সমাজের ট্যাবু ভাঙতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে “Let’s Talk Mental Health” অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট আনুশা চৌধুরী। সাক্ষাৎকারের ২য় পর্বে আমরা জানবো তার লেখক হয়ে ওঠা এবং সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।

YSSE: এবার বইমেলায় আপনার একটা বই “ভয়হীন জীবনের খোঁজে ” প্রকাশিত হয়েছে। লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?

আনুশা চৌধুরী: এটা আমার লাইফের সবথেকে সুন্দর এক্সপেরিয়েন্স এর মধ্যে একটা। কারণ আমি মনে করি এর থেকে বড় আর সুন্দর কোনো এক্সপেরিয়েন্স হতে পারে না। আমি নিজেকে আসলে কখনো লেখক হিসেবে দেখব সেটা ভাবিনি। কিন্তু তারপরেও বই লেখার অনুভূতি এবং অন্য লেখকদের সাথে বই এক্সচেঞ্জ করার বা আমার বইয়ের ইনসাইটগুলা অন্যদের সাথে শেয়ার করার অনুভূতি আমার লাইফের ওয়ান অফ দ্য বেস্ট এক্সপেরিয়েন্স।
“ভয়হীন জীবনের খোঁজে” বইটি লেখা পেছনে আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। আমি হার্ভার্ডে পজিটিভ সাইকোলজি কোর্সটাতে অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলাম যেটা বাংলাদেশের অনেকেই শেখার সুযোগ পাই না। আমি মনে হয় অনেকটা সৌভাগ্যবান যে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে গিয়ে কোর্সটা করতে পেরেছি। যেটা অনেকেই অনলাইনে করার সুযোগ পায়। I was basically invited by Harvard Business School ওদের একটা অ্যানুয়াল সেমিনার থাকে যার নাম Connext, সেই সেমিনারে আমাকে মেন্টাল হেলথ নিয়ে কথা বলার জন্য invite করেছিলো। এরপর ওরা আমাকে অফার করল আমাদের পজিটিভ সাইকোলজি নিয়ে একটা কোর্স আছে। আপনি চাইলে এটা করতে পারেন। এর একটা কারণ ছিল, আমি ওদের Entrepreneurship Essential একটা কোর্স এর ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলাম। ওরা ওদের সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে আমার success স্টোরি হাইলাইট করেছে আর আমি কিভাবে এই কোর্সটা করেছিলাম ওইটার ডিটেলস গুলোও আছে। হার্ভার্ডের পজিটিভ সাইকোলজি কোর্সটা থেকে আমি যা শিখেছিলাম আমি চেয়েছি বই লেখার মাধ্যমে সেটা সবার মধ্যে পৌঁছে দিতে। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, মেন্টাল হেলথ নিয়ে বাংলাদেশে অত বেশি বই নেই বললেই চলে। তাই যেহেতু আমি মেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করি, তাই আমি আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং গুলো মানুষের সাথে শেয়ার করতে চেয়েছি।
আমার বইয়ের ষোলটা অধ্যায় আছে। এই ১৬টা অধ্যায়ে আমি আলাদাভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে আমাদের জীবনে কোন জিনিসগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ভালো থাকার গুরুত্ব, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা, অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। যেগুলো একদম জীবনের বেসিক, যেগুলো আমাকে কেউ বলেনি, আমি চাই আমার বইয়ের মাধ্যমে আমি অসংখ্য মানুষকে সে কথাগুলো পৌঁছে দিতে। যেমন সুখে থাকার সন্ধি, নিজেকে জানার উপায় আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমার মনে হয় প্যাশন ও জীবনের উদ্দেশ্য অনুসরণ। আমাদের প্যাশনটা কি, আমরা কিসের পিছনে দৌড়াচ্ছি সেটা জানাটা জরুরি। অনেকে হয়তো জব করছে কিন্তু সে একটা ব্যবসা করতে চায় অথবা অন্য কিছু করতে চায়। সেক্ষেত্রে এই বইটা আপনাকে একটা দিক নির্দেশনা দেবে যে আপনি জীবনে কি কি করতে পারেন। যেটা হয়তো আপনার প্রোডাক্টিভিটি, স্কিলস এবং মেন্টাল হেলথ এই তিনটা জিনিসকে একসাথে গুছিয়ে আপনাকে ভালো রাখবে। আর সবচেয়ে বড় কথা এই বইটা একটা মানুষকে প্রপার গাইডলাইন দেবে। এটা একটা মেন্টাল হেলথ বইয়ের পাশাপাশি একটা সেল্ফ হেল্প বুক হিসেবে চিন্তা করা যায়। মানুষের মন একটা বিমানবন্দরের টাওয়ারের কন্ট্রোল রুমের মতো। সেখান থেকে আমাদের মন আমাদের পুরো বডিকে কন্ট্রোল করে। এটা কিন্তু আমরা সবসময় বুঝতে পারি না। আপনার যখন মন খারাপ থাকে তখন আপনি অনেক lazy ফিল করেন, আপনি বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, আপনি অনেক টায়ার্ড হয়ে যান। এই মনটাকে আসলে ভালো রাখার অনেক উপায় আছে। সেই কন্ট্রোল রিমোটটা যদি আমাদের হাতে থাকে তাহলে আমরা সবকিছু ঠিক করে ফেলতে পারি। সেক্ষেত্রে এই বইটা আসলে আমাদের জীবনের একটা কাঠামোকে গুছিয়ে দিতে পারবে যদি আসলে কেউ এটার গুরুত্বটা বুঝতে পারে।

YSSE: আপনার জার্নিতে কারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছে?

আনুশা চৌধুরী: এটা আমার জন্য বলাটা খুবই গর্বের একটা বিষয়। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমার বাবা-মা অনেক সাপোর্টিভ। সবাইকে সাপোর্ট করতে পছন্দ করে, এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। আমার বাবা মাকে দেখে আমার মনে হয়েছে যে, আমি অন্যদেরকে যাতে কিছু দিতে পারি। আমি যেটা জানি যাতে সেটা অন্যদেরকে শেখাতে পারি। যেটা অন্যরা পাচ্ছে না আমি অন্তত তাদেরকে এসে পথটা খুঁজে দিতে চাই। তাই প্রথম অনুপ্রেরণা আমার বাবা-মা।
এছাড়াও যারা ওয়ার্ল্ডওয়াইড কোন সলিউশন বের করার জন্য বা কোন একটা প্রবলেম সলভ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তারা সবাই আমার অনুপ্রেরণা। যারা নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে সমাজের জন্য কিছু না কিছু কাজ করছে তারা সবাই আমার ইন্সপিরেশন।

YSSE: আপনার সফলতায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল? থাকলে সেটা কি?

আনুশা চৌধুরী: যেহেতু আমি একজন নারী। আমি দেখেছি নারী হিসেবে এখনো আমরা ইকুয়্যাল রাইটস এর ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে আছি। অনেক সময় দেখা যায় একজন মেয়ে বা নারী হওয়ার কারনে আমি অনেক কাজ করার সুযোগ পাচ্ছিনা। কোন প্রজেক্ট বা কমপ্লিকেটেড সিচুয়েশনে যে কাজটা আমার ভাই বা আমার কোন কলিগ করার সুযোগ পাচ্ছে, সেই কাজটা আমি নারী বলে অনেক সময় করার সুযোগ পাই না। তাই এই দিক থেকে নারী হওয়ার কারণে আমি কিছু ব্যারিয়ার ফেস করেছি।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, যেহেতু আমরা একটা নন প্রফিট অর্গানাইজেশন, সেহেতু আমাদের অর্গানাইজেশনের জন্য পারমিশন আনতে গেলে দেখা যায় অনেক সময় কিছু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। কোথাও ঠিক প্রপার গাইডলাইনটা পাওয়া যায় না যেখানে আমি জানব যে আমার এখান থেকে এখানে সাপোর্টটা পাওয়া যাবে।
জেন্ডার ইকুয়ালিটি বা পারমিশনের ব্যাপারটা ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। যেমন আমি যদি কিছু শেয়ার করি সোশ্যাল মিডিয়াতে, তখন শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে আমাকে যে কটু কথা শুনতে হয়, একজন ছেলে হলে আমাকে সেটা শুনতে হতো না। এটাও কিন্তু একটা ব্যারিয়ার। এখানে আমি নিজেকে আমার মত করে এক্সপ্রেস করতে পারিনা। যেভাবে সমাজ চায় বা সমাজ আমাকে চিন্তা করে আমাকে সেভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে হয়।

YSSE: আপনার এই প্রতিবন্ধকতাগুলো কিভাবে ওভারকাম করেছেন?

আনুশা চৌধুরী: আমার কাছে সব সময় একটা জিনিস মনে হয়েছে, আমি আমার গোলটাকে দেখতে চাই এবং সেই গোলটা অর্জন করতে হলে যে ব্যারিয়ার গুলো আছে সেগুলো আমাকে ওভারকাম করে যেতে হবে। আমি নিজেকে আমার কম্পিটিটর বানাই। আই ওয়ান্ট টু বি আ বেটার পারসন। গত বছর আমি যা কাজ করেছিলাম তার থেকে এ বছর দুই গুণ বেশি কাজ করতে চাই। প্রথমে আমি আমার গোলটাকে ফিক্সড করি তারপরে ওই গোলটা অর্জন করার জন্য যে প্রতিবন্ধকতাই আসুক সেগুলো আমি ওভারকাম করার চেস্টা করি। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব করে কোন লাভ নেই, কোন পরিবর্তন হবে না। অনেকবার আমার মনে হয়েছে আমি কিছুই করতে পারিনি, আমি একজন ফেইলিয়র। যদিও আমি অনেক কিছু করেছি কিন্তু মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে আমি কিছুই করতে পারিনি এবং এই ফিলিংসটা ওভারকাম করা খুব কষ্টকর। নিজেকে বারবার বোঝাতে হয়েছে আমি অনেক কিছু করেছি এবং আমার কাছে অনেক সময় আছে অনেক কিছু করার।
আমাদের ইয়ুথদের উচিত নিজের সাথে কম্পিটিশন করা, যাতে নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে যাওয়া যায় প্রতিদিন। আর যখন আমরা নিজেকে নিজে বুঝতে পারি, নিজের দুর্বলতাগুলো, নিজের শক্তিমত্তাগুলো বুঝতে পারি, তখন নিজের ব্যারিয়ারগুলো ওভারকাম করা অনেক সহজ হয়। তাই নিজের প্রতি যদি একটা ক্লিয়ার ধারণা থাকে তাহলে তুমি যে কোন কিছুই ওভারকাম করতে পারবে।

YSSE: আপনার মতো যেসব তরুণরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চায়, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি থাকবে?

আনুশা চৌধুরী: আমার এখনো মনে হয় না আমি এডভাইস দেয়ার মত অনেক বড় হয়েছি। কিন্তু একটা suggestion দিতে চাই। Every failure takes you one step closer to success, আপনি যখন ফেইল করবেন তখন আপনি বুঝে নিবেন, আপনি সফলতার আরো একটু কাছে পৌঁছেছেন, যদি আমরা সহজেই কিছু পেয়ে যাই তাহলে ওই এচিভমেন্টের কোন মর্যাদা থাকে না। যখন আপনি ফেইল করবেন, ওই ফেইলিয়র থেকে শিখবেন এবং পরে সফলতা পাবেন তখন সে সফলতার যে মর্যাদা সেটা অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়।
So, My only advice is: Don’t give up, no matter what. You can change this world only when you can change yourself. The future belongs to those who believe in themselves.

লেখকঃ
আতিয়া আলম নিসা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট।
YSSE

এরকম আরও অনেক ব্লগ পড়ার জন্য ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *