পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূলে থাকা একটি দিন। কিন্তু এ উৎসবের তাৎপর্য বাংলার অর্থনীতিতে ও কম নয়।
বৈশাখের প্রথম দিন আয়োজন করা হয় হালখাতা উৎসব। ‘হাল’ শব্দটি ফারসি এবং সংস্কৃত ভাষায় পাওয়া যায়। ফার্সি তে এর অর্থ ‘নতুন’ এবং সংস্কৃততে ‘লাঙল’। হালখাতা অর্থ নতুন খাতা। আবার এটি লাঙ্গলের সাথেও সম্পৃক্ত কেনোনা প্রাচীন বাংলায় কৃষকরা লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ করে উপার্জন করতো এবং সে টাকা দিয়েই দেনা পাওনা পরিশোধ করতো। হালখাতা উৎসবের মাধ্যমে বিগত বছরের হিসাব বন্ধ করে তুলে রাখা হয় এবং নতুন বছর নতুন খাতায় দেনা পাওনার হিসাব শুরু হয়।
উৎপত্তির ইতিহাস
মুঘল সম্রাট আকবর এর শাসন আমলের আগ পর্যন্ত বাংলায় চন্দ্র বর্ষ এবং হিজরী সন প্রচলিত ছিল। এতে দেখা যেতো ফসল তোলার আগেই খাজনা পরিশোধ করতে হচ্ছে।সম্রাট আকবর এই অসুবিধার সমাধান করেন নতুন “ফসলি সন” প্রচলনের মাধ্যমে।পরে এটা পরিণত হয় বর্তমান “বাংলা সন” এ।
চৈত্রের শেষ দিন প্রজারা জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করতেন।বাংলা সনের প্রথম দিন তারা সুন্দর পোশাক পরে জমিদার দের সাথে দেখা করতেন।জমিদাররা তাদের মিষ্টি মুখ করাতেন যা তখন “পুণ্যাহ উৎসব” নামে পরিচিত ছিল।এটাই কালের পরিক্রমায় হালখাতা উৎসব পরিণত হয়।
কিভাবে উদযাপিত হয় হালখাতা উৎসব
হালখাতা উৎসব হয় বছরে দুইবার। পহেলা বৈশাখে এবং দুর্গা পূজার দশমীতে। উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয় প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে।ক্রেতাদের মধ্যে নিমন্ত্রণ পর্ত্র বিলি করা হয়।
চৈত্রের শেষ দিন দোকান পরিষ্কার করে রাখা হয়। ফুল, প্রদীপ, মরিচ বাতি দিয়ে দোকান সাজানো হয়। সোনারুপার পানি,গোলাপজল ছিটানা হয়, ধূপের ধোয়া দেয়া হয়। ক্রেতাদের জন্য মিষ্টি,সুগন্ধি পানের আয়োজন করা হয়। যদিও এ অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ব্যবসায়িক দেনা পাওনা নিষ্পত্তি কিন্তু তারা সে আলাপ থেকে বিরত থাকেন। কোনো অর্থনৈতিক বিবাদে জোড়ান না। হাসিমুখে পাওনা মেটান আর পরিবারের জন্য মিষ্টির বাক্স নিয়ে বাড়ি ফিরেন।
হিন্দু ব্যবসায়ীদের হালখাতা
সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা লক্ষী গনেশ পূজার মাধ্যমে এ উৎসবের সূচনা করেন। যে খাতায় নতুন বছর থেকে হিসাব রাখা হবে সেটা মন্দিরে আনা হয় এবং পুরোহিতের হাতে সিদুর দিয়ে সস্তিক চিহ্ন আঁকিয়ে নেয়া হয়।
এরপর খাতাটার উপর ধান,দূর্বা,তুলসী দেয়া হয় এবং প্রথম পাতায় লেখা হয় “শ্রী শ্রী গণেশয় নম”। এদিনে ক্রেতাদের লক্ষী মনে করে আপ্যায়ন করেন ব্যবসায়ীরা।
মুসলিম ব্যবসায়ীদের হালখাতা
এদিনে নতুন বছরের মঙ্গলের জন্য মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তাছাড়া নতুন খাতায় প্রথম পাতায় “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বা”এলাহি ভরসা” লিখে হিসাব শুরু করা হয়।
হালখাতা দেখতে কেমন?
লালসালু কাপড়ের মলাটে আবৃত আকৃতির কিছুটা লম্বাটে সাদা কাগজের তৈরি খাতা।এখাতার প্রতিটা পৃষ্ঠা চারটি সমান ভাগে ভাগ করা থাকে। বাম পাশে জমাআর হিসাব লেখা হয় আর ডান পাশে খরচের হিসাব লেখা হয়। এ খাতাকে “টালিখাতা”ও বলা হয়।
হাসান আলী লেন
মূলত পুরান ঢাকার ইসলামপুরের সৈয়দ হাসান আলী লেনে তৈরি হয় হালখাতা বা টালিখাতা। এখন থেকেই সারা দেশের ব্যবসায়ীরা পাইকারি দামে কিনে নিয়ে যায় এবং বিক্রি করে।এছাড়াও বাংলা বাজারের লোকনাথ বাবু এজেন্সিতে পাওয়া যায় এ বিশেষ খাতা।
হালখাতার বর্তমান হালচাল
বর্তমানে আর আগের মত আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে উদযাপিত হচ্ছেনা হালখাতা উৎসব।পুরান ঢাকার কিছু স্বর্ণ ব্যবসায়ী,চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় কিছু ব্যবসায়ী বাদে অনেকটা প্রতীকী অর্থেই টিকে আছে এ উৎসব।
হালখাতা কী পুণ্যাহ উৎসবের মত বিলুপ্ত হয়ে যাবে?
প্রাচীন বাংলার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। তখন মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতো বিনিময় প্রথা বা বকেয়া লেনদেন এর মাধ্যমে।কিন্তু এখন মানুষের হাতে নগদ টাকা আছে। তাছাড়াও আছে কার্ড,চেক,মোবাইল ব্যাংকিং এর মত অসংখ্য অর্থনৈতিক সুবিধা। এখন আর কেউ বাকিতে লেনদেন করে না,করলেও সেটা শীঘ্রই পরিশোধ করে ফেলে। এখানে বাৎসরিক দেনা পাওনা নিষ্পত্তির প্রশ্নই আসছে না। তাই ক্রেতাদের দিক থেকে এ প্রথার প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে।
ব্যবসায়ীরাও এখন আর আগের মতো খাতায় হিসাব রাখেন না।বড় সব দোকান, শোরুম এ দেখা যায় কম্পিউটারের মাধ্যমে হিসাব রাখা হচ্ছে। সেখানে কাগজের ব্যবহারই নেই, হিসাবের খাতা তো লাগছে না।
ছোট কিছু ব্যবসায়ীরা এখনো সনাতন নিয়মে হিসাব রাখেন ।কিন্তু সম্প্রতি কাগজের অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে তারও এখন হিমশিম খাচ্ছেন।
একটা সময় হালখাতা ছিল সবচে আধুনিকতম একটা পদক্ষেপ।এখন কম্পিউটারাজড হিসাব ব্যবস্থা, ই-ব্যাংকিং(অনলাইন ব্যাংকিং), মোবাইল ব্যাংকিং( বিকাশ,রকেট, উপায় আছে ) এর কল্যাণে সেটা কার্যকারিতা কমে আসছে।ভবিষ্যতে আরও নতুন প্রযুক্তি আসবে তখন বর্তমান লেনদেন ব্যবস্থা সেকেলে মনে হবে।
এমন আরো ব্লগ পড়তে চাইলে ক্লিক করুন
লেখিকা,
জান্নাতুল নাঈম সামিয়া
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE