মুশকান জুবেরি এক রহস্যের নাম। একদিকে রুপে, গুণে ও সৌজন্যে যেমন অনন্যা, তেমনি তার হাতের রান্নার রয়েছে আকাশচুম্বী চাহিদা। রান্নার সুখ্যাতি নিজ এলাকা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে দূর দুরান্তে। তবে হোটেলের নামটি অবশ্য রেখেছেন বেশ রসিকতায় মুড়িয়ে। “রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি”— এটা কেমন অদ্ভুত নাম আপনিই বলুন! কিন্তু এই হোটেলকে কেন্দ্র করেই আরেক তুখোড় ক্রাইম ডিটেকটিভ নুরে ছফার হাত ধরে একের পর এক রহস্যজটের সন্ধান মিলে।
লেখকের লেখার মধ্যে এক অদ্ভুত গন্ধ মিশে আছে। প্রতি পরতে পরতে আছে রহস্য। কখনও ব্যবহার করেছেন উপমা, কখনো উক্তি আবার কখনও গালি! সুন্দর সুন্দর চরিত্রের পিছনের অন্ধকার অধ্যায়গুলোকে এমনভাবে আলোকিত করা হয়েছে যে আপনি আলো আধারের ফারাক করতে ব্যার্থ হবেন। ধূসরতার মায়ায় হারিয়ে যেতে যেতে আপনি নিজের অজান্তেই সুন্দরপুরে আবিষ্কার করবেন নিজেকে। চোখের সামনে দেখতে পাবেন এই মফস্বলের মানুষদের দৈনন্দিন কার্যকালাপ। উপভোগ করতে পারবেন মুশকান জুবেরির সেই বিখ্যাত হোটেলের ভীষণ সুস্বাদু খাবারগুলো। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই গল্পের স্বাদ আপনার জিভে লেগে থাকতে বাধ্য অনন্তকাল। মানুষ সম্মহিত হয়ে পড়ে যে খাবারে, কি আছে সেই খাবারের পিছনের গোপন রহস্যে?
“রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি” বইটির ফ্ল্যাপের কথা : মফশ্বল শহর সুন্দরপুর ছবির মতোই সুন্দর। প্রকৃতির শোভা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু নেই বললেই চলে কিন্তু সবাই জানে রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি! কেন আসেন নি তারচেয়েও বড় কথা কেন অনেকেই সেখানে ছুটে আসে! এক আগন্তুক এসে হাজির হলো সেই সুন্দরপুরে। তার গতিবিধি অস্পষ্ট আর রহস্যময়। সে যেটা জানতে চায় সেটা ওখানকার খুব কম লোকেই জানে। আর যখন সেটা জানা গেলো তখন বেরিয়ে এলো রোমহর্ষক এক কাহিনী! পরিহাসের ব্যাপার হলো সেই রোমহর্ষক কাহিনী বলার মতো সুযোগ সত্যি কঠিন!
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা লেখক, অনুবাদক ও প্রকাশক। তাঁর জন্ম ঢাকায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক বছর অধ্যয়নের পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই পারদর্শী মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বাংলার পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন ভিনদেশী বিখ্যাত থ্রিলারগুলো অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে। ২৬টিরও বেশি বইয়ের এই অনুবাদক পরবর্তীতে মৌলিক থ্রিলার রচনায় মনোনিবেশ করেন ।
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের বই হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ‘নেমেসিস’, যা তার মৌলিক লেখা। মূলত এই বইয়ের জনপ্রিয়তাই তাকে পর পর আরও চারটি সিকুয়েল লিখতে অণুপ্রেরণা দিয়েছিলো। সেগুলো হলো ‘কন্ট্রাক্ট’, ‘নেক্সাস’, ‘কনফেশন’ এবং ‘করাচি’। তার উল্লেখযোগ্য অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে ‘জাল’, ‘১৯৫২ নিছক কোনো সংখ্যা নয়’, ‘পেন্ডুলাম’, ‘কেউ কেউ কথা রাখে’, ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ ইত্যাদি। তিনি বাংলাদেশের বাতিঘর প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক।
‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গেও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনী ‘অভিযান পাবলিশার্স’ লেখকের মৌলিক থ্রিলারগুলোর ভারতীয় সংস্করণও প্রকাশ করেছে। ২০২১ সালের ১৩ আগস্টে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ভিত্তিক বাংলা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই–এ তার উক্ত উপন্যাস অবলম্বনে একটি সিরিজ মুক্তি পায়। শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস ও টিভিওয়ালা মিডিয়ার যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই সিরিজটি জনপ্রিয় ভারতীয় পরিচালক সৃজিত মুখার্জি পরিচালনা করেছেন। ২০১৯ সালে ঢাকা এবং কলকাতা উভয় স্থান থেকেই বইটির সিকুয়েল ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি’ ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশনী থেকে বইমেলা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয়।
লেখক গল্পের চরিত্রগুলোকে বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়াও প্রাকৃতিক পরিবেশের সুনিপুণ বর্ণনায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠে সবকিছু। মুশকান জুবেরির অনিন্দ্য সুন্দর রান্নার বর্ণনায় তার ব্যক্তিত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যদিকে সত্যসন্ধানী ছফার ভয়ডরহীন সিদ্ধান্তে বুকের ভিতরের হিমশীতল স্রোতে ভেসে ভেসে আপনি সাক্ষী হবেন বিচিত্র সব রহস্যের। রবীন্দ্রনাথের সামনেই গুড়ের চায়ের দোকানদার রহমান মিয়ার ভাস্যমতে প্রসাশনের বড় বড় হর্তাকর্তার সাথে সখ্যতা থাকায় এলাকার সবাই যথাসম্ভব মুশকান জুবেরিকে এড়িয়ে চলে।
এলাকার “বিবিসি” নামে খ্যাত পুলিশের ইনফর্মার আতর আলীর ভাস্যমতে মুশকান জুবেরি একটা ডাইনি! তবে তার কাছ থেকে জানা যায় মুশকান জুবেরি এলাকার জমিদারের নাতবউ। এছাড়াও রয়েছে গোড় খোদক ফালু, যে কিনা মানুষ মারা যাওয়ার আগেই টের পায় ও গোড় খুড়ে রাখে। বোবা হলেও এলাকার সবাই তাকে কামেল হিসেবেই জানে। তার সাথে কি সম্পর্ক মুশকান জুবেরির? কেনই বা সে আতর আলীকে জীবন্ত কবর দেওয়ার চেষ্টা করেছিল? রহস্যের আলোছায়ার ও ঘটনার কাল পরিক্রমায় লেখক এই গল্পের নায়ক বা খলনায়ক খুঁজার বৃথা চেষ্টা পন্ড করেছেন বারবার। উত্তর কি রয়েছে রহস্যের কিনারায়?
জানতে হলে রহস্য ও উৎকণ্ঠায় ভরা এই বইটি প্রত্যেক বই প্রেমীর একবার হলেও পড়া উচিত…
বই : রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি
লেখক : মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
প্রকাশনী : বাতিঘর (বাংলাদেশ), অভিযান পাবলিশার্স (কলকাতা)।
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২৭১।
মুদ্রিত মূল্য : ২৪০ টাকা।
পার্সোনাল রেটিং : ৯/১০
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।
লেখক :
মোঃ রাকিব রায়হান
ইন্টার্ণ, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট,
Youth School for Social Entrepreneurs, YSSE.