বাংলা ভাষা আন্দোলন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল  সময়ব্যাপী একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছিল। 

১৯৪৭ সাল হতে ভাষা আন্দোলনের যে সূত্রপাত হয় তা চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী, অবশেষে পাকিস্তান সংবিধানে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে ২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৬ সাল

দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত বিভাজিত হয়ে পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পূর্ণনামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে স্বাধীন দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারেরও অধিক দুরত্বের ভৌগোলিক পার্থক্য নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তানের দুই অংশ। 

১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ধর্মকে অজুহাত দেখিয়ে দাবি করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা; প্রস্তাব করে আরবি হরফে বাংলা লেখার নতুবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। 

এমনকি বাংলাকে রোমানীকরণের প্রস্তাব দেওয়া হয় যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের ভাষাসমূহ লাতিন হরফে লেখা হবে। বাংলার মানুষ এই আকস্মিক, অন্যায্য দাবি মেনে নিতে পারে নি। 

সমমর্যাদার ভাষার দাবি জেগে উঠে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে। বাংলার মানুষকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সভা-সমাবেশ, মিছিল বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ তথা ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রুপে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। 

সমবেত জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিল ঢাকা মেডিকেলের সামনে পৌঁছালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে পুলিশ অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে আন্দোলনকারীদের ওপর। 

এম.এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত, বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেস মালিকের ছেলে রফিক, আব্দুল জব্বার, সালাম নিহত হয় পুলিশের গুলিতে। বাংলার রাজপথ রঞ্জিত হয় ভাষা শহীদ আর আহতদের রক্তে। 

ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে শোকাহত বাঙালির মনে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদস্বরুপ ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারী পূর্ণাঙ্গ হরতাল পালন করে। দুদিনই পুলিশ গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের উপর।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে ছাত্ররা শহীদদের স্মৃতিতে গড়ে তোলে শহীদ মিনার, যা ২৪শে ফেব্রুয়ারী উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। 

আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬শে ফেব্রুয়ারী দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। “শহীদ বীরের স্মৃতিতে” শিরোনামে শহীদ মিনারের খবর ছাপা হয় দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। 

হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তার গা ঘেঁষে কোণাকুণিভাবে এমনভাবে শহীদ মিনারটি তৈরি করা হয় যাতে বাইরের রাস্তা থেকে সহজেই সরাসরি দেখা যায় আর যেকোনো ছাউনি থেকে বের হলে সরাসরি যেন চোখে পড়ে।

শহীদ মিনারটি নকশা করেন বদিউল আলম আর তদারকি করেন ইঞ্জিনিয়ার জিএস শফরুদ্দিন। ২৬শে ফেব্রুয়ারী আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরই পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেল হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে।

অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৭ই মে ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে পাকিস্তান সরকার গণপরিষদে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

অত:পর ১৯৫৭ সালে পুনরায় সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ বরকতের মা শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন।

২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদদের স্মরণে প্রথম ‘একুশের’ গান,

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি “ 

রচনা করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। আব্দুল লতিফ প্রথমে গানটিতে সুর দিলেও পরে ১৯৫৪ সালে করাচী থেকে ঢাকায় ফিরে আলতাফ মাহমুদ নতুন করে সুর দেন অমর এ গানটিতে। 

সেই থেকে এটিই একুশের প্রভাতফেরীর গান। গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে জহির রায়হান তার “জীবন থেকে নেওয়া” চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করার পর থেকে। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় বিবিসির শ্রোতা জরিপে গানটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে।

১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা সংরক্ষণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা যথাযথ আন্তর্জাতিক মর্যাদার সাথে সারা বিশ্বে পালন করা হয়।

এরকম আরও অনেক ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন। 

লেখিকা

যারীন আনান তানহা

ইন্টার্ণ, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *