আজও আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের কাছে “মানবাধিকার” শব্দটি যেন এক দূরবর্তী স্বপ্ন। বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এবং পিছিয়ে পড়া নারীরা আজও সমান শিক্ষা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি, এমনকি মৌলিক মানবাধিকারের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। তাদের স্বীকৃতি সমাজে নেই, তাদের মৌলিক চাহিদাগুলোও পূরণ হয় না। আর এভাবেই বৈষম্যের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে, যেখানে মানবতার আলো ছড়িয়ে পড়তে বাধা পায়।

ফলে মানবতার রংতুলি দিয়ে সমানাধিকারের ক্যানভাসে নতুন চিত্র আঁকা মানে কেবল অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম নয়; এটি মানবিক এক পৃথিবী গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থানের অগণিত বিভাজন যা অনেকের জীবনের সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে তুলছে, তা দূর করার দায়িত্ব আমাদের সবার। নেলসন ম্যান্ডেলা একবার বলেছিলেন, “To deny people their human rights are to challenge their very humanity.” এই মানবতার আলোকে জাগ্রত করা আমাদের কর্তব্য।

তবে, সমস্যার শিকড় আমাদের সমাজব্যবস্থার গভীরে নিবদ্ধ। পরিবার থেকে প্রশাসন, প্রতিটি স্তরে মানবাধিকার নিয়ে অস্পষ্টতা কাজ করে। বৈষম্যের শিকড়কে উপড়ে ফেলতে হলে প্রথমে চিন্তাভাবনার সংকীর্ণতাকে বদলাতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না মহাত্মা গান্ধীর সেই বিখ্যাত উক্তি – You may never know what results come of your actions, but if you do nothing, there will be no result.”

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পরিবর্তন সম্ভব। আর এই পরিবর্তনের শুরু হতে পারে আমাদের প্রতিদিনের ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকে। সেই ছোট্ট পদক্ষেপগুলোই একদিন বড় পরিবর্তনের রূপ নেবে।  

প্রথমত, শিক্ষার প্রসার ঘটানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিক্ষিত সমাজই পারে মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে। শিক্ষা শুধু আলোর পথ দেখায় না; এটি অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি দেয়। প্রতিটি শিশু যদি তার নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, তবে একদিন তাদের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। নারী, শিশু, ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা নিশ্চিত করা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, আইন ও ন্যায়ের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া মানুষের রক্ষাকবচ হতে হবে ন্যায়ের শাসন। শুধু আইন প্রণয়ন করলেই হবে না; তার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাটাই আসল চ্যালেঞ্জ। আইনের প্রয়োগের মাধ্যমেই সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। শান্তির কথা উঠলে মাদার তেরেসার উক্তিটি মনে পড়ে – If we have no peace, it is because we have forgotten that we belong to each other.’ 

তৃতীয়ত, ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকা মানেই মানবাধিকার রক্ষার প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া। একটি ছোট ভালো কাজ, একজন নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো কিংবা কারও অধিকার আদায়ের জন্য কণ্ঠ তোলা—এই ছোট ছোট উদ্যোগগুলোই একদিন বৃহৎ পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করবে।  

মানবাধিকার দিবস আমাদের শুধু একটি দিন মনে করিয়ে দেয় না; এটি একটি আহ্বান, যা আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে জাগ্রত করে। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিদিনের ছোট ছোট প্রচেষ্টাগুলোই একদিন বিশাল পরিবর্তনের রূপ নেবে।  

আমাদের সমাজে বৈচিত্র্য হলো শক্তি। একে দুর্বলতা ভাবা আমাদের বড় ভুল। লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থান এসব বৈচিত্র্যের মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে মানবতার সৌন্দর্য। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যথার্থই বলেছেন: ‘Injustice anywhere is a threat to justice everywhere.’ সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে একতাই হবে আমাদের মূল পরিচয়।  

মানবাধিকার একটি ধারণা নয়; এটি আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। মানবতার রংতুলি দিয়ে সমানাধিকারের ক্যানভাসে নতুন চিত্র আঁকতে হলে আমাদের প্রত্যেকের প্রচেষ্টা একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের চেতনার প্রতিটি স্তরে মানবিক মূল্যবোধ স্থাপন করতে হবে। শুধু একটি নির্দিষ্ট দিনে নয়, প্রতিদিনের জীবনে মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে। আমাদের এমন একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে, যেখানে বৈষম্যের জায়গা থাকবে না। যেখানে কেউ বঞ্চিত হবে না, কেউ অবহেলিত থাকবে না।  

আজ, আগামীকাল, এবং প্রতিটি দিন আমরা যদি এই দায়িত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে যাই, তবে একদিন মানবতার ক্যানভাসে রংতুলির প্রতিটি আঁচড়ে ফুটে উঠবে এক নতুন পৃথিবীর ছবি। যেখানে সমানাধিকার শুধু একটি শব্দ নয়, এটি হবে বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতা রচনা করার কাজ শুরু হবে আমাদের হাত ধরে।  

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

Writer,

Jemi Sailuk

Intern, Content Writing Department,

YSSE.