সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা এই বাংলার নানান উৎসব, পার্বনে গ্রামীণ মেলা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১২ মাসে ১৩ পার্বণ রীতিকে আগলে ধরে গ্রাম বাংলায় চলমান উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন যা ফুটিয়ে তোলে গ্রামের সাধারণ জন-জীবনে আনন্দের প্রজ্জ্বলন।

বাংলার মেলার ইতিহাস

বাংলার মেলার ইতিহাস বহু পুরোনো। কবে কিভাবে শুরু হয়েছিল, তা সঠিক জানা যায় না কিন্তু লোক শ্রুতি থেকে ধারণা করা যায়। ৬ এপ্রিল ১৯৯৯ এ দেশ পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে আসে গ্রামীণ মেলার প্রচলণ মূলত জমিদারদের হাত ধরে কারণ তারা এর মাধ্যমে তাদের অধিক আয়ের ব্যাবস্থা করতেন। জমিদারদের পাশাপাশি লৌকিক উদ্যোগের কথাও জানা যায়। তবে এর পূর্বে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা এ বিষয়ে জরিপ চালায়। তাতে উঠে আসে মেলার সংখ্যা, প্রকৃতি, বৈচিত্র ইত্যাদি নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়। জরিপে উঠে আসে মেলার সংখ্যা প্রায় ১০০৫। আশ্রাফ সিদ্দিকী তার “লোকসাহিত্য” বইয়ে গ্রামীণ মেলার “জেলাওয়ারী” তালিকা প্রকাশ করেছেন।

মেলার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিকিকিনি করা ও সেই সাথে যুগের পরিক্রমায় শুরু হয় বিনোদনযাত্রার। সেক্ষেত্রে মেলার মূল উৎপত্তি “হাট” থেকে উদ্বুদ্ধ। সাধারণত মেলা গড়ে উঠে উৎসবকে কেন্দ্র করে, খোলা স্থানে যেমন খেলার মাঠ, মাজার, তীর্থস্থান, নদীর পাড় ইত্যাদি।

কালের সাক্ষী কিছু ঐতিহাসিক মেলা:

  • ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মাছের মেলা: মাছের মেলা বলতেই বোঝা যায় হরেক রকম মাছের এক বিশাল আয়োজন। মজার ব্যাপার হলো মাছের এরকম একটি মেলা বহুকাল ধরে হয়ে আসছে। এটা বগুড়া জেলার শহর হতে ১১ কিলোমিটার পূর্ব দিকে ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ নামক স্থানে প্রতিবছর বছর আয়োজিত হয়। সেই মেলার পেছনে একটি প্রচলিত কাহিনীও রয়েছে।
  • জামালপুরের জামাই মেলা: ভারত বিভক্তি রাত পর্যন্ত বারুনি স্নান উপলক্ষে চৈত্র মেলা বসতো। যাকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলমান সবাই উৎসবে মেতে উঠতো ভারত বিভক্তির পরে এই মেলা জামাই মেলা নাম ধারণ করে।
  • জসীম মেলা: এটি পল্লী কবি জসীমউদ্দীন স্মরণোৎসব মেলা। ফরিদপুর শহরের কাছেই কবির জন্মভিটা অম্বিকাপুরে প্রতি বছর এ মেলা বসে থাকে। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে পল্লীগীতি ও বিচার গানের আসর।
  • রাস মেলাঃ সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রতি বছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা রাতে অনুষ্ঠিত হয় রাসমেলা। অসংখ্য সনাতন ধর্মাবলম্বী অংশ নেন এই মেলায়। এছাড়াও দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় কান্তনগর কান্তজির মন্দির প্রাঙ্গনে মাসব্যাপী রাস মেলা হওয়ার কথা শোনা যায়।

মেলার বৈশিষ্ট্য

গ্রামীণ মেলা প্রাচীনকাল থেকেই শখের জিনিস থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের এক অনন্যক্ষেত্র। ইদ,পূজা,পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি উৎসবে মেলার জুড়ি নাই। সাধারাণত বিভিন্ন খাবার থেকে শুরু করে তৈজসপত্র,গহনার দোকান,কাপড় সহ মুড়ি, মুড়কি, বারো-ভাজা, বাতাসা, দানাদার, ঝালমুড়ি, আচার ইত্যাদি মুখোরকচক খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেন খাবারের দোকানিরা। মাটির, ব্রোঞ্জের, বিভিন্ন ধাতব গহনা থাকে নারীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাতের শাড়ি, লুংগি, গামছা থাকে বয়োজেষ্ঠদের আকর্ষণের বস্তু। শিশুদের যাবতীয় উতসাহ ও বায়না চলতে থাকে মাটির খেলনা কেনা নিয়ে। মাটির হাড়ি, কলস, কাসা-পিতলের তৈজসপত্র, কাঠের রান্নার সামগ্রী ইত্যাদি গৃহিণীদের মনে ঘিরে তৈরি করে বিশেষ আলোড়ন। মেলার বিশেষ আয়োজন হিসেবে থাকে বায়োস্কোপ, নাগোরদোলা, চরকা, লটারি ইত্যাদি। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, প্রয়োজন থেকে বিনোদন, সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় গ্রামীণ মেলা।

গ্রামীণ মেলার বর্তমান অবস্থা 

নগরায়ন, প্রযুক্তির ছোয়া ও পাশ্চাত্য আধুনিকতার ছোবলে গ্রামীণ মেলা হারিয়ে ফেলেছে সেই প্রাচীন বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য। গ্রাম বাংলায় ঘটা করে মেলার প্রচলন বিলুপ্ত প্রায়। তাতে আবার যোগ হয়েছে সার্কাস ও মোটর বাইক শো এর মত নানান আধুনিকতা। অপরদিকে প্লাস্টিক ও নানান সংকর ধাতুর আবর্তনে চাহিদা হারিয়েছে মাটির খেলনা ও আসবাবপত্র। মোবাইল ও ডিভাইসের যুগে নাগোরদলার মত বিনোদনগুলোর জন্য গ্রামের শিশুরা আর অপেক্ষা করেনা। উৎসব বিশেষ মেলার প্রচলন এখনো কিছুটা রয়েছে কিন্তু সেই ঐতিহ্য আর আনন্দের আর দেখা মেলে না।

করণীয় 

সরকারি নানান পৃষ্ঠপোষকতায় কামার, কুমার ও নানান শিল্পীগোষ্ঠীদের বিনিয়োগের মাধ্যে ব্যাবসায় লাভ সাধনের উদ্দেশ্য আবারো গ্রামীণ মেলার প্রচলন উজ্জীবিত করা সম্ভব।

 

এরকম আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

লেখক

কাজী সুরাইয়া ইভা

ইন্টার্ণ, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE