ড. মুহাম্মদ ইউনূস, একজন বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী, বিশ্বজুড়ে পরিচিত নাম। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, যা বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা চালু করেছে। এই ব্যাংকটি প্রমাণ করেছে যে, দরিদ্র মানুষেরাও সঠিক সুযোগ পেলে উন্নতি করতে পারে। কিন্তু এই সফলতার পরও, ড. ইউনূসকে বিভিন্ন আইনি চ্যালেঞ্জ এবং বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তার জীবন ও কাজের এই অংশটি আজকের ব্লগে আমরা আলোচনা করবো।

গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম

১৯৭৬ সালে, ড. ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন। তিনি অনুভব করলেন যে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থা কার্যকর নয়। এই উপলব্ধি থেকে, তিনি একটি নতুন ব্যাংকিং মডেল প্রস্তাব করেন, যা দরিদ্র মানুষদের ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার জন্য তৈরি।

এই মডেলটি এতটাই সফল হয়েছিল যে, ১৯৮৩ সালে এটি গ্রামীণ ব্যাংক নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাংকটি মূলত নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কাজ করে, এবং এটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে সফলভাবে কাজ করছে। ২০০৬ সালে, ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন, যা তার কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল।

বিরোধিতা ও আইনি চ্যালেঞ্জ

গ্রামীণ ব্যাংকের সফলতার পরও, ড. ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠতে থাকে। ২০১১ সালে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ড. ইউনূসের বয়সজনিত কারণে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। ড. ইউনূস আদালতের শরণাপন্ন হন এবং বিভিন্ন আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি এবং আইন লঙ্ঘনের অভিযোগও ওঠে। তবে তিনি সবসময় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে গেছেন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কাজকে অব্যাহত রাখার জন্য সংগ্রাম করেছেন।

ড. ইউনূসের এই আইনি লড়াই শুধু তার ব্যক্তিগত সম্মান রক্ষার জন্যই ছিল না, এটি ছিল মাইক্রোক্রেডিট ধারণার বিরুদ্ধে আনা সকল সন্দেহের মুখোমুখি হওয়ার একটি প্রচেষ্টা। তাঁর সমর্থকরা এই লড়াইকে গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই হিসেবেও দেখে। ইউনূসের প্রায় প্রতিটি আইনি পদক্ষেপই মিডিয়ার নজরে আসে, যা জনমনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনেকেই মনে করেন, তার বিরুদ্ধে এই সকল অভিযোগ আনা হয়েছিল তার কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য। এ সময় ইউনূসের প্রতি জনগণের সমর্থন আরও দৃঢ় হয় এবং তাঁর আদর্শের প্রতি আস্থা বাড়ে।

এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ড. ইউনূস তার লক্ষ্য থেকে সরে যাননি। তিনি বিশ্বাস করেন, মাইক্রোক্রেডিট কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মাধ্যম নয়, এটি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটি কার্যকর হাতিয়ার। তাঁর এই দৃঢ় মনোবল এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে বারবার আইনি প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সাহায্য করেছে। আজও, তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যকে ধরে রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রয়েছেন।

সমাজের প্রতিক্রিয়া

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো অনেকের কাছে বিস্ময়কর ছিল। একজন মানুষ যিনি সারা জীবন দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন, তার বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ উঠায় অনেকেই হতবাক হন। আন্তর্জাতিক মহলেও তার সমর্থনে আওয়াজ ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান ড. ইউনূসের পক্ষে কথা বলেন এবং তার কাজের স্বীকৃতি দেন।

মুক্তি ও বর্তমান পরিস্থিতি

ড. ইউনূস এখনো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন আইনি জটিলতার মুখোমুখি হলেও তিনি তার লক্ষ্যে অটল রয়েছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করলেই সমাজের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ড. মোহাম্মদ ইউনূস, অভিভাবকহীন বাংলাদেশের পাশে থেকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

মানবিকতা ও ড. ইউনূসের দর্শন

ড. ইউনূসের লড়াই শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনের গল্প নয়, এটি সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতারও প্রতিফলন। তিনি সবসময় বিশ্বাস করেন যে, দরিদ্র মানুষদের সুযোগ দিলে তারা নিজেরাই নিজেদের উন্নতির পথ খুঁজে নেবে। ড. ইউনূসের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, “দারিদ্র্য ইতিহাসের জাদুঘরে পাঠানোর সময় এসেছে।” এই কথা থেকেই বোঝা যায়, তিনি কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন দরিদ্রতাকে সমাজ থেকে নির্মূল করার জন্য। তার এই দর্শন শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক থেকে আদালত পর্যন্ত লড়াইয়ের গল্প আমাদের শেখায় যে, যে কোনো সংগ্রামের মুখে মানবিকতা এবং দৃঢ়তা থাকলে সেই সংগ্রাম সফল হয়। তিনি যে সংগ্রাম করেছেন, তা শুধু তার ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের অংশ। এই লড়াই থেকে আমরা শিখি, যতই বাধা আসুক না কেন, মানবতার সেবা করার সংকল্প অটুট রাখতে হবে। ড. ইউনূস আজও আমাদের জন্য একটি আদর্শ এবং অনুপ্রেরণা। তার লড়াইয়ের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সমাজের পরিবর্তন আনতে হলে নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে এবং কখনোই হার মানা যাবে না।

 

 এ ধরনের আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন

 

লেখক,

শারমিন আক্তার জয়া 

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE