আপনি কি “কাগজের হাজার সারস’’ কাহিনি টি শুনেছেন? জাপানের লোককথা মতে মনে করা হতো, কেউ যদি কাগজ দিয়ে এক হাজার সারস তৈরি করতে পারে,তবে তার একটি বিশেষ ইচ্ছা পূরণ হবে। সাদাকো, একটি এগারো বছরের বালিকা, যার লিউকেমিয়া ধরা পড়ে। কারণ ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা পারমাণবিক বোমা হতে নি:সরণ হওয়া তেজস্ক্রিয়তা। সে যখন এ মরণব্যাধি তে ধুকছিলো,তখন সাদাকোর বন্ধু তাকে এই লোককথা নিয়ে জানায়। সাদাকো ১০০০ কাগজের সারস তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই আশায় যে, সে সুস্থ হবে। উপন্যাসে যদিও সাদাকো তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না তবে বাস্তবের সাদাকো প্রায় ১৪০০ এর বেশি কাগজের সারস তৈরি করেছিলো। এই হলো অরিগ্যামি শিল্পের সৌন্দর্য। 

ইতিহাস:

অরিগ্যামি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় প্রবেশের আগে আমাদের জানা উচিত এর প্রধান উপকরণ কাগজ নিয়ে। খ্রিস্টের জন্মের সময়কালে Cai Lun নামে একজন চীনা আদালত কর্মকর্তা প্যাপিরাস পাতার মতো কিছু উপকরণ ব্যবহার করে কাগজ তৈরি করেছিলেন,তাই তাকে কাগজের আবিস্কারক ও বলা হয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, পরবর্তীতে জাপানে তারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং কাগজ তৈরি করে। এই প্রক্রিয়া আরও উন্নতসাধন করে তারা তৈরি করে washi নামে আরেক বিশেষ কাগজ। এটি শুধু কার্যকরী ছিলো তা নয়, কাগজ না ভেঙেই এটিকে ভাজ করা যেতো। এই ওয়াশি কাগজ একটি অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় অরিগ্যামির। কিন্তু তারপরেও অরিগ্যামি নিয়ে ১৫০০ শতকের আগে পর্যন্ত কোনো পাকাপোক্ত নজির নেই। তবে প্রথম লিখিত প্রমাণ মেলে Ihara Saikuk নামে একজন কবির কবিতায় খ্রিস্টের জন্মের সময় ১৬৮০ এ, যেখানে তিনি অরিগ্যামি প্রজাতির কথা লিখেছিলেন। এছাড়া একেবারে প্রথম দিকের অরিগ্যামির দিকনির্দেশনা নিয়ে বই প্রকাশ হয় ১৭৯৭ এ। এই বই টি লিখেছিলেন জাপানিজ কবি এবং লেখক Akisato Rito এতে এ কথাই বলা যায়, অরিগ্যামির যাত্রা শুরু হয়েছিলো জাপানে। জাপানিজ Ori শব্দের অর্থ ভাজ করা আর Kami হলো কাগজ (পরে তা gami তে পরিবর্তন হয়)। জাপানে প্রায় প্রতিটি স্কুলেই বাচ্চাদের পাঠদানের সাথে অরিগ্যামি শিখানো হয়।

ব্যবহার:

হিয়ান(Heian period) যুগ থেকেই জাপানে অরিগ্যামির রেকর্ড পাওয়া যায় এবং এই যুগ কে জাপানের স্বর্ণযুগ বলা হয়। ঐ সময় কাগজ এক দুষ্প্রাপ্য পণ্য ছিলো এবং শুধুমাত্র বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাত শ্রেণিরাই কাগজ দিয়ে তৈরি অরিগ্যামি উপভোগ করতেন। জাপানের ঐতিহ্যে এই কাগজ শিল্প কে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় যেমন ধর্মীয় অনুষ্ঠান,বিবাহ অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে।  এটি বর্তমানে একটি বিনোদনমূলক কার্যকলাপ অনেকের কাছে। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি কোনো কাজে পূর্ণ মনোযোগী হওয়ার চর্চা করতে পারে। অরিগ্যামি তে প্রয়োজন হয় শান্ত ও মনোযোগী মস্তিষ্কের যা মানুষকে আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে শেখায়।

অরিগ্যামির বিচিত্র দিক:

একটি কাগজকে যদি ৭/৮ বার ভাজ করা হয় তাহলে এটি একটি স্টিল এর সমপরিমাণ অখণ্ডতা লাভ করে। যদি কেউ এই কাগজকে ২০ বারের অধিক ভাজ করতে সক্ষম হয়, তবে কাগজের যে ব্লকটি তৈরি হবে, তার উচ্চতা হবে প্রায় ১০ কি.মি। যা মাউন্ট এভারেস্ট এর উচ্চতা হতে বেশি! হিসেব করে দেখা হয়েছে, কোনো কাগজকে ৪২ বার ভাজ করলে তার উচ্চতা দাঁড়ায় প্রায় ৪৩৯৮০৪কি.মি, আর তা হলো আমাদের পৃথিবী ও চাঁদ এর মাঝের দূরত্ব! বোঝাই যাচ্ছে এটি শুধুমাত্র বাচ্চাদের খেলার সঙ্গী নয়,সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করলে এর মাধ্যমে অনেক জটিল ডিজাইন বের করে আনা সম্ভব। 

অরিগ্যামি- বিজ্ঞান ও শিল্প:

এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার জে.কে ইয়াং তার কর্ম পদ্ধতিতে অরিগ্যামি ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “যখন আমি প্রথম আমার রিসার্চ এর কাজে অরিগ্যামি ব্যবহারের চিন্তা করি, বিষয়টি আমি তত গুরুত্ব সহকারে ভাবিনি। কিন্তু অরিগ্যামি শুধুমাত্র বাচ্চাদের খেলার জিনিস নয়, এটি সুক্ষ নকশার নীতি ধারণ করে। এটা তখন আমাকে ভাবালো, যেসব উপকরণ আমাদের নাগালে রয়েছে, সেটি ব্যবহারের পরিবর্তে কেননা আমার নিজেরাই প্রয়োজনীয় উপকরণের নকশা তৈরি করা শুরু করি?” তিনি আরও জানান তার মহাকাশ সম্পর্কিত যন্ত্রের সুক্ষ কাজে প্রয়োজন এমন কিছু যেটি হালকা কিন্তু স্থায়িত্ব রয়েছে।এই আইডিয়া গুলো তিনি অরিগ্যামির মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি আরও বলেন, “আমি যখন একটি কাগজ দেখি, আমি কল্পনা করি একটি ভাজযোগ্য স্থানের গঠন (foldable space structures), মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং এই সম্ভাবনার পরিধি তার চেয়েও বেশি।” তিনি বলেন, “অরিগ্যামি শিল্প এবং বিজ্ঞান দুটোই একসাথে হতে পারে অথবা এটি এ দুটির কোনোটিই নয়। এটিই হলো অরিগ্যামির সৌন্দর্য।”

 

অরিগ্যামি হলো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার এমন এক ফল, যাতে বিজ্ঞান এবং শিল্পের যুগোৎপাত ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রতিনিয়ত এর নতুন নতুন গঠন, ডিজাইন ইত্যাদির পিছনে কাজ করছে। বাংলাদেশেও অরিগ্যামি শিল্প চর্চার গুরুত্ব সবার মাঝে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা উচিত। 

 

আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

লেখিকা 

ফারজানা বিনতে রহমান মীম

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE