প্রতি বছর ৮ই সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস আমাদের সামনে নতুন আলো জ্বালায়—”শিক্ষা শুধু জ্ঞান নয়, এটি সমাজের রূপান্তরের চাবিকাঠি।” এই দিনটি শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে সমতা প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে কাজ করে। সাক্ষরতা মানুষের জীবন বদলে দেয়, সংস্কৃতি এবং জাতির ভবিষ্যৎকে নতুনভাবে গড়ে তোলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথার মতো নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সাক্ষরতার লড়াই প্রমাণ করে, শিক্ষা সমাজ বদলের মূল অস্ত্র। আজ আমরা উদযাপন করি সেই শক্তি, যা সমতা ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রার পথপ্রদর্শক।আজকের দিনে, সাক্ষরতা ও সমতার মধ্যে গভীর সংযোগ কীভাবে আমাদের সমাজের বিভিন্ন দিকে প্রতিফলিত হচ্ছে, সেটিই তুলে ধরবো।
শিক্ষার শক্তি: সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার
“শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড”—এই প্রবাদ বাক্যটি কেবলমাত্র বর্ণমালা শেখার অর্থে নয়, বরং সমাজের গভীরে বিদ্যমান কুসংস্কার ও প্রথাকে পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সাক্ষরতা মানুষকে চিন্তা করতে, প্রশ্ন করতে এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার ক্ষমতা দেয়। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি কেবল নিজেকে আলোকিত করে না, বরং সমাজের উন্নয়নের জন্যও অমূল্য অবদান রাখে।
শিক্ষাই সমাজের নৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। “যেখানে শিক্ষা নেই, সেখানে মুক্তিও নেই”—এই ভাবনা থেকেই শিক্ষা মানুষকে বিভিন্ন কুসংস্কার ও প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উৎসাহিত করে। বিশ্বজুড়ে সাক্ষরতা আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন কুপ্রথা ও বৈষম্যের অবসান ঘটেছে। সতীদাহ প্রথা ও বাল্যবিবাহের মতো নিষ্ঠুর প্রথা শিক্ষার আলোতেই নির্মূল হয়েছে, যা সাক্ষরতার ক্ষমতাকে নতুন করে তুলে ধরে।
সাক্ষরতা: শুধু বই পড়া নয়, ভাবনার মুক্তি
সাক্ষরতা কেবল বই পড়া কিংবা লিখার ক্ষমতা অর্জন নয়, এটি একটি মানুষের চিন্তা-চেতনার বিস্তৃতিও। শিক্ষিত মানুষ সমাজের প্রচলিত নিয়ম ও প্রথাকে প্রশ্ন করতে শেখে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ অধিকার, সংস্কৃতি এবং নিজের ইতিহাস সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সুযোগ পায়। বাংলা ভাষায় সাক্ষরতা বিস্তারের মাধ্যমে মানুষ তাদের পরিচয় সম্পর্কে আরও সচেতন হয়েছে এবং তারা নিজেদের সমাজের উন্নতির জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পেরেছে।
সমতা প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার বৈচিত্র্যময় ভূমিকা
“শিক্ষা সেই শক্তি যা সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।” সমাজে সাক্ষরতা এবং শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, এটি সমতার ভিত্তিও শক্তিশালী করে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রসার সমাজের গভীরে সমতা আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যখন মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পায়, তখন শুধু তারা নিজেরাই নয়, সমাজের প্রতিটি স্তর উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় এই বৈচিত্র্য নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে।
সতীদাহ প্রথা: শিক্ষার আলোয় কুসংস্কারের অবসান
সতীদাহ প্রথা ছিল সমাজের নারীদের জন্য এক ভয়ানক অভিশাপ। “একটি জাতি যত বেশি শিক্ষিত, তত বেশি প্রগতিশীল”—রাজা রামমোহন রায়ের এই বিশ্বাসই সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে তার আন্দোলনের প্রেরণা ছিল। তার প্রচেষ্টায় প্রমাণিত হয় যে, সতীদাহ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয় এবং এটি নারীর প্রতি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তার শিক্ষা ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার কারণে ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার এই নিষ্ঠুর প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এটি ছিল শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে প্রগতির প্রথম বড় সাফল্য।
বাল্যবিবাহ: শিক্ষার মাধ্যমে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই
“অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারই সমাজের শত্রু”—এই ধারণাই প্রমাণিত হয় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে শিক্ষার লড়াইয়ে। বাল্যবিবাহ একটি কুপ্রথা যা মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। তবে, সাক্ষরতার প্রসার এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে শিক্ষিত পরিবারগুলো এখন বুঝতে পারছে যে, বাল্যবিবাহ শুধুমাত্র একটি ভুল প্রথা নয়, এটি তাদের মেয়েদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দেয়।
শিক্ষা শুধু মেয়েদের নয়, সমাজের পুরুষদের মধ্যেও সমতার ধারণা তৈরি করেছে। তারা এখন বুঝতে পারছে যে, মেয়েদের শিক্ষিত করা কেবল মানবাধিকার নয়, বরং পুরো সমাজের উন্নয়নের প্রধান শর্ত।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ
বিশ্বব্যাপী সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজে কুসংস্কার ও প্রথার অবসান ঘটছে। বাংলাদেশে শিক্ষা ও সাক্ষরতার উন্নয়ন নারীদের ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ইউনেস্কোর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। এই শিক্ষার প্রসার কেবল বাল্যবিবাহের মতো প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করেনি, বরং নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও সাক্ষরতার প্রসার একই ধরনের কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করেছে। “শিক্ষা সমাজের শত্রু নয়, তার রক্ষাকবচ”—এই উক্তির যথার্থতা প্রমাণিত হয় যখন শিক্ষার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ ও অন্যান্য প্রথা রোধ করা হয়।
সাক্ষরতা দিবসে আমাদের দায়িত্ব
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শিক্ষা এবং সমতা একে অপরের পরিপূরক। “যেখানে শিক্ষা নেই, সেখানে অধিকার নেই”—এই মর্মার্থে আমাদের উচিত শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করা। শুধু বিদ্যালয় কিংবা কলেজের গণ্ডিতেই নয়, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এবং পরিবারেও শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের সাক্ষরতা আন্দোলনের এই জয়যাত্রা প্রমাণ করে যে, শিক্ষা কেবল ব্যক্তি নয়, সমাজের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষার প্রসারই কুসংস্কার, বৈষম্য এবং সামাজিক অন্যায়কে প্রতিহত করতে সক্ষম।
“শিক্ষা মানবতার মুক্তি,” এবং এই মুক্তি পেতে হলে আমাদের উচিত আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে অঙ্গীকার করা যে, আমরা আমাদের সমাজে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবো এবং সমতার ভিত্তি স্থাপন করবো।
এ ধরনের আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক,
শারমিন আক্তার জয়া
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE