বিশ্বের বিষ্ময়কর এবং রহস্যময় অঞ্চলগুলোর মধ্যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অন্যতম। এই অঞ্চল ঘিরে রয়েছে অজানা অনেক চাঞ্চল্যকর রহস্য। এই অঞ্চলটি  “ডেভিল সী” বা “শয়তানের দ্বীপ” নামেও অনেকের কাছে পরিচিত। এই অঞ্চলের বিশেষ রহস্য হলো এই অঞ্চলে প্রবেশকৃত উড়োজাহাজ, জাহাজ, পাল তোলা নৌকার হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। আরো বিষ্ময়কর রহস্য হলো এই অদৃশ্য হওয়া উড়োজাহাজ, জাহাজ, পাল তোলা নৌকার ফেরত না আসা। 

কেন এসকল ঘটনা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে ঘটে? কী এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল? রহস্যের অন্তর্জালে ঘেরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের প্রকৃত সত্য কী? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল: বারমুডা থেকে পুয়েরটা রিকো, সেখান থেকে গালফ অব মেক্সিকোর যেকোনো বিন্দু থেকে আবার বারমুডা পর্যন্ত রেখা টানলে যে ত্রিকোণাকার রেখার অঞ্চল পাওয়া যাবে সেটিই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। এই অঞ্চলে কোনো মানুষের বসবাস নেই বললেই চলে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় অস্বাভাবিকভাবে নিখোঁজের ঘটনা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে “দ্য মিয়ামি হেরাল্ড” নিবন্ধে। প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে “জুয়ান ডি বারমুডেজ” বারমুডা দ্বীপটি আবিষ্কার করেন।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে ঘটে যাওয়া কিছু রহস্যময় ঘটনা

নিখোঁজ সাইক্লোপস: ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ। ইউএস নেভির যুদ্ধ জাহাজ সাইক্লোপস। হঠাৎ করেই প্রায় ৩০০ যাত্রী নিয়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় উধাও হয়ে গেল জাহাজটি।

৫টি টিবিএম অ্যাভেঞ্জার বিমান নিখোঁজ: ১৯৪৫ সালের ৫ই ডিসেম্বর। সেদিন এক বিশেষ মহড়ায় অংশ নিয়েছিল ৫ টি বিমান। বিমানগুলোতে ছিল ১৪ জন অভিজ্ঞ পাইলট। আটলান্টিক দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল বিমানগুলো। ৫ টি একসাথে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা আজও রহস্য।

নিরুদ্দেশ স্টার টাইগার: ২৯ জানুয়ারি, ১৯৪৮। ২২ জন যাত্রী ২ জন ক্রু নিয়ে বারমুডার উদ্দেশ্যে রওনা দেই “স্টার টাইগার” বিমান। সবকিছু ছিল একদম ঠিকঠাক। আবহাওয়াও ছিল পরিস্কার। কিন্তু বারমুডা অঞ্চলে প্রবেশ করতেই বিমানটির সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় কন্ট্রোল টাওয়ারের। এরপর চিরতরে হারিয়ে যায় বিমানটি।

নিখোঁজ ডিসি-৩: ৩২ জন যাত্রী নিয়ে আমেরিকার মিয়ামি শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল ডিসি-৩। কিন্তু বারমুডা অঞ্চলে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়ে যায় এটি।

ইয়র্ক ট্র্যান্সপোর্ট নিখোঁজ: ইয়র্ক ট্রান্সপোর্ট একটি ব্রিটিশ বিমান। বিমানটি যাচ্ছিল জ্যামাইকা। কিন্তু যাওয়ার পথেই অদৃশ্য হয়ে যায় বিমানটি। আজও কেউ এর সন্ধান পাওয়া যায় নি।

প্রকৃত সত্যের সন্ধানে

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে অগণিত রহস্য। এসকল রহস্যর ব্যাখা কিছু ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক, কিছু ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক। অনেকের মতে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে প্রবেশের পর কম্পাসের কাঁটা বিকল হয়ে যায়। তাছাড়া জাহাজ, বিমান, বড় নৌকাগুলো স্বীকার হয় ঝড়ের। নিখোঁজ হয়ে যায় অজানা কোনো গন্তব্যে। এই রহস্যে উদঘাটনের কাল্পনিক ব্যাখাগুলো হলো: এলিয়েনের আক্রমণ, ইন্টার ডায়মেনশনাল ডোর, ডার্ক এনার্জি, ওয়ার্ম হোল ইত্যাদি। এই কাল্পনিক ব্যাখাগুলো কেবল মানব মস্তিষ্কের কল্পনার যুক্তিতেই গড়া। এগুলোতে কোনো আসল সত্য নেই। তাছাড়া বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো অতিরঞ্জিতভাবে ব্যাখা করা। আর যেহেতু মানুষের আগ্রহ অতিরঞ্জিত জিনিসের প্রতিই বেশি তাই তারা কাল্পনিক ব্যাখার উপরই বেশি নির্ভরশীল।

তাহলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল ঘিরে তৈরি হওয়া রহস্যগুলোর বৈজ্ঞানিক এবং প্রাকৃতিক ব্যাখাগুলো কী? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

ভৌগোলিক অবস্থান: বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অবস্থান আর্টলান্টিক মহাসাগরে যা তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এই এলাকায় প্রতিনিয়তই লেগে থাকে বড় বড় ঝড়। বিশেষ করে, হারিকেনসমূহ বেশিরভাগ এই এলাকার আশেপাশেই সৃষ্টি হয়। যার ফলে এই এলাকা দিয়ে যাওয়া জাহাজ এবং বিমানগুলোকে সম্মুখিন হতে হয় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার।

প্রাকৃতিক চৌম্বকের বৈচিত্র্য: বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল ঘিরে যত কাহিনি প্রচলিত আছে তার মধ্যে অধিকাংশেই বর্ণিত আছে প্রত্যক্ষদর্শীরা কম্পাসের বৈচিত্র্যর সম্মুখীন হয়েছেন। এর কারণ হতে পারে, মেরুগুলোর সাথে প্রাকৃতিক চৌম্বকের বৈচিত্র্য। এছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এর কারণ হতে পারে। যদিও গবেষণা করে, বারমুডা এলাকায় কম্পাসের কাঁটার বৈচিত্র্য দেখা যায় নি। তাই বলা যায়, হয়তো কাহিনিগুলো ভুলভাল ব্যাখার মাধ্যমে অতিরঞ্জিতভাবে গড়া।

মিথেন হাইড্রেট গ্যাস: মিথেন হাইড্রেট একধরনের প্রাকৃতিক গ্যাস। বারমুডা অঞ্চলের সমুদ্র তলদেশে রয়েছে এই গ্যাসের আধিক্য। এই গ্যাস জলের ঘনত্ব হ্রাস করতে ভূমিকা রাখে। আর জলের ঘনত্ব হ্রাস পাওয়ার কারণে সৃষ্টি হয় উপসাগরীয় স্রোত যা একটি জাহাজকে খুব সহজেই ডুবিয়ে দিতে পারে।

সমুদ্রের গভীরতা: বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অঞ্চলের সমুদ্র প্রায় ৮ ফিট গভীর। যার ফলে কোনো জাহাজ ডুবে গেলে বা সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গেলে তার সন্ধান পাওয়া দুস্কর বললেই চলে। 

উপসাগরীয় প্রবাহ: আটলান্টিক মহাসাগর জুড়েই প্রবাহিত হয় উপসাগরীয় প্রবাহ। যা একটি ভাসমান বস্তুকে দূরে নিয়ে যেতে সক্ষম। যার ফলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া জাহাজগুলো ঐ এলাকায় না থেকে, ভেসে অন্য কোনো জায়গায় চলে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত ব্যাখা।

স্বভাবতই রহস্যের প্রতি বিশেষ টান মানুষের রয়েছে। তারা জানতে চাই সকল সত্য। তারা করতে চাই সকল বিষ্ময়কর রহস্যময় জিনিসের সঠিক সমাধান। আর এই সমাধান করতে গিয়ে তারা যুক্তিকে ছাড়িয়ে নির্ভর করে অযৌক্তিক ব্যাখায়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এসকল রহস্যের মধ্যে একটি। যাকে ঘিরে সত্য থেকে ফ্যান্টাসিই বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানিদের উচিত বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে গবেষণা চলমান রাখা এবং যুক্তির আধারে গড়া প্রকৃত সত্য সবার সামনে নিয়ে আসা।

 

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

 

লেখক

প্রত্যয় কান্তি দাশ

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE