইন ভাষা শেখার ক্লাস চালু করেছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। 

 

আইনু

জাপানের হোক্কাইদো দ্বীপের আদিবাসীরা আইনু ভাষায় কথা বলতেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে আইন হয়েছিল এ ভাষা ও ঐতিহ্যকে নিষিদ্ধ করার জন্য। এ জন্য বেশিরভাগ আদিবাসীরা জাপানি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে জাপানি ভাষা চর্চা শুরু করে। এরপরও কেউ কেউ ছিলেন যারা নিজেদের মাতৃভাষার চর্চা চালিয়ে গিয়েছেন। ১৯৮০-এর দশকে ১৫ জনকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, যাঁরা আইনু ভাষায় কথা বলতেন। তাঁদের কাছ থেকে অন্যরা এখন শিখে নিচ্ছেন এ ভাষা। 

 

মুদবুরা

অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীরা এ ভাষায় কথা বলেন। অস্ট্রেলিয়ার ২০০৬ সালের আদমশুমারি বলছে, ওই এলাকায় ৪৭ জন মুদবুরা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তবে ২০১৬ সালের আরেক জরিপ থেকে জানা যায়, সংখ্যাটি ৯২ জনে উন্নীত হয়েছে।

 

চামিকুরো

পেরুতে বসবাসকারী একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম চামিকুরো। তাঁদের ভাষার নামও এটি। তবে সম্প্রদায়টি স্প্যানিশে স্থানান্তরিত হওয়ায় কোনো শিশুই এ ভাষায় বলতে পারত না।  ২০০৪ সালে সেখানে মাত্র দুজন মানুষ এই ভাষায় কথা বলতে পারতেন। পরে সেখানে আরও ৮ জনকে খুঁজে পাওয়া যায় যাঁরা চামিকুরো ভাষায় কথা বলেন। 

 

ভোদ

এই ভাষাটির আরও কয়েকটি নাম রয়েছে। যেমন—ভোতিক, ভোত, ভোতিয়ান ও ভোতিশ। এই ভাষাভাষী মানুষকে ১৯৪৩ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফিনল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়। এখনো গুটিকয়েক মানুষ যাঁরা এই ভাষায় কথা বলেন, তাঁরা রাশিয়া ও এস্তোনিয়া সীমান্তে বাস করেন। ২০১০ সালে ৬৮ জন স্থানীয় মানুষ ভোদ ভাষায় কথা বলতেন। পরে ২০১৭ সালে জানা যায়, সেখানে এমন আর মাত্র আটজন অবশিষ্ট রয়েছেন। 

 

চেমেহুয়েভি

চেমেহুয়েভি ভাষাটির উদ্ভব যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমে মোহাভে মরুভূমিতে হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

ইউরোপীয়রা আমেরিকায় আসার আগে ৫০০ থেকে ৮০০ নেটিভ আমেরিকান চেমেহুয়েভি ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু এখন এই ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা মাত্র ২৪। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার কলোরাডোতে ৩-৫ জন মানুষকে পাওয়া গিয়েছিল, যাঁরা চেমেহুয়েভি ভাষায় কথা বলতেন। ভাষাটি বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

 

আচজ জুয়ায়

বলিভিয়ার কয়েকটি গ্রামে এখনো কিছু মানুষ পাওয়া যায়, যাঁরা আচজ জুয়ায় ভাষায় কথা বলে। সাধারণত পরিবারের সদস্যরাই পরের প্রজন্মকে এই ভাষা শেখায়। তবে ব্যাপকভাবে এই ভাষার চর্চা না থাকায় ঠিক কতজন মানুষ এখন ভাষাটি চর্চা করেন, তা জানা যায় না। ভাষা বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, কমপক্ষে ২০০ মানুষ এখনো আচজ জুয়ায় কথা বলেন। 

 

 

পাওনি

যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় পাওনি জাতির অন্তত তিন হাজার মানুষ বাস করলেও তাঁদের মধ্যে ১০ জনেরও কম মানুষ পাওনি ভাষায় কথা বলেন। স্থানীয়ভাবে পাঠ্যপুস্তকে এ ভাষা লিপিবদ্ধ করে ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি অন্যতম একটি বিপন্ন ভাষা।

 

ডানসার

ডানসার একটি প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ভাষা। ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া দ্বীপের কিছু মানুষ এখনো বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সময় ডানসার ভাষা ব্যবহার করেন। ২০১১ সালে মাত্র তিনজন মানুষ এই ভাষায় কথা বলতে পারতেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভাষাবিদেরা এ ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে নথিভুক্ত করেছেন। 

 

নগান গিকুরুনগুয়ার

অস্ট্রেলিয়ার কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠী নগান গিকুরুনগুয়ার ভাষায় কথা বলেন। ২০১৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, মাত্র ২৬ জন মানুষ এ ভাষায় কথা বলতে পারতেন। এই ভাষার পরিচর্যা না করলে অচিরেই ভাষাটি হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।

 

পাজেহ

পাজেহ ভাষায় কথা বলতে পারা তাইওয়ানের সর্বশেষ ব্যক্তি প্যান জিন-ইউ ২০১০ সালে মারা গেছেন। কিন্তু ভাষাটি এখনো হারিয়ে যায়নি পৃথিবী থেকে। কারণ মৃত্যুর আগে তিনি অন্তত ২০০ শিক্ষার্থীকে পাজেহ ভাষা শিখিয়েছিলেন। সেই শিক্ষার্থীরাই এখন ভাষাটিকে টিকিয়ে রেখেছেন।

 

জেদেক

 ‘জেদেক’ একটি মালয়েশীয় উপভাষা। অতি সম্প্রতি ভাষাবিদেরা এ ভাষার অস্তিত্ব জানতে পেরেছেন। সুইডেনের গবেষকেরা ২০২২ সালে জানতে পারেন, মালয় উপদ্বীপের একটি গ্রামে কিছু স্থানীয় বাসিন্দা এ ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষার বেশির ভাগ শব্দ জাহাই ভাষা থেকে উদ্ভূত। গবেষকেরা বলছেন, এখন ২৮০ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে, যারা জেদেক ভাষায় কথা বলেন।

 

আলাওয়া

অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা আলাওয়া ভাষায় কথা বলেন। ২০১৬ সালের আদমশুমারি থেকে জানা গেছে, মাত্র চারজন মানুষ এই ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাঁরা সবাই নারী। 

 

শুধু বিদেশি ভাষাই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে এমন নয়। বাংলাদেশের অনেক ভাষাও বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে ভাষা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল। সেই গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রচলিত ১৪টি ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, যার বেশিরভাগই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে ৪১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে, যারা নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। তারা জনসংখ্যার দিক থেকে খুব বেশি নয়, কিন্তু তাদের ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিও অনেক গুরুত্ব বহন করে। তাই আমাদের সকলের সচেতনতা এবং মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এসব ভাষাকে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে।

এরকম আরও অনেক ব্লগ পড়ার  জন্য ক্লিক করুন

লেখকঃ 

আতিয়া আলম নিসা 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE