রাস্তায় আমরা সাধারণত নানা ধরনের হকার দেখে থাকি। নানা বয়সের এই মানুষগুলোর ভিড়ে আমরা যখন ছুট্টো কোমলমতি শিশুদের দেখি তখন মনের মধ্যে একটা বড় ধাক্কা লাগে। কারন শিশুরা তো এভাবে অযত্নে অবহেলায় বড় হওয়ার কথা নয়। তাহলে কি টাকাই সব কিছুর মূল? কারন ওদের পিতামাতাদের যদি সামর্থ থাকতো তাহলে কি এরকম কচি বাচ্চাদের রাস্তায় ছেড়ে দিতেন? এদের নেই কোনো ঘর, নেই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা, যার কারনে বলাই যায় কোনো ভবিষ্যৎ ছাড়াই এরা দিন যাপন করছে। যে বয়সে কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুলের দিকে যাদের গন্তব্য থাকার কথা ছিল সেই বয়সে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের পিছু পিছু ঘুরে কিংবা কায়িক পরিশ্রম করে তারা দিন পার করছে।

জাতিসংঙ্গের মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী তারাই পথশিশু যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং যাদের থাকার জন্য নেই কোনো স্থায়ী থাকার জায়গা। সারা বিশ্ব জুড়ে এরকম  পথশিশুর সংখ্যা অনেক যার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। পথশিশুর সংখ্যা বাড়ার পেছনে মূলত নানা কারন রয়েছে যেমনঃ নদিভাঙ্গন, ভূমিহীনতা, দারিদ্রের দুষ্ট চক্র ইত্যাদি। বাংলাদেশে এই পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ যার একটা বিশাল অংশ রাজধানী ঢাকার রাস্তা ঘাটে অবর্ণনীয় ভাবে দিনাতিপাত করছে।

শুধু দারিদ্রতাকেই এই অবস্থার জন্য দায়ী করা যায় না। কেননা আমাদের দেশে এখনও কিছু স্থায়ী সমস্যা রয়েছে যেগুলোর সমাধান খুব বেশি একটা আমদের চোখে পরে না। যেমনঃ বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, শিশু পাচার, দূুর্নীতি। তাছাড়া পারিবারিক দ্বন্দ, কলহ তো আছেই যেমনঃ মা বাবার বিচ্ছেদ, বহু বিবাহ ইত্যাদি। 

তাছাড়া শহরের বস্তির খুব নিম্ন আয়ের মানুষ জন পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশী হলে যারা বয়সে একটু বড় তাদের পাঠিয়ে দেন রোজগারের কাজে। ঘরে থাকার জায়গার অভাব কিংবা পারিবারিক কলহের জেরে এই শিশুরা আশ্রয় নেয় শহরের ইট-পাথরের রাস্তায়। কেউ কেউ গ্রাম থেকে শহরে এসে পায় না মাথা গুঁজবার একটু ঠাই। বাধ্য হয়েই পথকে বানিয়ে নেয় তাদের ঠিকানা। হয়ে যায় পথশিশু। আর জীবিকার জন্য তখন ফুল বিক্রি, বেলুন বিক্রি অথবা ভিক্ষাবৃত্তি করা ছাড়া কিছু করার থাকে না তাদের।

সারাদিন এই সেই বিক্রি করে সময় কাটলেও রাতের বেলা তারা হয়ে পরে আরও বেশী অসহায়। ঘুমানোর একটু জায়গার যে বড় অভাব তাদের। ফুটপাত, ওভারব্রিজ, বাস স্টপ, দোকানের সামনের সিঁড়ি, পার্কের বেঞ্চ এরকম অস্থায়ী জায়গা গুলো এরা বেছে নেয় ঘুমানোর জন্য। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় প্রকৃতির নিকট হার মানে অনেক অসহায় পথশিশু। প্রতি বছর একটি বড় সংখ্যার পথশিশু ঠাণ্ডায় অকালে ঢলে পরে মৃত্যুর কোলে।

  

একজন মানুষের আর সকল মৌলিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। যেমন অসুস্থ হলে পাচ্ছে না স্বাস্থ্য সেবা, নাই শিক্ষা, বাসস্থান, প্রয়োজনীয় পোশাক, সময় মত পুষ্টিকর খাবার কিংবা বিনোদন এর ব্যবস্থা।

এক গবেষণায় দেখা যায় এই পথশিশুদের একটি বিশাল অংশ পেটের অসুখে ভুগে। তা আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহনই এর জন্য দায়ী। তাছাড়াও নোংরা পরিবেশে থাকার কারনে নানান সংক্রামক রোগেরও দেখা দেয় তাদের মধ্যে।

এভাবে অভিবাবকহীন হয়ে এখানে সেখানে দিন যাপনের কারনে নিরাপত্তার অভাবে অনেকেই পরে যায় দালালদের খপ্পরে। কাউকে দালালরা পাচার করে দেয় নানান জায়গায়। কাউকে আবার শিখানো হয় চৌর্যবৃত্তি। অনেকে আবার শিক্ষা দীক্ষার অভাবে হয়ে পরে নৈতিকতা ও আদর্শহীন। চুরি, ছিনতাই, কিশোর গ্যাং এর মত আরও নানান অমানবিক কাজে তারা লিপ্ত হয়ে পরে। 

তবে বলা যায় পুর্বের তুলনায় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে পথশিশুদের জন্য। অনেকেই এদের জন্য নানান প্রকল্পের আয়োজন করছে। যেই প্রকল্পের আওতায় এদের শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি এদের নৈতিক শিক্ষা দানের মাধ্যমে সমাজের এবং দেশের জন্য একজন ভালো নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আহসানিয়া মিশন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সহ আরও নানান প্রতিষ্ঠান। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় চল্লিশ হাজার অসহায় পথশিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রয়েছে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি সহ আরও অনেক কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। 

আমাদের সকলের উচিত শুধু সরকারি বেসরকারি সংস্থা, বিভিন্ন এনজিও উপর সমস্ত দায় ভার না চেপে দিয়ে নিজেদের জায়গা থেকে এদের জন্য কিছু করার। সমাজ ও দেশের ভবিষ্যৎ এই শিশুরা। তাই এদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের সকলের দায়িত্ব। প্রত্যেক শিশুই পাবে মানুষ হিসেবে মৌলিক অধিকারটুকু ভোগ করার  সুযোগ। এটাই যেন হয় আমাদের লক্ষ্য।

এরকম আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন এখানে

লেখিকা– 

রুবাইয়া বেগম

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE