রূহি কথায় আমরা সাত ভাই বোন অত্যন্ত কৌতুহলের সহিত বাড়িতে প্রবেশ করলাম।  বাড়িটা শুধু অনেক বড় নয়, ভয়ানক ধরণের আশ্চর্য সুন্দরও।  

আমরা সকলে বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর এর সৌন্দর্যে আশ্চর্য হচ্ছিলাম।  সত্যি কি এমন সুন্দর বাড়ি হতে পারে দুনিয়ায়। নানা ধরণের কারুকাজের শোপিজ, সুন্দর সেগুন গাছের খোদাই করা আসবাবপত্র আরো কত কি!

বাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে কে যে কোন দিকে চলে গেলাম কেউ জানি না।  আমি আর আমার ছোট বোন শ্রেয়া একসাথে ছিলাম। হঠাৎ আরেকটি মেয়ে বের হয়ে আসলো অন্য রুম থেকে। তার নাম কৃতি” আমরা ততক্ষণে পিশাচ এর অপশক্তির মায়ায় জর্জরিত।  আমাদের আকস্মিক জ্ঞান তাতেই লোপ পেয়েছে।  তাই রোহিনী যে এক নরপিশাচ তা ভূলেই গেলাম।  

 

মেয়েটি আমাদের একটি সুন্দর রুমে নিয়ে গেলো। কিন্তু সেই রুমের প্রতিটা জিনিষ দেখে ভয়ানক ধরণের অদ্ভুদ মনে হলো।  কৃতি থেকে জিজ্ঞেস করলাম আমি, সে কবে থেকে এই বাড়িতে থাকছে। কিন্তু কৃতি এই প্রশ্নের জবাবে নিশ্চুপ হয়ে কেবল হাটছে।  প্রশ্নের জবাব আর দিলো না। কোন এক ছলে আমি আর কৃতি গল্প করা শুরু করলাম।  কৃতি মেয়েটা একদম ভয়ানক ধরণের সুন্দর।

যেন কোন দেব- অপসরা।  যতই তার সাথে গল্প করছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।  তার সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে আমার ছোট বোন আমায় ছেড়ে অন্য রুমে চলে গেলো তাতে আমার কোন হুশ নেই। 

যেন হঠাৎ তখনই শ্রেয়া পাশের রুমে ঢুকেই কিছু একটা ভয়ানক দেখে চিৎকার করে উঠলো।  সাথে সাথেই আমি, শিবু, নিশি, রক্তিম, প্রীতম ও কৃতি ছুটে গেলাম পাশের রুমে।  

 

এসে দেখি একটি কঙ্কাল ঝুলে আছে।  কঙ্কালটি বিশ্রি ধরণের। আমরা সকলে প্রথমে কঙ্কাল টিকে দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।  কিন্তু যত তাড়াতাড়ি ভয় পেয়েছিলাম তত তাড়াতাড়িই ভয় কেটে ও গেলো।  

রুমটি শ্রেয়ার খুবই পছন্দ হয়। মজার ছলে ভুলেই গেলাম যে,  আমরা যে কত বড় বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।  

আমাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন রুম পছন্দ হলো।  প্রত্যেকটি রুমই অদ্ভুদ ধরণের জিনিষ পত্র দিয়ে সাজানো।  হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম বাড়ির প্রতিটা রুমের জিনিষ ভিন্ন হলেও সব রুমে খুব মিল পাওয়া যাচ্ছে।  সেটা হলো তার রং।  

 

“এই বাড়িটির সবচেয়ে অভুদ বিষয় হলো এখানকার সকল জিনিষের রং সাদা এবং কালো”

 

হঠাৎ বাড়িটা আমার যেন কেন রহস্যজনক মনে হওয়া শুরু করলো। ঘুরতে ঘুরতেই আমার সাথে শিবুর দেখা হয়ে গেলো।  সে আমার সাথে সাথে থাকা শুরু করলো।  আমরা সবাই একসাথে হলাম ও একসাথে ঘুরছিলাম। শুধু মাত্র ঐশীরই কোন খোঁজ পেলাম না।  

আমরা শেষমেশ প্রত্যেকের পছন্দের রুম গুলো ঘুরে ফিরে দেখে আরেকটি রুমের দিকে চোখ পড়ল। বাড়িটিতে যেন রুমের শেষই হচ্ছে না।  এক রুমে ঢুকলেই মনে হয় অন্য আরেকটি রুমে কোথা থেকে উদয় হচ্ছে। 

যেন এক ভুতুড়ে কর্মকান্ড।  

আমরা সকলেই সেই রুমে ঢুকলাম। ঘরটা ঘুরতেই আমাদের হঠাৎ চোখ পড়লো ঘরটির ওয়াসরুমের দরজায়।  ভেতর থেকে ঝর্ণার আওয়াজ হচ্ছে আর মনে হচ্ছে যেন কেউ লাফাচ্ছে।  হঠাৎ সবাই লক্ষ্য করলাম ভেতর থেকে অনেক রক্ত বেড়িয়ে আসছে।  আমরা ভয়ে কেউ এগিয়ে যেতে সাহস টা করলাম না।  আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচাইতে বেশি সাহসী ছিল শিবু।  সে দরজা খুলবার জন্য এগিয়ে গেলো। 

দরজা খুলতেই আমরা যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।

 

দরজার খোলার পর দেখলাম একটা শর কাটা মরদেহ মেঝে তে লেপ্টে আছে তা থেকে রক্ত বের হচ্ছে।  হঠাৎ  আমার মেয়েটির জামার দিকে লক্ষ্য গেলো।  দেখেই মনে হলো যেন এটি ঐশীর জামা৷

সাহস করে ওয়াসরুমে প্রবেশ করলাম।  ঢুকেই  দেখলাম মরদেহটা আর কারো নয় বরং ঐশীর। আমরা সবাই ভয়ে গুমসুম হয়ে গেলাম।  

আমরা সবাই কৃতিকে দেখে অবাক হলাম।  কিভাবে সে এত বড় ভয়ানক বাড়িটিতে একা একা থাকে।  হঠাৎ মনে পড়লো সে তো একা নয় তার সাথে রূহি নামের একটার মেয়েও তো ছিলো। লক্ষ্য করলাম আমরা প্রত্যেকে ভয় পেলেও কৃতির মাঝে কোন ভয়ের ছিটেফোটাও বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই।  তার মাঝে কোন ভয় বলতে কিছুই ছিল না।  আমরা আর কি করবো না বুঝে বাড়ি থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্য করে করে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম।  হঠাৎ আমি পাশে তাকিয়ে দেখি আমার ছোট বোন শ্রেয়া নেই।

 

(প্রীতম, নিশি, রক্তিম ও শিবুকে) তাদেরকে শ্রেয়াকে খুজতে বললাম কিন্তু ভয়ে তারা স্তব্ধ হয়ে গেছে।  কেউ এক পাও নড়লো না।  আমার তো পাগল পাগল অবস্থা।  এক রুম থেকে অন্য রুমে ছুটতে থাকলাম শ্রেয়ার খুঁজে। হঠাৎ সেই সময় বাড়ির ছাদ থেকে এক বিকট চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনলাম।  আওয়াজ শুনতে পেয়েই সবাই ছাদের দিকে ছুটে গেলাম।  এরপর যা দেখলাম তার জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না।

 

দেখলাম আরেক ঝুলন্ত দেহ। ঝুলন্ত দেহটি আর কারো নই সেটা হলো শ্রেয়ার।  

 

আমার চোখে তখন নদী ভাঙ্গার জল এসে হাজির।  আমি কান্না করতে শুরু করলাম।  কৃতি আমায় সান্ত্বনা দিলো। তবুও নিজেকে শক্ত করে কৃতিকে সাথে নিয়ে নিচে নেমেই দেখি আমার সাথে প্রীতম ও নিশি নেই। হঠাৎ  শুনি ঘরের বারান্দা থেকে প্রকট আওয়াজ।  এই আওয়াজ টা খুবই পরিচিত।  খাবার ঘরে ছুটে গিয়ে দেখি একটি ক্ষত বিক্ষত লাশ কিন্তু সেটা কার লাশ কেউ বুঝে উঠতে পারলাম না।

বারান্দায় গিয়ে দেখি নিশির দেহ ও মাথা আলাদা হয়ে পড়ে রয়েছে বারান্দায় চিরেকোটায়।  

এখন শুধু বাকি রইলাম আমি, কৃতি, রক্তিম ও শিবু।  কিন্তু, এবার শিবু আর রক্তিম কে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।  হঠাৎ  সামনে যেতেই শিবুর দেখা।  শিবুকে দেখে আমার কিছুটা সাহস বাড়লো।  তবুও আতঙ্ক ঘিরেছিলো আমাদেরকে। 

শিবু,  আমি ও কৃতি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম রক্তিমের খুঁজে  হঠাৎ শুনলাম শিবু চিৎকার করে উঠলো।  পিছনে ফিরে দেখলাম তাকে কোন এক শক্তি প্রচন্ড জোড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। বাঁচাতে সামনে তার দিকে দৌড় দেওয়ার পরেও আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম।  শিবুকেও বাঁচাতে পারলাম না।  

এখন আমি এই বাড়িতে নিতান্ত একা। সাথে আছে কেবল অপরিচিত এক মেয়ে কৃতি। আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিচে নেমে চলে আসলাম।

নিচে নামতে চোখে পড়লো রক্তিমের অর্ধ শরীর কাটা লাশ।  তার শরীরটা কেটে টুকরো টুকরো করেছে কেউ।  

কিন্তু সে কে?

 

রোহিনি……! 

রক্তিমের লাশ দেখে আমি ভয়ে একদিকের দেয়ালে ছিটকে পড়ি।  কিছুক্ষণ পর লক্ষ করি আমি এক পচা গলা দুর্গন্ধযুক্ত কিছু ধরে আছি।  পাশে তাকিয়ে দেখলাম এটি কোন দেয়াল না এটা এক বিকট বিশ্রী চেহারা পিশাচী দানব  আমাকে দেখে ভয়ানক ভাবে হাসছে।  এ যেন অসুর রূপী মহিষাসুরী হাসি। আমি ভয়ে সেখান থেকে সরে গেলাম।

 

এতক্ষণে অল্প অল্প করে  বুঝতে পারলাম এগুলো কার করা কার্য ছিল এবং খাবার ঘরে কার লাশ পড়ে ছিলো….!” 

 

দানবটি খড়্গ হাতে আমার দিকে ছুটে আসছিলো।  আমি আপাদমস্তক হতবম্ব হয়ে নিস্তব্দ হয়ে গেলাম। সাথে সাথেই পাশ থেকে কৃতি এসে আমাকে টান মেরে দৌড় মারে। সামনে দেখি বাড়ির দুয়ার খুলে গেছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে।  সারা পাড়া নিস্তব্ধ । চারিদিকে নিশ্চুপ। যেন কিছুই হয় নি।

প্রচুর ধোয়া ও কুয়াশার সংমিশ্রণের মত চারদিকে ঘিরে ধরেছে। কালো অন্ধকার চারদিক। সামনে কি আছে কি নেই সেটা সহ বুঝা সম্ভব হচ্ছে না।  

হঠাৎ দৌড়াতে দৌড়াতে আমি এক পাথরে সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম। কৃতির আঙ্গুলের স্পর্শ ছেড়ে দিলো আমার হাতের আঙ্গুল সেখানেই।  পাশে দেখলাম সেই পুরানো কালি বিগ্রহের মন্দির। যেখানে আগে পুজো হত দক্ষিণা কালির। আরেহ! এই সেই জায়গা। তাহলে কি…..

 

শরীর যেন থমকে গেছে।  চলাচলের ও বিন্দুমাত্র শক্তি নেই শরীরের।  হঠাৎ দেখি সেই দানবটি খড়্গ হাতে তেরে এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার সামনে এসে হাজির হলো। তার হাতের লম্বা এক রক্তাক্ত নরপিশাচী ধারালো খড়্গ।  সে প্রচন্ড জোড়ে খড়্গ আমার শর কাটার উদ্দেশ্য উপরে উঠালো।  আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না এই আমার শেষ। ভয়ে আমি সেখানেই নিজের জ্ঞান হারালাম।

যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি আমি আমার মামার বাড়ির উঠানের পাশে পুকুরে ধারে শুয়ে আছি পাশেই মামার বাড়ি। কিন্তু সেখানে যাওয়ার শক্তি নেই।  সারা দেহ যেন বিকল করে ফেলেছে কেউ।  

হঠাৎ পাশেই চোখ যেতে দেখি কৃতি শুয়ে।  আমি কষ্ট করে  উঠে বসলাম। আর কৃতি কে ডাকলাম।  কৃতি আমার ডাকে সাড়া দিয়ে পেছন ফেরে বসলো আমার মুখের বিপরীত দিকে মুখ করে।  কেবল দেখা যাচ্ছে তার লম্বা ঘন চুল।  আমি তার ঘাড়ে হাত দিয়ে ডাকলাম। সাথে সাথে দেখলাম আমি তার ঘাড়ে যে হাত রেখেছি সেই হাতের আঙ্গুল বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে হাতের কনুই পর্যন্ত রক্ত গড়িয়ে আসছে।  লক্ষ্য করলাম কৃতির ঘাড়ের চামড়া রক্তে থইথই করছে। আস্তে আস্তে কৃতি আমার দিকে ফিরতে লাগলো।

হে মোর খোদা……….!! 

‘সাথে সাথে মসজিদে নামাজের ধ্বনি ভেসে আসলো,  মন্দিরে কাসর বাঁচতে শুরু করলো, বিহারে ভিক্ষুরা তাদের প্রার্থনা শুরু করে দিলো….!’

তাহলেই কি কৃতিই আসল ‘রোহিণী’ না রূহির নামের মেয়েটি আসল নরপিশাচ যে আমায় শেষ অব্দি খড়্গ হাতে মারতে এসেছে এবং সেই দানবের খড়্গ আঘাত থেকে আমার শর বাঁচাতে গিয়েই কি কৃতি আত্ম- বিসর্জন দিয়েছে? 

আমার মনে এক অতৃপ্ত প্রশ্নের জন্ম নিলো..

আর যদি কৃতিই রোহিণী হয় তাহলে আমায় সে সেই ভুতুড়ে তান্ত্রিক বাড়িতে দানবের হাত থেকে কেন বাঁচালো আমায়? 

 

পর্ব ১ পড়তে ক্লিক করুন : এক অমবস্যার রাত (পর্ব-১)

 

আরো স্টোরি ব্লগ পড়তে #এখানে ক্লিক করুন। 

 

Joy Barua 

Intern, 

Content Writing Department. YSSE