বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর লেখার মধ্যে জীবনের খাঁটি প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। বাংলার গ্রামের কাঁচা মাটির গন্ধ, মানুষের হাসি-কান্না, প্রকৃতির নান্দনিকতা সবই আছে তাঁর লেখায়। আজ আমরা তাঁর ছয়টি সেরা বই নিয়ে কথা বলব, যা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।

১. আদর্শ হিন্দু হোটেল

সফল হতে চাই, বড় কিছু একটা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই আমরা, তাই না? বুকের মাঝে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। দিন-রাত অক্লান্ত শ্রম আর ঘাম ঝরার মাধ্যমে স্বপ্নকে বাস্তবিক রূপান্তরের প্রচেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু চলার পথ সবসময় অনুকূল হয় না। অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে, অপমান লাঞ্চিত হয়ে, তিলে তিলে শেষ করে দিই নিজেকে সামনে নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা এবং স্বপ্নকে। প্রকৃতপক্ষে, এসব বাধা উপেক্ষা করে নিজের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই প্রকৃত স্বপ্নবাজদের গুন। ঠিক এমনই এক চরিত্র ফুটে উঠেছে লেখকের লেখা – আদর্শ হিন্দু হোটেল বইয়ের হাজারি ঠাকুর এর মধ্যে। হোটেলে তিনি মালিক বেচুঁতি চক্কোত্তি হোটেলর তিনি রাধুনি হিসাবে কাজ করতেন। তার রান্নার স্বাদ আর গুনে দূরদূরান্তে থেকে খদ্দেররা আসতেন তার রান্না খেতে। হোটেলটি মুলত চলছিল তার রান্নার গুনে, কিন্তু এটা যেন কিছুতেই স্বীকার করতে চাইত না গল্পের খলনায়িকা পদ্মঝি। প্রতিনিয়ত তার সাথে মন্দ ব্যবহার করত, রান্নার প্রশংসা তো করতই না বরং মাইনেটুকু  । খাবার ও জুটতো না মাঝে মধ্যে ঠাকুরের। তার পরও তিনি তার কাজকে ভালোবাসতেন আর স্বপ্ন দেখতেন একদিন তার নিজস্ব একটা হোটেল হবে, যেখানে বাহিরে লেখা থাকবে,

হাজারি চক্রবর্তীর হিন্দু হোটেল
রাণাঘাট
ভদ্রলোকদের সস্তায় আহার ও বিশ্রামের স্থান।
আসুন! দেখুন!! পরীক্ষা করুন!!!

একবার তাকে জেল খাটতে হয়েছিল প্লেট ভাঙ্গার কারনে, জেল থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক যখন ঘুরছিলেন কাজের জন্য তখনই তার স্বপ্ন তাকে নাড়া দেয়। নিজের তিলে তিলে জমানো কিছু টাকা আর অনাত্মীয়ের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে অবশেষে হাজারী ঠাকুর তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করল।

২. পথের পাঁচালী

‘পথের পাঁচালী’ লেখকের একটি কালজয়ী উপন্যাস। লেখকের সময়কালের সামাজিক, দারিদ্র্যতা, আর্থিক অবস্থা সর্ম্পকে নিপুন ভাবে তুলে ধরেছেন। বইটি মুলত তিন-খন্ডে রচিত : বল্লালী বলাই, আম-আঁটির ভেঁপু এবং অক্রুর সংবাদ। গল্পের দুই ভাইবোন অপু এবং দূর্গার শৈশবকাল এবং তাদের বেড়ে উঠার সংগ্রামী গল্প। কালবৈশাখী ঝড়ে আমকুড়ানের থেকে শুরু করে, জঙ্গলে ঘুরর বেড়ানো, আদীবাসীদের সাথে খেলা করা এবং গোপনে ফুল-ফল পাড়া মতো দুসাহসী ঘটনার কথা বর্ণনা করছেন। সেই সাথে বয়স্ক বিধবার পিশি ইন্দিরিয়া’র তাচ্ছিল্য হওয়ার গল্প। একপর্যায় দূর্গার মা সর্বজয়ার হাতে অকথ্য ভাষায় কথা শুনে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়, এবং চালের গুদামঘরের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সবাইকে নিঃস্ব করে দিয়ে দুর্গার মৃত্যু, অপুদের সপরিবার তাদের নিশ্চিন্দপুর গ্রাম ছেড়ে কাশীতে যাওয়ার চিত্র। অতঃপর অপুর বাবার মৃত্যু, সর্বজয়া কাজের জন্য কাশীত্যাগ এবং পরিশেষে নিশ্চিন্দপুর গ্রামে ফিরে আসার কাহিনী বর্ণিত আছে।

৩. অপরাজিত

ঠিক যেখানে পথের পাঁচালী ইতি টানছিল বিভূত সেখান থেকে অপরাজিত শুরু হয়। অপুর জীবন, অজানার কে জানার প্রতি যে আগ্রহ, অনুকূল পরিবেশ কাটিয়ে নিজেকে বিস্তর এগিয়ে যাওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন লেখক। অপু চেয়েছিল বদ্ধ খাঁচা থেকে বেরিয়ে মুক্ত পাখির মত উড়ে চলা। উপন্যাসে দেখা যায়, অপুর মায়ের মৃত্যুতে তার আনন্দের মহাক্ষণ। এই যেন সে স্বাধীনতা যেটা সে চেয়েছিল এতদিন ধরে। কি নিঃস্বার্থ তাই না? কিন্তু পরক্ষণে তার মন মায়ের জন্য আকুল হয়ে যায় যখন সে গিয়েছিল নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে। চলার পথে অপুর অনেক বন্ধু হয়, তার মধ্যে অনিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু।কিন্তু এককালে অনিলের মৃত্যু হয়ে যায়। সম্পর্ক কে খুব ভয় পেত, তার মা হারানোর পর আরো বেশী ভয় পেত, নতুন কোন জীবনের কথা সে ভাবতেই পারে না। ঘটনাপরিক্রমে তার মামাতো বোন অপর্ণার সাথে বিয়ে হয়। সুখেই যাচ্ছিল সাংসারিক জীবন কিন্তু অপর্ণা মারা যায় প্রথন সন্তান জণ্মদানের সময়। প্রিয়জনদের হারানো যে কিরকম বেদনাদায়ক সেই চিত্র এই উপন্যাস পড়া ছাড়া বুঝা যাবেনা। এই উপন্যাস জানান দেয় আমরা কি চাই আর কি পায় এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য। আমাদের অতীত ভবিষ্যত কথা না ভেবে বর্তমানে থাকাটাই মুখ্য বিষয়!

৪. আরণ্যক

প্রকৃতিকে হাতে-কলমে রুপান্তর দেওয়াটা খুবই কঠিন কাজ। এই অবাধ্য কাজটি বিভূতি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন পাঠকদের কাছে। পড়ে মনে হয় যেন প্রকৃতির সাথে মিশে যাচ্ছি। মজার বিষয় হচ্ছে এই উপন্যাস কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়, বরং বাস্তবিক। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সত্যচরণ (যিনি লেখক নিজই) কলকাতায় শিক্ষিত বেকার ছিল। আর্থিক অনটনে পড়ছিল সেসময় তার এক বন্ধু তাকে জমিদারি চাকরি দেন যেটা কলকাতা থেকে অনেক দূরবর্তী এলাকায় যেটি ঘনজঙ্গল দ্ধারা আবৃত ছিল। প্রথমদিকে তার কিছুতে মন বসছিল না এখানে, ওই এলাকার মানুষ, সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইতে কষ্ট হচ্ছিল। ওইখানে মানুষ ঘাস লতা পাতা খেয়ে বেঁচে থাকত। যারা ভাত খেত তাদের ধনী বলে সম্বোধন করত সবাই। অতঃপর ধীরে ধীরে সে আরণ্যকে আলিঙ্গন করেনিল। লেখকয়ের ভাষায়- ‘দিন যতই যাইতে লাগিল, জঙ্গলের মোহ ততই আমাকে ক্রমে পাইয়া বসিল।’। কীভাবে লেখকের মন বসল, আর কি কি হয়েছিল ওই জঙ্গলে সেটা আরণ্যক বই পড়ে জানতে পারবেন।

৫. আম-আঁটি ভেঁপু

‘পথের পাঁচালী’ লেখা হয়েছিল বড়দের জন্য। কিন্তু ছোটদের মধ্যে এর আগ্রহ দেখে আম-আঁটি ভেঁপু সংকলন করা হয়। যেখানে অপুর শৈসব যেমন কেটেছিল নিশ্চিন্দপুর গ্রামে। তার বোন দুর্গা তার সবসময়ের সাথী। দুই জনেরই অজানাকে জানার প্রতি তীব্র নেশায়, তাই তারা মায়ের আদেশ অপেক্ষা করে ছুটে চলত বনজঙ্গলে, কাশফুল ফেরিয়ে রেললাইন দেখতে যেত। সহজ-সরল জীবনের গল্পে দুঃখ যেন লেগেই থাকে, তারই মধ্যে আনন্দ ফুটে। বড় বোন দুর্গার মৃত্যু,ইন্দিয়া পিশির শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের পরবর্তী অপুর জীবন কীভাবে কেটেছিল সেটার জানার জন্য এই বইটি পড়ার অনুরোধ।

৬. চাঁদের পাহাড়

বিভূতিবাবুর লেখা “চাঁদের পাহাড়” এক রোমাঞ্চকর অভিযান। শঙ্কর নামের এক যুবকের আফ্রিকায় যাওয়ার গল্প। তার সাহসিকতার গল্প, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই, অজানা বিপদের মুখোমুখি হওয়া—সবই এই বইয়ে পাওয়া যায়। এই বইটি পড়লে মনে হয়, আমরাও শঙ্করের সঙ্গে সেই অজানা দুঃসাহসিক যাত্রায় অংশ নিচ্ছি।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। তাঁর গল্পগুলো পড়লে মনে হয়, আমরা যেন সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজেরাই বেঁচে আছি। তাঁর সেরা ছয়টি বই- “আদর্শ হিন্দু হোটেল”, “পথের পাঁচালী”, “অপরাজিত”, “আরণ্যক”, “আম-আঁটি ভেঁপু”, এবং “চাঁদের পাহাড়”—বাংলা সাহিত্যের মুকুটে উজ্জ্বল রত্ন। এগুলো আমাদের জীবনের অংশ, আমাদের আবেগের অংশ। এই বইগুলো পড়ে আমরা জীবনের আসল সৌন্দর্য আর মানবতার গভীরতা বুঝতে পারি।

এরকম আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন।

লেখকগন,

Rifah Zakiah’s (MT) Team

(Alima Zaim, Taspia Taher Faiza, Ashura Tabassum Arshi, Labina Mehrin, Tanvir Hosen Shawon)

{ইন্টার্নস -১১ তম ব্যাচ}, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট। 

YSSE