‘আমাদের জীবন এত ক্ষুদ্র যে, তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফুরিয়ে যায়। এই জীবন নিয়ে হতাশার কিছু নেই। বরং প্রতি মুহূর্ত এই জীবনকে উপভোগ করা জরুরী। একটাই তো জীবন। হেলায় হারিয়ে ফেললে, ফিরে পাওয়া যায়না৷ সবাই আনন্দে বাঁচুক।’—আসাদুজ্জামান জীবন
“World Youth Skills Day” উপলক্ষ্যে “YSSE” আয়োজিত “Turn Your Flame Into Achievements” ক্যাম্পেইনে একের পর এক উপস্থিত হচ্ছেন দেশ সেরা সফল উদ্যোক্তারা। এই সকল উদ্যোক্তাদের সাফল্যের গল্প আমাদের মতো অনুজদের কাছে অনেক অনূপ্রেরণামূলক। আজকে আমাদের “Turn your flame into achievements” ক্যাম্পেইন উপস্থিত হয়েছে এমনই একজন সফল উদ্যোক্তার সামনে যিনি সমাজের তথাকথিত গদবাধা জীবন ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে লিখালিখিকে আকড়ে ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিই হচ্ছেন ‘আসাদুজ্জামান জীবন’। চলুন শুনে আসি এই তরুণ লেখকের সাফল্যের গল্প।
মানুষের মনের মধ্যে জায়গা করে করে নেয়ার এক অভিনব কৌশল- ‘লিখালিখি’কে আঁকড়ে ধরে অবিরাম পথ চালিয়ে যাওয়া কতই না মধুর! ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা আপনার-আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ লিখে যাচ্ছেন আমাদের নিত্যদিনের অনুভূতি নিয়ে; যা যথারীতি আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এ যেনো আমাদেরই জীবন থেকে নেয়া গল্প। যে কিনা এরকম আমাদের জীবনের গল্প লিখতে লিখতে এ পর্যন্ত সফলতার সাথে দুই দুইটি বই প্রকাশ করে ফেলেছেন। আমরা YSSE পরিবার এসেছি এমনই এক লেখকের কাছে তাঁর সাফল্যের গল্প শুনতে।
তবে আসুন জেনে নিই তার জীবন, মানুষের এতো নিকট অনুভুতি নিয়ে লিখার কৌশল ও সফলতার গল্প। মানুষের প্রতিদিনের জীবনের খুব নিকটে পৌঁছে যাওয়া সেই লেখক হচ্ছেন আসাদুজ্জামান জীবন।
YSSE: শুরুতেই জানতে চাই, আপনার সম্পর্কে কিছু কথা। আপনার বেড়ে উঠা এবং পড়াশোনা কোথায় হয়েছে?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ আমার জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলায়। আমার শৈশব, কৈশোর মূলত গ্রামেই কেটেছে। মাধ্যমিক কমপ্লিট করেছি গ্রামেরই একটি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবং ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক। মার্কেটিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে।
YSSE: লিখালিখির পাশাপাশি বর্তমানে কি করছেন?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ বর্তমানে লিখালিখির পাশাপাশি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সাথে পার্টনারশিপে কাজ করছি। ওয়েডিং এবং কর্পোরেট ইভেন্ট প্ল্যানার হিসেবে আছি।
YSSE: আপনার লিখালিখি নিয়ে কিছু বলেন, কিভাবে লিখালিখি নিয়ে এতো পথ এগিয়ে এলেন?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ ছোটবেলায় ডায়েরি লেখার একটা অভ্যাস ছিল। যদিও তখন গুণগতমানহীন লিখালিখিই বেশি করা হতো। শৈশবের যে আবেগ মন ও শরীরে কাজ করে, তা গুছিয়ে লেখা তো সে বয়সে সম্ভব ছিল না। তবুও লিখতাম। লিখতে ভাল লাগতো।
একটা সময় পর মনে হয়েছে, লিখালিখির চর্চা করাটা জীবনের একটা দারুন ব্যাপার হতে পারে। মানুষের অনুভূতি নিয়ে বোঝার ও জানার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এটা দারুন। এমনকি শুধু লেখার মাধ্যমে মানুষের এত নিকটে পৌঁছে যাওয়া যায়, তা লিখালিখি শুরু না করলে জানতেও পারতাম না। টুকটাক লিখতে লিখতে যখন মানুষের এপ্রিসিয়েশন পাওয়া শুরু করলাম, তখন থেকেই লেখার প্রতি একটা ঝোঁক চলে আসলো।
YSSE: আমরা আপনাকে সোশিয়াল মিডিয়াতে যতটুকু দেখেছি আপনি প্রায়সময়ই মানুষের অনুভূতি নিয়েই লিখালিখি করেন। এর বাইরে কি কখনো অন্য কোনো বিষয় নিয়ে লিখা হয়েছে?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ মানুষের অনুভূতি নিয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এর বাইরেও সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে প্রচুর আর্টিকেল লিখেছি। তবে, আমি সব সময় চেয়েছি জীবনের প্রতি জন্মানো আমার বোধটুকু মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে।
YSSE: এই লিখালিখিটা কবে থেকে শুরু করেছেন?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ আনঅফিসিয়ালি ২০১৪ থেকে শুরু করলেও ২০১৭ এর পর এসে এটাকে প্রফেশনালি নিয়েছি। যখন দেখি মানুষ আমার লেখা পড়তে ভালোবাসে, তখন এক ধরনের অদৃশ্যমান দায়বদ্ধতা তৈরী হয়ে যায়।
YSSE: লিখালিখি শুরু করার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ লিখালিখি শুরু হওয়ার অনুপ্রেরণা বলতে তেমন কিছু নেই। একসময় প্রচুর বই পড়েছি। সেখান থেকেই মূলত লেখার প্রবণতা তৈরী হয়েছে। তবে, প্রথমদিকে আমার বন্ধুরা আমাকে অনেকটাই সাহস দিয়েছে। তারা এপ্রিশিয়েট করতো এবং এই লিখালিখি ব্যাপারটাকে চালিয়ে যাওয়ার জন্য মনোবল তৈরী করে দিত।
YSSE: এই লিখালিখি শুরু করতে যেয়ে প্রতিবন্ধকতা কি ছিলো? কিভাবে তা অতিক্রম করলেন? শিল্পের সাথে জড়িত কিছু সচরাচর সব ফ্যামিলি মেনে নিতে চায় না। আপনার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কেমন ছিলো?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ প্রতিটি ঘটনা এবং সম্ভাবনার সামনেই তো প্রতিবন্ধকতা থাকে। বর্তমান সময়ে কেবল লিখালিখির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং, কারোর মা-বাবাই চান না তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ ইনসিকিউরড হোক। শিল্পের সাথে জড়িত কোন কিছুতেই মানুষ আমাদের সাপোর্ট করেনা। এটাতে পিছুপা হওয়ার কিছু নেই। আমি আমার লিখালিখির ক্যারিয়ারের পাশাপাশি কর্পোরেট ক্যারিয়ারকেও সম্বৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি এবং দুটিতেই আমার স্বচ্ছলতা এসেছে।
তাছাড়া, প্রতিবন্ধতা না থাকলে এমন অর্জনে আনন্দ নেই। আমি আনন্দ খুঁজে বেড়ানো মানুষ। কোন প্রতিবন্ধকতাতেই আমি ভেঙে না পড়ার চেষ্টা করি।
YSSE: আপনার প্রথম বই, “মানুষ স্টেশন”। অনুভূতি কি ছিলো প্রথম প্রকাশনার পর?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ “মানুষ স্টেশন” বইটি মূলত একটি কবিতার বই। আমি বইটিতে চেষ্টা করেছি মানুষের জীবনকে তুলে ধরার। মানুষের জীবনে এত বিষাদ, এত সংকট ও অনটন; এসবকে একসাথে তুলে ধরতে চেয়েছি।
তাছাড়া প্রথম বই প্রকাশের আনন্দটা আসলে অন্যরকম। শুধু বই নয়, জীবনের প্রতিটি প্রথম সৃষ্টির প্রতিই মানুষের অসীম মমতা থাকে। আমার বইয়ের বেলায়ও তার কম নেই। বই প্রকাশ করার ব্যপারটা আমাকে সত্যিই আনন্দিত করেছে।
YSSE: কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ গল্প, উপন্যাসের তুলনায় কবিতার বইয়ের সাড়া কম থাকে। তবু, প্রথম বই হিসেবে প্রচুর সাড়া পেয়েছি, যা অভাবনীয়। এতটা আশা করিনি।
YSSE: কাকে উৎসর্গ করেছিলেন বইটি? আর কেনো?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ আমার প্রথম বইটি মা-বাবাকে উৎসর্গ করেছি। মানুষের জীবন তো মা-বাবার কাছেই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে। জীবনের যেটুকু অর্জন, তা তাদের সাথে নিয়েই উদযাপন করতে পছন্দ করি।
YSSE: আপনার দ্বিতীয় বই, “অতি ছোটগল্প”। এই বইটির সাড়া কি আগের চেয়ে বেশি ছিলো?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ “মানুষ স্টেশনের” পর “অতি ছোটগল্প” নামে একটি ছোটগল্প বই এসেছিলো ২০২২ গ্রন্থমেলায়।
হ্যাঁ, যেহেতু কবিতার চেয়ে গল্পের বইয়ের পাঠক তুলনামূলক বেশি, তাই এবার পাঠকের সাড়াও তুলনামূলক অনেক বেশি ছিল।
YSSE: এই বইটি কাকে উৎসর্গ করেছিলেন?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ “অতি ছোটগল্প” বইটি উৎসর্গ করেছিলাম নাদিয়া আফরিনকে। আমার একজন ভাল বন্ধু বলা যায়।
YSSE: পরবর্তী বই কবে আসছে?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ ২০২৩ বইমেলায় নতুন বই আসার সম্ভাবনা আছে।
YSSE: আচ্ছা, তাহলে এবার একটু ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন। আপনার মতে লোক কেনো আপনার বই পড়বে? আপনার লেখার কোন বিষয়টি আপনার লেখাতে বাকি লেখকদের থেকে আলাদা করে বলে আপনি মনে করেন?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ এটা আসলেই খুব ক্রিটিক্যাল। আমার মতে তো আসলে কেউই আমার বই পড়বেনা। কেউ কৌতূহল থেকে পড়বে, কেউ কৌতূহল শেষ হওয়ার পর হয়তো আর পড়বেনা। একটা বই সবাইকে একই সাথে হ্যাপি করতে পারেনা। কেননা, আমাদের সমাজে কয়েকটি স্ট্যান্ডার্ডের লোক বাস করে। সবার লাইফ স্টাইল এক নয়। তারা অবশ্যই আমার বই পড়বে বলে আমি বিশ্বাস করি, যাদের লাইফস্টাইল আমার লেখায় ফুটে উঠে।
আমার মনে হয়- আমি জীবন ও বোধের খুব কাছাকাছি পৌঁছাতে পারি। প্রায়ই একটা কমপ্লিমেন্ট এমন আসে যে- “ভাইয়া, যেদিন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাই, সেদিন আপনি সেরকম একটা লেখাই লিখেন”।
আমার মনে হয় মানুষের প্রতিদিনের জীবনের খুব নিকটে পৌঁছাতে পারাটাই আমার স্বতন্ত্রতা।
YSSE: লিখালিখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ লিখালিখিটা আমার একটা শখের জায়গা। এই জায়গাটুকু ছাড়তে ইচ্ছে হয়না। ইচ্ছে হয়, একটা দীর্ঘসময় ধরে এই ব্যাপারটাকে আগলে ধরে রাখি। চেষ্টাও করছি। ভবিষ্যতে আরো ভাল কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবো। মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারার আনন্দ কেবল এই লিখালিখির মাধ্যমেই সম্ভব হয়।
YSSE: নিজেকে রাইটার হিসেবে পরিচয় দিবেন নাকি ইভেন্ট প্ল্যানার?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ ইভেন্ট প্ল্যানারের চেয়ে লেখক হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি গর্ববোধ হয়।
YSSE: আজ থেকে ১০ বছর পর রাইটার হিসেবে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ লক্ষ্য নিয়ে লিখালিখি করা যায়না। জীবন যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছি। আপাতত নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই।
YSSE: লিখালিখি ক্যারিয়ারে কোনো স্টোরি, যেটা আপনি আপনার ভক্তদের বা সবাইকে বলতে চান। এটা হতে পারে আপনার স্ট্রাগল, বা কোনো ইন্টারেস্টিং কিছু বা নতুন অভিজ্ঞতা। এনিথিং।
আসাদুজ্জামান জীবনঃ আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে তীব্র দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে। এবং এই অনটন থেকে জীবন আমাকে বহুকিছু শিখিয়েছে। আমার ভেতর বোধ জন্মেছে। সেই বোধই মূলত আমার লেখার চালিকাশক্তি। আমার জীবন যদি এমন সংকটের মধ্য দিয়ে না কাটতো, আমি লেখক হতে পারতাম না।
YSSE: আমাদের মতো জুনিওর রাইটারদের প্রতি আপনি কি পরামর্শ দিবেন?
আসাদুজ্জামান জীবনঃ জুনিয়ররা একদিন নিশ্চয়ই অনেক বড় হবে। তবে, তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার আছে- প্রচুর পড়তে হবে। ভালো লেখক হতে হলে, অবশ্যই একজন ভালো পাঠক হতে হবে। বই পড়ো।
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ, স্বয়ং আসাদুজ্জামান জীবনের থেকে শুনে আসা তার সফল্যের গল্প আমাদেরকে অনেকভাবেই অনুপ্রানিত করেছে। আশা করছি এই World Youth Skills Day এর ক্যাম্পেইনের সফল উদ্যোক্তা আসাদুজ্জামানের জীবনের মতো আমি, আপনি এবং, আমাদের মতো সকল জুনিয়র উদ্যোক্তারা নিজেদের দক্ষতাকে আলিঙ্গন করে তুলবে।
“একটি নিরাপদ আশ্রয় মিলে গেলে বোধয় স্বাধীনতার চেয়ে পরাধীনতা বেশি স্নিগ্ধ ও সুন্দর”
- আসাদুজ্জামান জীবন (মানুষ স্টেশন)
Click here to read more of our blogs.
Writer
Zikra Tayab
Intern, Content writing department
YSSE