“স্বপ্ন” বেশ অদ্ভুত একটা জিনিস, তাই না? কিছু মানুষ জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্ন দেখে আবার কিছু মানুষ ঘুমিয়ে। তবে জাগ্রত অবস্থায় মানুষ যে স্বপ্নগুলো দেখে, জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সেগুলোকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু হায়! সবার স্বপ্ন কী পূরণ হয়? কিন্তু নিজের স্বপ্ন পূরণ না হলেও অন্যের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ কয়জনই বা নেয়? আজ বলবো এমনই এক নারীর কথা, যিনি নিজের স্বপ্ন পূরণের ব্যর্থতা থেকেই আজ হাজারো নারীর স্বপ্নকে আগলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
YSSE : প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছি। আপনার জন্ম, পড়াশোনা, বেড়ে উঠা, বর্তমানে কী কাজ করছেন ইত্যাদি।
আমি ফারজানা সুলতানা লিমা। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কিশোরগঞ্জ শহরে। আমি LLB, LLM কমপ্লিট করেছি। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কোন পেশায় সংযুক্ত হতে পারিনি। বর্তমানে আমি একজন নারী উদ্যোক্তা। “রানীদের রাজ্য” কে ঘিরেই আমার সকল স্বপ্ন।
YSSE : আপনার উদ্যোগ “Queendom’s” সম্পর্কে জানতে চাইছি এবং এখানে আপনার কী কী দক্ষতা কাজে লাগাতে হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাইছি।
“রাণীদের রাজ্য” হলো সকল বয়সের নারীদের জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এখানে সকল বয়সের নারীরা তাদের ইচ্ছে এবং স্বপ্নগুলো নির্দ্বিধায় সকলের সাথে শেয়ার করতে পারেন। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে মেলার আয়োজনের মাধ্যমে লাখোপতি হচ্ছেন রানীদের রাজ্যের অনেক আপুরা। তাদের সহযোগিতার কথা চিন্তা করেই ইনশাআল্লাহ সামনে আরো অনেক কিছু করে যেতে চাই।
YSSE : উদ্যোগ এর শুরুটা কীভাবে? উদ্যোক্তা হবার পিছনে কি আপনার কোনো বিশেষ কারণ রয়েছে?
উদ্যোগের শুরু বলতে আসলে, আমার মাঝে সবসময়ই কিছু করার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু নানারকম প্রতিবন্ধকতার কারণে আমি কোনো ধরনের কাজেই সম্পৃক্ত হতে পারিনি। আমার কষ্ট লাগতো যখন বুঝতাম যে, বর্তমান যুগে নারীদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মতো সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমি কিছু করতে পারছি না। কিন্তু কিছু একটা করে দেখানোর সুপ্ত ইচ্ছাটা আমার মাঝে সবসময়ই জেগে উঠতো। তো একসময় চিন্তা আসে যে প্রতিভাবান যেসকল নারীরা আমার মতো সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কিছু করতে পারছেন না, তাদেরকে নিয়েই একটা কিছু শুরু করা যাক। এই তো সেই সময় থেকেই শুরু হয় আমার উদ্যোগ “রানীদের রাজ্য” এর পথচলা।
YSSE : আপনার এই উদ্যোগকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসতে আপনার কোনো সহযোগী বা সহকর্মীর ভূমিকা আছে?
জীবনে চলার পথে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যায় যাদের সহযোগিতার কথা আমরা কখনো ভুলতে পারি না। তেমনি আমার এই প্রতিষ্ঠানকে এই পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে কিছু সহকর্মী আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তারা সবসময় আমার পাশে ছিলো বলেই হয়তো আজ আমি এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি এবং আমার রাণীদের রাজ্যকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসতে সফল হয়েছি৷ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা আমি আজীবন প্রকাশ করবো।
YSSE : “উদ্যোক্তা মানেই ঝুঁকিগ্রহণ”- উদ্যোক্তা হিসেবে শুরুতে আপনি কেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছেন এবং আপনার উদ্যোগের ঝুঁকিগুলো মোকাবেলা করেছেন?
হ্যাঁ, আসলেই একজন উদ্যোক্তা কে সবসময় ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় একজন উদ্দ্যোক্তাকে। আমিও নানারকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলাম এবং এখনো হচ্ছি। তবে আমার মতে একজন উদ্যোক্তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে ধৈর্য ধারণ করা। একজন উদ্যোক্তা যদি মাঝপথে এসে হাল ছেড়ে দেয় তাহলে তার উদ্যোগটি কিন্তু সেখানেই ইতি টানে। কিন্তু ধৈর্যের সাথে, সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে পারলে, একদিন না একদিন সফলতার দেখা মিলেই এবং আমি কথাটা বিশ্বাস করি বলেই হয়তো আমি “রানীদের রাজ্য” কে এই পর্যন্ত আনতে পেরেছি।
YSSE : আপনার উদ্যোগের পিছনে কিংবা আজকের ” Queendom’s” এর পিছনে আপনার সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে কে বা কারা?
আমার এই উদ্যোগের পিছনে কম-বেশি সকল সহকর্মীই আমাকে বেশ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে “রানীদের রাজ্য” প্ল্যাটফর্মের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে আমার দুইজন সহকর্মী।
YSSE : বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন উদ্যোক্তার টিকে থাকা কতটা প্রতিযোগীতামূলক বলে আপনি মনে করেন? এজন্য আপনি কি পন্থা অনুসরণ করেছেন?
আসলে বর্তমান যুগটা হচ্ছে ই-কমার্সের যুগ। ই-কমার্স হওয়ায় ছোট বড় সকল ধরনের উদ্যোক্তাদের কাজটা অনেকাংশেই সহজ হয়ে গেছে। একজন উদ্যোক্তা সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে যদি তার উদ্যোগটি শুরু করে এবং যদি অনলাইনের বিভিন্ন টুলস সম্পর্কে তার ভালো একটা ধারণা থাকে তাহলে তার কাজটা অনেকাংশেই সহজ হয়ে যায়। অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমের কারণে এখন যে কেউ যেকোন প্রান্ত হতে নিজের ব্যবসার একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে নিতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে গ্রাহকরা এক জিনিস দেখে অনলাইনে অর্ডার করে, কিন্তু হাতে পায় অন্য জিনিস অর্থাৎ পণ্যের মানে তারতম্য থাকে। এই কারণে কিন্তু গ্রাহকরা অনলাইনে কেনাকাটা করার আগ্রহটা হারাচ্ছে।
কিন্তু আমাদের প্ল্যাটফর্ম “রানীদের রাজ্য” তে যে সকল উদ্যোক্তারা রয়েছেন, তারা কিন্তু তাদের নিজেদের পণ্যের মান নিয়ে খুবই সচেতন এবং অনেকেই পণ্যের মান, গুণাগুণ ঠিক রাখতে বেশ পরিশ্রম করেন। এই একটা কারণেই কিন্তু অনেক গ্রাহকের আস্থা জুগিয়েছে আমাদের পরিশ্রম “Queen’s dom” বা “রানীদের রাজ্য” প্ল্যাটফর্মটি।
একইসাথে আমরা বিভিন্ন উৎসবে অনলাইন বা অফলাইন মেলার আয়োজন করে থাকি৷ সেখান থেকেও অনেক উদ্যোক্তা বেশ লাভবান হয়ে থাকেন।
YSSE : আপনার উদ্যোগের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাইছি।
আমার উদ্যোগের লক্ষ্য বলতে, আমাদের সকলের পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত “রানীদের রাজ্য” প্ল্যাটফর্মটিকে আমি সকলের মাঝে তুলে ধরতে চাই। যেসকল নারীদের কিছু করার ইচ্ছা রয়েছে, কিন্তু কোনোরকম সাহায্য পাচ্ছে না বা বুঝতে পারছে না কিভাবে তার কাজটা শুরু করবে, আমি সেই সকল নারীদের উদ্যোগের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়নে সাহায্য করতে চাই। এই কাজটা এখনো করছি এবং সামনেও করে যেতে চাই।
আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, আর্থিক বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত পুরুষরাই নিয়ে থাকেন এবং নারীদের মতামত সেখানে অনেক সময়ই অগ্রাহ্য করা হয়। কিন্তু আমার স্বপ্ন হচ্ছে, সকল নারীদের আর্থিকভাবে ক্ষমতায়নে সহযোগিতা করা এবং তারাও আর্থিক বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে এই মনোভাবটা তাদের মাঝে তৈরি করে দেয়া।
YSSE : আপনার কোন বিশেষ গুণের জন্য আপনার নিজেকে মনোনয়ন যোগ্য মনে হয়?
“নারী” এই দুই অক্ষরের শব্দটার ভাঁড় কিন্তু অনেক। একজন নারীর সাথে অনেক বিষয় জড়িত থাকে৷ মাতৃত্ব, সন্তান, পরিবার-পরিজনের আস্থা জুগিয়ে চলা এবং সবকিছুকে আগলে রাখা একজন নারীর পক্ষে সহজ কোনো বিষয় নয়। এসব বিষয় পালন করতে করতেই অনেক নারী তাদের নিজেদের স্বপ্নটাকে ভুলে যায়৷ তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে অবশ্যই।
আমাদের সমাজে একজন নারী প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে তাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। অনেক বাধা-বিঘ্ন পার করেই তাকে এগিয়ে যেতে হয়। অনেক নারী হয়তো মাঝপথেই থেমে যেতে বাধ্য হয়, ছেঁড়ে দেয় নিজের স্বপ্নটাকে। কিন্তু যে নারী মনোবল নিয়ে, নিজের প্রতি আস্থা রেখে সকল বাধা কাটিয়ে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে সেই নারীই সফল। আমিও একজন নারী এবং এই কথাগুলো আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাকেও অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছি। তবুও আমি আমার স্বপ্ন “রানীদের রাজ্য” প্ল্যাটফর্মকে এই পর্যন্ত আনতে পেরেছি। আমার মধ্যে বাধাগুলো কাটানোর মতো মনোবল, আত্মবিশ্বাস ছিলো বলেই পেরেছি। এই গুণগুলোর জন্যই আমি নিজেকে মনোনয়ন যোগ্য মনে করি।
YSSE : আপনার উদ্যোগ “Queendom’s” এ এই পর্যন্ত কি কি সাফল্যের দেখা মিলেছে?
আমাদের প্ল্যাটফর্ম এর বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে এবং আমাকে নিয়েও বেশ কয়েকটি নিউজ করা হয়েছিলো 24.com এ। “নারী লেখক সোসাইটি” হতে আমি সম্মাননা পেয়েছিলাম। এছাড়া “আইডিয়াল বাংলাদেশ” হতেও উদ্যোক্তা হিসেবে সম্মাননা পেয়েছিলাম এবং আমাদের “রানীদের রাজ্য” নিয়ে একটি আর্টিকেল ছাপানো হয়েছিলো তাদের ম্যাগাজিনে। “দৈনিক পূর্বকন্ঠ” এর মতো জাতীয় পত্রিকাতেও আমাদের প্ল্যাটফর্ম নিয়ে লেখা হয়েছে। এই পাওয়াগুলো আমার কাছে কোনোটাই কোনো অংশে কম নয়।
YSSE : আপনার নিজের সফলতার পিছনের তো অবশ্যই অনেক গল্প রয়েছে, এমন কোনো ভালো লাগার গল্প আছে যা আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান, হোক সেটা ভালো লাগার বা কষ্টকর!
আসলে একটা সফলতার পিছনে অনেক গল্পই থাকে, ভালো লাগার গল্প অবশ্যই থাকে, কিন্তু কষ্টের অভিজ্ঞতাটাই মনে থাকে আজীবন। আমি আপনাদের সাথে আজকে আমার একটা কষ্টের অভিজ্ঞতাই শেয়ার করি।
আসলে এই “রানীদের রাজ্য” প্ল্যাটফর্ম শুরু করার আগে, আমার একটা নিজস্ব শো-রুম দেয়ার ইচ্ছা ছিলো। তো ইচ্ছানুসারেই আমি শো-রুমের জন্য একটা সুন্দর জায়গা বাছাই করে নিয়ে নেই এবং মোটামুটি আমার কাজ শুরু করার পরিকল্পনা ছিলো। ঘটনাটা মূলত করোনাকালীন সময়ের। সেই সময়ে আমার এই স্বপ্নকে পূরণ করা কিছুটা অসম্ভব ছিলো, কিন্তু আমি তাও হাল ছাড়তে চাইনি৷ জায়গাটার ভাড়া আমি বেশ অনেক মাস পর্যন্তই দিয়েছিলাম, কিন্তু নানারকম প্রতিবন্ধকতার কারণে আমি এক সময় এই জায়গাটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। আমার নিজস্ব শো-রুম দেয়ার স্বপ্নটা সেখানেই অপূর্ণ থেকে যায়৷ সেখান থেকেই মূলত আমার ধারণা আসে যে, আমার মতো যেসকল নারীরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারছে না, আমি সেই সকল নারীদের সাহায্য করবো। নিজের স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থতার কষ্ট যাতে অন্য কোনো নারীকে না পেতে হয় সেই কারণেই মূলত আমার এই “রানীদের রাজ্য” প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।
YSSE : “Queendom’s” নিয়ে যদি আপনাকে কোনো স্লোগান দিতে বলা হয় তাহলে সেই স্লোগানটি কী হবে?
“কি হে নারী
ভয় কিসের,
উন্মুক্ত আছে দ্বার, শুধু বাকি তোমার প্রচেষ্টার।”
যেহেতু “রানীদের রাজ্য” সব বয়সের নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার একটা উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, নিজেদের কাজ সবার মাঝে তুলে ধরার একটা প্ল্যাটফর্ম, তাই সব বয়সের নারীরাই শুধু একটু নিজেরা চেষ্টা করলেই এখানে তাদের কাজটা সবার মাঝে তুলে ধরতে পারে, তাদের কাজ আরো এগিয়ে নিতে পারে। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য্য, মনোবল এবং আত্মবিশ্বাসের।
YSSE : আপনার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো নারী উদ্যোক্তা হতে চাইলে আপনি তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
আমার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যদি তরুণ সমাজের কোনো নারী উদ্যোক্তা হতে চায়, তাহলে আমি বলবো অবশ্যই তাকে সততা এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। তার বাধাবিপত্তি মোকাবেলা এবং ঝুঁকি গ্রহণের মতো মানসিকতা থাকতে হবে। যদি সাহসের সাথে তার কাজটা শুরু করে, ধৈর্য্য নিয়ে কাজটা চালিয়ে যেতে পারে তাহলে একদিন না একদিন সফলতার দ্বারপ্রান্তে অবশ্যই পৌঁছাবে বলে আমার বিশ্বাস। শুভকামনা রইলো সেইসব নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি।
“কি হে নারী
ভয় কিসের,
উন্মুক্ত আছে দ্বার, শুধু বাকি তোমার প্রচেষ্টার।”
-ফারজানা সুলতানা লিমা
” আরো ব্লগ পড়তে এখানে #ক্লিক করুন।
Writer,
Diderul Islam
Intern, Content Writing Department
YSSE