আমাদের জীবনে চলার পথে কখনো না কখনো মানসিক অবসাদ এসেছে। আমরা নিজেদেরকে বিষন্নতার দিকে ডুবে যেতে দেখি।

এই অবসাদ আসতে পারে পেশাগত জীবনের চাপ থেকে, দীর্ঘদিন বেকার অবস্থায় থাকার ফলে, পারিবারিক অশান্তি, কলহ, নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনসঙ্গী না পাওয়ার ফলে আরও বিভিন্ন কারণে। জীবনের এই ধাপ গুলো আমাদের মনের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন সময়ে আমরা জীবনে চলার পথে উত্থান পতনের সম্মুখীন হই। যাইহোক অবসাদকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই, কারণ এটি আমাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে। মানসিক অবসাদ একজন মানুষকে সবসময় ক্লান্ত অনুভব করায় এবং তাকে ঘরকুনো করে দেয়। জীবনে বেচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে যায়।

মানসিক অবসাদ নিরব ঘাতক হয়ে একজন ব্যাক্তির জীবনকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। অনেকাংশেই মানসিক অবসাদে থাকা মানুষ নিজেকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। সূক্ষ্মভাবে একজন ব্যাক্তির জীবনিশক্তিকে নাশ করে দেয়। অপরপক্ষে অবসাদ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলে যেমন:- স্থুলতা, খিটখিটে মেজাজ, যেকোনো বিষয়ে বিরক্তি, ক্ষুদা হ্রাস, যা শারীরিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানসিক অবসাদ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। মাত্রাতিরিক্ত ধুমপানের ফলে যতটা ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশী ক্ষতি হয় অবসাদের কারণে। অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, সক্রিয়ভাবে এটির মোকাবেলা করতে হবে। অবসাদ থেকে বের হবার উপায় খুজে বের করতে হবে। অতিদ্রুত অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, পরবর্তীতে এর প্রভাব নেতিবাচক হবে। নতুন জেনে অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার কিছু পদ্ধতি :

১. মিউজিক থেরাপি:

অবসাদগ্রস্ত লাগলে গান শুনুন। আপনার সব প্রিয় গানগুলো শুনতে থাকুন বারংবার। অবসাদ কাটাতে সবথেকে ভালো অস্ত্র এটা। গ্রেট ব্রিটেনের ব্রোন মাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুইনস বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে ২০১১ থেকে ২০১৪ অব্ধি “মিউজিক থেরাপি” নিয়ে গবেষণা চালিয়েছিলো। ২৫১জন ব্যক্তিদের নিয়ে কাজটি করে তারা। এদেরকে ২ ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়, তাদের মধ্যে ১২৮জনকে সাধারণভাবে যত্ন করা হয় এবং বাকিদের মিউজিক থেরাপি দেয়া হয়। সাধারণ যত্নের তুলনায় যাদের মিউজিক থেরাপি দেয়া হয়েছে তারা খুব জলদি সুস্থ হয়ে উঠেছে, অবসাদও কাটিয়ে উঠেছে। আজকাল মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা হচ্ছে। পজিটিভ গান শুনলে চারপাশটা পজিটিভ এনার্জিতে ভরে থাকে। তাই গান শুনুন। দেখবেন নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে। মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে অবসাদ অনেকটাই কেটে যায়।

২. ডার্ক চকোলেট:

মানসিক অবসাদ দূর করার ক্ষেত্রে জাদুর মতো কাজ করে ডার্ক চকলেট। এটি মনের মধ্যে রাসায়নিক প্রভাব ফেলে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি সম্পূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং অল্প পরিমানে খেলে স্ট্রেস হরমোন নিসঃরন কমে যায়। এটিতে বাড়তি কোনো চিনি নেই, তাই এটি স্বাস্থ্যসম্মত। নিয়মিত এক টুকরো ডার্ক চকোলেট খেলে অবসাদ দূর হয়।

৩. ব্যায়াম করুন:

ব্যায়াম হলো মানসিক অবসাদ দূর করার একটি উত্তম উপায়। দিনে কিছুক্ষন ব্যায়াম করতে পারলেই অনেক উপকার মিলে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির উচিত প্রতিদিন কমপক্ষে ২০-৬০ মিনিট ব্যায়াম করা। ৩০ মিনিট স্বল্পমাত্রার কাজের মাধ্যমেও আপনি আপনার মানসিক অবসাদ দূর করতে পারেন, যেমন: সিড়ি দিয়ে উঠানামা করা, নাচা, শিশুদের সাথে খেলাধুলা করা, অল্প পথ হাটা ইত্যাদি। কাজ করার মাধ্যমে আপনার শরীর সম্পূর্ণভাবে সচল থাকে, এতে আপনি সস্তি অনুভব করবেন। মন ভালো রাখতে কাজ করে এন্ডোর্ফিন নামক এই হরমোন। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে তাদের শরীরে এই হরমোন ক্ষরণ হয়। তাই মানসিক অবসাদ দূর করতে বেশী বেশী ব্যায়াম করুন।

৪. খাবার গ্রহনে পরিবর্তন আনুন:

মানসিক অবসাদ এড়াতে বেশী পরিমানে ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। অবসাদ এড়াতে কখনো ডায়েট করবেন না। একটি সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। রোজ ১৫০০ এর নিচে ক্যালরি গ্রহণ করবেন না। শরীরের প্রয়োজনে চাইলে আপনি আরও ১০০০ ক্যালরি বেশি গ্রহণ করতে পারেন। অবসাদ এড়াতে নিন্মোক্ত খাবার গুলো গ্রহণ করতে পারেন। 

  • সামুদ্রিক মাছ: অবসাদ দূর করতে নিয়মিত খান তৈলাক্ত মাছ। এসব মাছে থাকে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড যা মানসিক অবসাদ দূরে সাহায্য করে।
  • বাদাম : কাজু, আখরোটের মতো বাদাম খেতে পারেন অবসাদ এড়াতে। এগুলো তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড। সবচেয়ে বেশি উপকার পাবেন আখরোট খেলে। প্রতিটি দিন ১/৪কাপ আখরোট আপনার অবসাদ অনেকটাই কমিয়ে দিবে।
  • অ্যাভোকাডো: এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন যা মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এটি খেলে স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ হয়ে অবসাদ হবার সম্ভাবনা কমায়।
  • গরম দুধ: এক গ্লাস গরম দুধ খেলে রাত্রে ঘুম ভালো হয় বলে জানিয়েছে খাদ্য বিশেষজ্ঞরা। শুধু ভালো ঘুমের জন্যেই নয়, মানসিক অবসাদ কাটাতেও উষ্ণ দুধের জুড়ি নেই। উষ্ণ দুধকে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ বলা হয়। যা মেজাজ শিথিল করতে সাহায্য করে।
  • ফাইবার যুক্ত খাবার: ফাইবার যুক্ত খাবার স্ট্রেস, হরমোন কমাতে সাহায্য করে। তাই রোজ পর্যাপ্ত পরিমাণে তাজা ফল, শাকসবজি, বাদাম খেতে হবে।
  • মুরগীর মাংস: মুরগীর মাংসও কমায় অবসাদ ঝুঁকি। মুরগীর পাজরের মাংসে রয়েছে অনেক বেশী ট্রিপটোফ্যান, যা সেরোটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে। এতে ঘুম ভালো হয় আর মনও ভালো থাকে।
  • দই: রোজ দই খেলে শরীরের সারোটিনিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এটি স্ট্রেস হরমোন কমানোর পাশাপাশি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

এছাড়াও পালংশাক, রসুন, টমেটো, নারকেল ইত্যাদি স্ট্রেস হরমোন কমাতে সাহায্য করে। 

৫. একঘেয়েমি পরিহার: 

দিনের শুরুতে একটি দিনলিপি তৈরি করে ফেলুন। দৈনন্দিন কর্মসূচি এভাবে তৈরি করতে হবে যেনো কাজে একঘেয়েমি না আসে। কর্মসূচিতে যেনো আনন্দপূর্ণ ও বৈচিত্র‍্যপূর্ণ কার্যক্রম থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ডায়েরি লিখার অভ্যাস গড়ে তুলুন। দিনের সব ভালো কথাগুলো লিখে রাখুন, সেসব কথা যার কারণে আপনার মন ভালো হয়েছিলো।

৬. বিশ্রাম ও ঘুম:

শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ঠিকমতো চালাতে পর্যাপ্ত ঘুম খুব প্রয়োজন। দেহের ক্ষয়পূরনের জন্য যেমন পরিমিত আহারের প্রয়োজন ঠিক তেমনি অবসাদ দূর করার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত ঘুম। বিশ্রাম ও ঘুমের ফলে দেহ ও মস্তিষ্কের অবসাদ দূরীভূত হয় এবং পূণরায় নতুন উদ্যোগে কাজ করার স্পৃহা জন্মে। গভীর রাত অব্ধি জাগার অভ্যাস ত্যাগ করে জলদি ঘুমিয়ে পরার অভ্যাস গড়ে তুলুন। 

মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখুন, অনেকসময় দেখা যায় মানুষ অবসাদে ভুগলে যোগাযোগ বিছিন্ন করে রাখে। তাই যোগাযোগ বন্ধ না রেখে, বাড়ির বাইরে বের হয়ে মানুষের সাথে মিশুন।  একা সময় কাটাবেন না। আপনার প্রিয় মানুষগুলির সাথে যোগাযোগ ধরে রাখুন। কর্মক্ষেত্রে যেকোন ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য নিজেকে নিজে পুরস্কৃত করুন। আমাদের জীবন হলো আমাদের মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ঠিকমতো চিন্তার মাধ্যমে আপনি যেমন কোনো কাজ নিরস করতে পারেন ঠিক তেমনি আনন্দদায়কও করে তুলতে পারেন। আনন্দদায়ক করে তুলতে কাজের ভালো দিক গুলো ভাবুন, তাহলেই আপনি জীবনে উন্নতির শিখরে পৌছে যাবেন। নিজেকে অবসাদ থেকে বের করে আনুন। সমস্যা যাই হোক সমাধান আছে। তাই মানসিক চাপে ডুবে না থেকে, ভাবুন সমাধান মিলবে। জীবনের প্রতি মুহূর্ত উপভোগ করুন। জীবন সুন্দর। 

আরও ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।

লেখক 

অনামিকা ঘোষ শ্রেয়া 

ইন্টার্ণ, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE