গ্রন্থ – তিন ভুবনের শিক্ষা।
লেখক বৃন্দ – তানজীনা ইয়াসমিন, তানবীরা তালুকদার, রাখাল রাহা
একদল বাঙালি মা-বাবা যারা বাংলাদেশে ভালোমন্দ বহু অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শিক্ষাজীবন পার করেছেন, ঘটনাক্রমে তারা যখন শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত রাষ্ট্রে নিজের সন্তানের অর্জিত ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার অংশীদার হচ্ছেন, ঠিক ও-ই সময়টায় নিজের প্রতি একরাশ হতাশা নিয়ে কতশত চমকপ্রদ বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন তারই একটি বহিঃপ্রকাশ নিয়ে রচিত ” তানজীনা ইয়াসমিন “, ” তানবীরা তালুকদার ” ও ” রাখাল রাহা ‘র ” ” তিন ভুবনের শিক্ষা “। বইটি পাঠ করবার মাধ্যমে পাঠক জাপান ও নেদারল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার আলোকে আমাদের তথা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থান সম্পর্কে যথাযথ ধারণা লাভ করতে পারবেন।
জাপান
পৃথিবী নামক গোলকের ঠিক উত্তর – পূর্বে অবস্থিত সর্বোচ্চ ভূমিকম্প ও সুনামিপ্রবণ দেশ জাপান। নান্দনিক সব খাবার-দাবার, অত্যাধুনিক সকল প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে জাপান বর্তমানে উন্নত দেশের তালিকায় নিজের অবস্থান অর্জন করতে পেরেছে।
গল্পের এ-ই অংশে ” তোতন” নামক শিশু চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা লেখনীতে লেখিকা ” তানজীনা ইয়াসমিন ” দুজন বাঙালি মা-বাবা বুলা ও নেহালের আদলে জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থার যে বর্ণনা তুলে ধরেছেন তা সত্যি চমৎকার। একটি শিশু যখন মৌলিক শিক্ষা শুরু করে তখন তার ধারাবাহিক ও সুষ্ঠু বিকাশের জন্য জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী বেশ কিছু মানদণ্ডে পরিচর্যা করা হয়। যেমন-
>> সামাজিক শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা।
>> সকল শিশুই সমান।
>>আত্মবিশ্বাসই সব।
>> জীবনের জন্য জীবন দক্ষতা।
জাপানের স্কুলগুলোতে স্বনির্ভরতার শিক্ষা দেয়া হয় খুব ছোট বয়স থেকে। কারণ তারা মনে করে ২-৫ বছর বয়সে শিশুরা বেশী শেখে। তাই কিন্ডারগার্টেনে থাকাকালীন তারা নিজের খাবার নিজে গ্রহণ, কাপড় গোছানো, স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা লাভ করে থাকে৷ কোনোরকমের ভ্রান্ত ধারণা যাতে শিশুদের মনে না জন্মায় তাই ৫ম শ্রেণিতেই তাদের স্বাভাবিক যৌন শিক্ষা প্রদান করা হয়। বইটি পাঠ করে আমরা আরো জানতে পারবো শিশুদের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে বিদ্যালয়গুলো কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে৷ তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; কারো নাম ধরে না ডাকা, গাড়ি ব্যবহার করে বিদ্যালয়ে না আসা, শ্রেণিকক্ষে আলাদা আলাদা রোল নাম্বার না থাকা ইত্যাদি। পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে বৈষম্যের শুরু হয় বলে পরীক্ষায় অংশ নেয়া সকল শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবার সুযোগ দেয়া হয় জাপান শিক্ষাব্যবস্থায়।
কারণ তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে,
” প্রতিটি শিশু এক-একটি ফুল, প্রতিটি ফুলই স্বতন্ত্র “।
প্রত্যেক মানুষের জন্য দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন। সাঁতার কাটা, রান্না করা, সেলাই, সার্বিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, প্রাথমিক চিকিৎসা ইত্যাদি জীবন দক্ষতা জাপানি বাচ্চারা প্রাথমিক পর্যায়ে অর্জন করে থাকে। বইটি পাঠ করার এক পর্যায়ে চোখে পড়বে জাপানের সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রার সাথে সাথে কিছু রূঢ় ( আপাতদৃষ্টিতে) মানসিকতার পরিচয়। মূলত নিজেদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে তাদের এই প্রয়াস।
“বেলীকে গোলাপ আর গোলাপকে রজনীগন্ধা হতে জোর না দিয়ে, বেলীকে বেলী ও গোলাপকে গোলাপ হয়ে ফুটতে সাহায্য করুন। নয়তো গোলাপ, গোলাপ হবার ও বেলী বেলী হবার সামর্থ্যটুকু হারাবে “।
নেদারল্যান্ডস
“পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী শিশুদের শিক্ষা”
গল্পের এই অংশটা হাস্যরসাত্নক। পড়াশোনা থেকে দূরে থাকতে লেখিকা তানবীরা তালুকদার পারি জমান নেদারল্যান্ডসে। কিন্তু সেখানে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পান পড়াশোনার এক অনন্য রাজ্যে। নেদারল্যান্ডসে কেউ বসবাস করতে বা পড়াশোনা করতে চাইলে সেখানকার ভাষা শেখা তার জন্য আবশ্যিক। লেখিকাও একইভাবে ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। সে যাই হোক যখন তার সন্তান ” মেঘ ” একজন ডাচ্ হিসেবে শিক্ষাগ্রহণ আরম্ভ করে লেখিকার আফসোসের সূচনা সেখান থেকে।
অনাড়ম্বর সজ্জাবিশিষ্ট শিক্ষাক্রমে ডাচ্ শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদান করানো হয়। শিশুরা যাতে মনোক্ষুণ্ণ না হয় তাই সেখানে পরীক্ষার ফলাফলে প্রথম, দ্বিতীয় এভাবে মার্কিং না করে “ভালো “, “যথেষ্ট “, ” যথেষ্ট নয়” এভাবে প্রকাশ করা হয়। বাসা থেকে স্কুলে কেবল পানি / চকলেট দুধ বা ফলের জুস আর একটি ফল আনবার অনুমতি রয়েছে, যার উদ্দেশ্য বাচ্চাদের ফলের সাথে পরিচয় করানো এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করা। বাসা থেকে কোনো বইপত্র আনবার প্রয়োজন পড়ে না কারণ সকল পড়াশোনা সামগ্রী বিদ্যালয়ে থাকে৷ বাচ্চারা কোনো জিনিসের জন্য কাঁদলে সেটা দেয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নেদারল্যান্ডস শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুলগুলো এমনভাবে তৈরী করা যে শিশুরা তাদের দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে স্কুলকে নামকরণ করে।
বাচ্চাদের রিপোর্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে সামাজিক ও মানসিক উন্নয়ন আর পড়াশোনাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। সামাজিক ভদ্রতা, খাবার ভদ্রতা, জুতোর ফিতে বাঁধা ইত্যাদি সব ডে- কেয়ারেই শেখানো হয়।
তবে নেদারল্যান্ডস এ-র শিক্ষা হলো সমাজ, ইতিহাস ও সময় উপযোগী শিক্ষা। সেখানকার উৎসব সম্পর্কে জানতে শিশুদের আলাদা কোনো বই খাতা বা বর্ষাকাল, বসন্তকাল, জার্নি বাই বোট ইত্যাদি মুখস্থ করবার দরকার পড়ে না। নেদারল্যান্ডস এ-র শিক্ষা কেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী শিশুদের শিক্ষা সেই বিষয়টি লেখিকা ” তিন ভুবনের শিক্ষা ” বইয়ের এ অংশে তুলে ধরেছেন ।
বাংলাদেশ
“পাথরে লেখা আছে অধঃপতন “
শুরুতে জাপান ও নেদারল্যান্ডস এর শিক্ষাব্যবস্থা পড়বার পরে খানিকটা বিরতি নিয়ে এরপর এ-ই অংশ পড়তে বসা তুলনামূলক ভালো।
আমি ব্যক্তিগতভাবে নিদারুণ হতাশা বোধ করেছিলাম এই অংশে এসে। একজন বাঙালি হিসেবে আমরা বরাবরই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জ্ঞাত। তবে লেখক রাখাল রাহা অতি সূক্ষ্ম কিছু বিষয়, যেসব আমাদের শিশুদের ভবিষ্যতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে সেই দিকটি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
তথাকথিত ভর্তিযুদ্ধ, পরীক্ষা পদ্ধতি, মেধার বিকাশ শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য, পাঠদান কাঠামো, বিদ্যালয় পরিবেশ, শিক্ষক – শিক্ষার্থী সম্পর্ক ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে জাপান ও নেদারল্যান্ডস এর শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা যে চিত্র দেখবো তার ঠিক উল্টো চিত্রের দেখা মিলবে এ অংশে। তবে এত এত নেতিবাচকতার ভীরে ইতিবাচক কিছু নজরে পড়লে নিশ্চয় সবার ভালো লাগবে৷ তাই এই অংশটা রাখলাম যিনি বইটি পড়বেন তার কৌটায়। আর যে বা যারা ইতোমধ্যে বইটি পড়েছেন আপনাদের স্বাগত।
মন্তব্য
বইটির একদম শেষ অংশে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাখাল রাহার শব্দ উপস্থাপন দক্ষতার প্রশংসা না করলেই নয়। সাথে সাথে ভিন্ন ভিন্ন দুদেশে অবস্থানকালীন দুজন লেখিকা নিজের শিক্ষাজীবনের প্রাপ্তি ও অভিজ্ঞতার সাথে নিজ নিজ সন্তানের অভিজ্ঞতা মেলাতে যে বেগ পেতে হয়েছে তা নিতান্তই বিস্ময়কর। তানজীনা ইয়াসমিন, তানবীরা তালুকদার ও রাখাল রাহা তিনজন ভিন্ন মানুষ হলেও গল্পের শেষে তাদের মতবাদ ছিলো অভিন্ন৷ আর তা হলো , জাতি হিসেবে আমাদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ আমাদের ” যথাযথ শিক্ষাব্যবস্থাপনা”। “তিন ভুবনের শিক্ষা” এমন একটি বই যা বাবা-মা, শিক্ষকসহ সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে ভাবতে বাধ্য করবে এবং আমি মনে করি এখানেই বইটির স্বার্থকতা।
আরও ব্লগ পড়তে এখানে #ক্লিক করুন।
Writer
Lutfur Nahar
Intern
Content Writing Department
YSSE