ADHD Roller Coaster এর পর্ব-১ থেকে জানা গেছে, এই মানসিক ব্যাধিটিকে সাধারণত বংশগত বলে মনে করা হয়, কিন্তু ADHD আক্রান্ত সন্তানের লক্ষণগুলোকে বুঝে তাকে কার্যকরভাবে পরিচালনার মাধ্যমে ব্যাধিটির তীব্রতা, একইসাথে গুরুতর সমস্যার বিকাশকে কমিয়ে আনা যায়। এক্ষেত্রে মা-বাবার প্রাথমিক উদ্যোগ তাদের সন্তানের ইতিবাচক ফলাফলের চাবিকাঠি। অর্থাৎ, মা-বাবা যত দ্রুত তাদের সন্তানের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবেন, তত দ্রুত তারা স্কুল এবং সামাজিক ব্যর্থতা ও এর সাথে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো যেমন, সমালোচনা, দুর্বল আত্মসম্মানবোধের মতো সমস্যাগুলো থেকে সন্তানকে রক্ষা করতে পারবেন। মা-বাবা তাদের সন্তানের সাথে জীবন কখনও, কখনও চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে, কিন্তু অভিভাবক হিসেবে তাদের সাহায্যই সন্তানের জীবনে কিছুটা উন্নতি আনতে পারে।
মা-বাবা হিসেবে সন্তানের জীবনে জটিলতা সৃষ্টিকারী ADHD Roller Coaster এর সাথে মোকাবেলায় তাদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ,অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে ADHD তে আক্রান্ত শিশুর প্যারেন্টিং একটু ভিন্ন হয়ে থাকে।
তো চলুন জেনে নেয়া যাক, কীভাবে ADHD তে আক্রান্ত শিশুর মা-বাবা তাদের সন্তানের জীবনকে সহজ করতে সাহায্য করতে পারে।
- নিজেদের দোষ দিয়ে সীমিত মানসিক শক্তি নষ্ট না করাঃ ADHD সাধারণত মস্তিষ্কের বিকাশরত অবস্থায় সৃষ্ট একটি ব্যাধি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বংশগত হয়ে থাকে। কিন্তু এটি কখনোই দুর্বল অভিভাবকত্ব বা বাড়ির পরিবেশের কারণে হয় না, তবে বাড়ির পরিবেশের উপর নির্ভর করে শিশুর ADHD এর লক্ষণ ভালো বা খারাপ হতে পারে। তাই নিজেদের কারণে সন্তানের এই অবস্থা বলে আক্ষেপ না করে তার উপর কাজ করা উচিত এবং বাড়ির পরিবেশ সর্বদা ভালো রাখা উচিত।
- ADHD সম্পর্কে যতটা সম্ভব জানার চেষ্টা করুনঃ বর্তমানে ADHD সম্পর্কিত বেশ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তবে এর মধ্যে সকল তথ্যই সঠিক নয়। অভিভাবক হিসেবে আপনার বুঝে নিতে হবে কোন তথ্যটি আপনার জন্য প্রয়োজনীয় এবং কোন তথ্যটি প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু একজন অভিভাবক কীভাবে বুঝবেন যে এই তথ্যটি সঠিক?
সাধারণত যেসকল সাইটে ADHD নিরাময় করা যায় বলে উল্লেখ করা, সেসকল সাইটের তথ্য নিঃসন্দেহে ভুল। কেননা, ADHD এর কোনো প্রতিকার নেই, তবে এর প্রভাব কমিয়ে আনতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। এছাড়াও, যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করে ADHD সম্পর্কে জানতে চায়, তাহলে সরকারী (উদাহরণস্বরূপ CDC), অলাভজনক (যেমন CHADD) বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থান (যা .edu-তে শেষ হয়) এর মতো স্বনামধন্য ওয়েবসাইটগুলো থেকে জানতে পারে এবং প্রতিনিয়ত এই সাইটগুলো থেকে ADHD সম্পর্কিত নতুন তথ্যগুলো জেনে নিতে পারে।
- সন্তানের ব্যাপক মূল্যায়ন রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করুনঃ ডায়াগনিস্টিক প্রক্রিয়া চলাকালীন, সন্তানের চিকিৎসা, শিক্ষাগত এবং মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে কিনা এবং ADHD আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যান্য যেসকল ব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ,সেসকল ব্যাধির কথা বিবেচনা করা হয়েছে কিনা এবং ব্যাধিগুলো প্রতিরোধের উপায় অবলম্বন করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
যেভাবে সন্তানকে স্কুলে সফল হতে সাহায্য করা যেতে পারে
- সন্তানের জন্য কার্যকর কেস ম্যানেজার হয়ে উঠতে হবেঃ সন্তানের সমস্ত তথ্যের একটি রেকর্ড রাখতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সমস্ত রিপোর্ট কার্ডের কপি, নিয়মানুবর্তিতামূলক প্রতিবেদন, শিক্ষকের নোট, নিজ সন্তান সম্পর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে হওয়া মিটিং এর ফাইল। এছাড়াও ADHD এর জন্য সন্তানের পূর্বের চিকিৎসার তথ্য, যেসব পেশাদাররা শিশুটিকে নিয়ে কাজ করেছে তাদের তথ্যও সংগ্রহে রাখা যেতে পারে।
- ADHD বুঝে এমন একটি দল গঠন করতে হবেঃ সন্তানের স্কুল মিটিংয়ে প্রধান শিক্ষকের মনোনীত ব্যক্তির পাশাপাশি শিশুটিকে চিনে এমন একজন শ্রেণীশিক্ষক এবং একজন বিশেষ শিক্ষাবীদ, শিশুটির চিকিৎসক, স্কুলের গাইডেন্স কাউন্সেলর,মনোরোগবিশেষজ্ঞ এবং শিশুর বিশেষ চাহিদা বুঝে এমন কিছু ব্যক্তিদের নিয়ে এই দলটি গঠন করতে হবে। এই দলের মিটিং এ শিশুটি সম্পর্কে তাদের মতামত সম্পর্কে জানতে হবে। তারা যে পরামর্শ দিচ্ছেন তা উপলব্ধি করতে হবে।
- ADHD তে আক্রান্ত শিশুর শিক্ষাগত অধিকার সম্পর্কে জানতে হবেঃ শিক্ষা আইনের অধীনে থাকা অধিকারগুলো সম্পর্কে মা-বাবা যত বেশি জানবেন, তত বেশি তা তাদের বাচ্চার জন্য ভালো হবে। প্রতিটি দেশেই মা-বাবা যাতে তাদের সন্তানের শিক্ষাগত অধিকার সম্পর্কে জানতে পারে তার জন্য প্রযুক্তিগত একটি সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে।
- সন্তানের সেরা উকিল হয়ে উঠতে হবেঃ স্কুলে সন্তানের শিক্ষাগত ও আচরণগত উভয় দিক হতেই অভিভাবককে সব বিষয়ের খবর রাখতে হবে এবং সন্তানের প্রতি সর্বোত্তম আগ্রহ দেখাতে হবে। সন্তানের স্বতন্ত্র শিক্ষা পরিকল্পনা (IEP) এবং সেকশন 504 পরিষেবার প্রয়োজন আছে কিনা এবং থাকলে কীভাবে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে হবে।
- নিয়মিত যোগাযোগ রাখুনঃ অভিভাবকদের তাদের সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ গড়ে তুলতে হবে। সন্তানের দলের বন্ধুদের সাথে থাকার সময় সহযোগী মনোভাব দেখাতে হবে। পরিবারের কোনো পরিবর্তনে সন্তানের সমস্যা হচ্ছে কিনা তা শিক্ষকের সাথে আলাপ করতে হবে। সন্তানের কোনো সমস্যা হওয়ার আগেই শিক্ষক যাতে অভিভাবককে জানাতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। অভিভাবক এবং স্কুল প্রতিষ্ঠানের সাথে খোলামেলা যোগাযোগ সন্তানকে অনেকাংশে সাহায্য করবে।
সন্তানের জীবনকে সহজ করার জন্য অভিভাবকদেরও নিজেদের শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এছাড়াও আরো কিছু কাজ করলে আপনার জন্য ADHD মোকাবেলা সহজ হয়ে উঠবে, যেমন,
- পেশাদারদের সাহায্য নেয়াঃ অভিভাবক হতাশ বা ক্লান্ত বোধ করলে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে পারেন। নিজেরা কম চাপ অনুভব করলে সন্তানও এতে উপকৃত হবে।
- সবাই মিলে একসাথে কাজ করাঃ এটা সত্যি যে, ADHD তে আক্রান্ত শিশুর প্রতি সবচেয়ে বেশি মনোযোগী এবং সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে মা-বাবা। তবে এক্ষেত্রে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে শুধু মা-বাবাই নয়, বরং বাড়ির সকল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই ADHD তে আক্রান্ত শিশুটির সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।
- সফল আচরণ পরিচালনার সরঞ্জামগুলো শেখাঃ ADHD তে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসার মূল উপাদান হিসেবে আচরণগত কৌশলগুলো ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অভিভাবক প্রশিক্ষণ অভিভাবকের আচরণ পরিবর্তন করতে এবং তার সন্তানের সাথে তার সম্পর্ক উন্নত করার কৌশল শেখাবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় অভিভাবক তথ্য এবং সম্পদ কেন্দ্র এর মাধ্যমে আশেপাশের অভিভাবক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলো শনাক্ত করা যাবে।
ADHD সহ শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো
ADHD সহ শিশুরা ব্যাপক সমালোচনার শিকার হওয়ায় তাদের মধ্যে প্রায়ই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়। কিন্তু সহজ কিছু পন্থা অবলম্বন করে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো যেতে পারে। যেমন,
- অভিভাবকের তার সন্তানের সাথে প্রতিদিন বিশেষ কিছু সময় কাটাতে হবে, সেটা খেলাধুলা, বেড়াতে যাওয়া বা ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই হোক না কেন।
- অভিভাবককে তার সন্তানের সাফল্য খেয়াল করতে হবে, তা যতই ছোট হোক না কেন। সন্তান ভালো কিছু করলে সে ভালো কাজ করেছে বলুন এবং তার প্রশংসা করুন, এতে তার আত্মসম্মান কিছুটা উন্নত এবং তার নিজের প্রতি খুব বেশি কঠোর হওয়া থেকে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে লক্ষ্য করার দিকে ধাবিত করতে পারে।
- অভিভাবকের জন্য সন্তানের সমস্যা সম্পর্কিত কিছু কঠিন দিন আসবে। এমন দিনগুলোতে তাদের সন্তানকে জানাতে হবে যে তারা নিঃশর্তভাবে তাদের সন্তানকে ভালোবাসে এবং সমর্থন করে। সন্তানের যে কোন সমস্যা সমাধানে, তাদের সন্তানের পাশে থাকতে হবে।
- ADHD সহ শিশুরা অতিসক্রিয়, আবেগপ্রবণ বা আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে সমবয়সীদের সাথে মিশতে সমস্যা হতে পা্রে। অভিভাবক প্রশিক্ষণ মা-বাবাকে কীভাবে তাদের সন্তানকে বন্ধু তৈরি করতে হয় এবং অন্যদের সাথে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করতে হয় তা শেখতে সহায়তা করতে পারে।
- ADHD-এ আক্রান্ত অনেক শিশুরই শিল্প, অ্যাথলেটিক্স, কম্পিউটার কিংবা যান্ত্রিক ক্ষমতার মতো কিছু ক্ষেত্রে শক্তি রয়েছে। এই শক্তিগু্লোকে কাজে লাগিয়ে সন্তানকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে, এতে সন্তানের গর্ব এবং কৃতিত্বের অনুভূতি থাকে। অভিভাবক হিসেবে এই শক্তিগুলোকে চিহ্নিত করা জরুরি।
ব্লগটি পড়া শেষে হয়তো বোঝা যাবে, শিরোনামে “ADHD Roller Coaster এর সাথে মোকাবেলা” এর যে কথাটি বলেছিলাম, তা শুধু শব্দে গড়া আকর্ষণীয় কোনো শিরোনামের জন্য নয় বরং সত্যিকার অর্থেই মোকাবেলার কথা বলেছি। ADHD যেমন একটি শিশুর জীবনকে জটিল করে তোলে, ঠিক তেমনি মা-বাবার জীবনকেও বেশ চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। তবে দিনশেষে, সব মা-বাবাই তাদের সন্তানের সাফল্য চায়,তাই এসকল কার্যক্রম তাদের জন্য কিছুই না। তবে শুধু তারাই কেন, আমরাও কিন্তু ADHD সম্পর্কে জেনে ছোট্ট এই কোমল শিশুদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি, কী পারি না?
আমাদের আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Writer:-
Diderul Islam
Intern, Content Writing Department
YSSE