আধুনিক যুগে মানুষ যথেষ্ট ফ্যাশন সচেতন। দৈনন্দিন জীবনে যেমনি বাড়ছে ব্র্যান্ড ব্যবহারের প্রবণতা ঠিক তেমনি বাড়ছে ব্র্যান্ডগুলোর একচেটিয়া ব্যবসা। মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে পায়ের জুতা থেকে শুরু করে মাথার ক্যাপ সহ নিয়মিত ব্যবহারের সকল পণ্যই ব্র্যান্ডগুলো সরবরাহ করে থাকে। এক কথায় ব্র্যান্ডের জিনিস ছাড়া যেন একদিনও চলে না। নামি-দামি ব্র্যান্ডের নাম শুনলেই চট করে মাথায় চলে আসে দুনিয়া কাঁপানো দুটি বিখ্যাত মাল্টি ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস ও পুমা’র কথা। যেগুলো কিনা সৃষ্টি হয়েছিল এক ছাদের তলায়। কিন্তু ঘটনা পরিক্রমায় দুটি ভিন্ন পথে পা বাড়ায়। জানা যায়, এই দুটি কোম্পানির প্রভাব এতোটাই বিস্তৃত যা কিনা একটি গোটা শহর, সমাজ ও সেখানকার জনগোষ্ঠীকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে।
চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক অ্যাডিডাস ও পুমার নেপথ্যে কাহিনী।
অ্যাডিডাস ও পুমার জন্মকথা ঃ
অ্যাডিডাস ও পুমা ; জগৎ বিখ্যাত দুটি ক্রীড়াসামগ্রী ও জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এমন কোন মানুষ মেলা ভার যারা এগুলোর নাম শুনেনি। বর্তমানে খ্যাতির চূড়ায় অবস্থান করা এই দুই প্রতিষ্ঠানের শুরুর যাত্রাপথ এতোটা সোজা ছিল না।
শুরুটা হয় ১৯০০ সালে। জার্মানির সুন্দর শহর হের্জোগেনারক, যেখানে বাস করত ড্যাসলার পরিবার। এই জার্মান পরিবারের দুই ভাই অ্যাডলফ ও রুডলফ ড্যাসলার। প্রথমদিকে মায়ের লন্ড্রি ঘরে বসে তৈরি করতেন জুতা। পরিবারিক ব্যবসার অংশ হিসাবে পরে তারা নির্মান করেন গ্রেব্রুইডার (গেডা) নামে একটি জুতার কারখানা যেখানে স্নিকারস জাতীয় জুতা প্রস্তুত করা হতো। ক্রমশ তাদের প্রস্তুতকৃত জুতার চাহিদা ও কর্মীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে তারা আরও বড় পরিসরে ব্যবসা চালু করার পরিকল্পনা করেন।
বড় সাফল্যের শুরু ঃ
এরই মধ্যে ড্যাসলার ভ্রাতৃদ্বয়ের জন্য সবচেয়ে বড় চমক নিয়ে আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিক গেমস। ১৯৩৬ সালে জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের এই আসরে খেলোয়াড়দের জুতার ব্যাপক চাহিদা দেখা দেয়। ঠিক সেই সময়ে তারা তাদের প্রস্তুতকৃত জুতা নিয়ে হাজির হয় জেসি ওয়েন্স সহ নামকরা অ্যাথলেটদের কাছে। এমনকি স্বয়ং অলিম্পিক আয়োজক কমিটিও অন্যান্য বড় বড় কোম্পানির অফার ফিরিয়ে দিয়ে তাদের সাথে চুক্তি করে। তাদের জুতা বলতে গেলে এক কথায় বিশ্বমানের।
জানা যায়, যেসব অ্যাথলেটরা তাদের বানানো পণ্য ব্যবহার করে তারা আশানুরূপ ভাবে ৭টি স্বর্ণ, ৫টি রৌপ্য, এবং ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। এক জেসি ওয়েন্স একাই ৪টি স্বর্ণ পদক লাভ করেন। আর এতেই রাতারাতি তাদের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে যায় দেশের গন্ডি পেরিয়ে বর্হিবিশ্বে। চোখের পলকে বদলে যায় ব্যবসায় হালচাল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঃ
এদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এরই সাথে তাদের জুতা তৈরির কারখানাটিও ব্যবহার হতে থাকে অস্ত্র তৈরির কাজে। ঐ সময় বড় ভাই রুডলফ কে চলে যেতে হয় যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। অন্যদিকে ছোট ভাই অ্যাডলফ বাড়িতে অবস্থান করেন। এরইমধ্যে যুদ্ধ শেষে রুডলফ গ্রেফতার হয় এবং শাস্তি হিসেবে এক বছরের জন্য কারাবাসে যান । অতঃপর দেশে ফিরে পুনরায় ব্যবসার কাজে মন দেন।
সম্পর্কের ফাটল ঃ
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে দুই ভায়ের মধ্যে সর্ম্পকের তিক্ততার শুরু। এমনকি মৃত্যুর সময়ও এক ভাই অন্য ভাইয়ের মুখ দেখেনি। ঠিক কি করণে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক ধোয়াশা। এ বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি ও সিনেমা নির্মিত হয়েছে, তৈরি হয়েছে শত শত মুখরোচক কাহিনী।
কেউ কেউ মনে করেন,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রুডলফকে বাধ্যতামূলক ভাবে দেশের হয়ে যুদ্ধে যেতে হয়। অন্য দিকে অ্যাডলফকে তার ব্যবসার উল্লেখযোগ্যতার কথা বিবেচনা করে দেশে থাকার অনুমতি দেয়া হয়। ফলে খুব অল্পদিনে অ্যাডলফ বিশাল অর্থের মালিক হয়ে যায়। আর এটা নিয়ে রুডলফ তার ভাইয়ের উপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল। পরবর্তীতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসতে চাইলে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। পাশাপাশি অ্যাডলফ তার ভাইকে ধরিয়ে দিতেও নাৎসি বাহিনীকে সব রকম সাহায্য করেন।
এছাড়াও অন্য আরেকটি গুজব প্রচলিত ছিল যে , ছোট ভাই অ্যাডলফের স্ত্রীর সাথে রুডলফের অনৈতিক সম্পর্কের জেরে তাদের মধ্যে ফাঁটল ধরে। তাছাড়া অনেকে মনে করেন, দুই পরিবারে বউদের মধ্যে অমিল, সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা, ঈর্ষা, জনপ্রিয়তা, ইত্যাদি কারণে তাদের সম্পর্কে চিড় ধরে।
অ্যাডিডাস ও পুমা’র নামকরণ ঃ
ক্রমশ’ই দুই ভাইয়ের সম্পর্কে অবনতি হতে হতে একপর্যায়ে রুডলফ আলাদা ব্যবসা করার মনস্থির করেন। যেই ভাবা সেই কাজ। তার ভাগের অংশটুকু দিয়ে ১৯৪৮ সালে নিজের নামের সাথে মিলিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন “রুডা “। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখেন পুমা।
এর পরের বছর ১৯৪৯ সাল, অ্যাডলফ তার নামের প্রথম অংশ অ্যাডি ও পারিবারিক নামের শুরুর অংশ ড্যাস যোগ করে কোম্পানির নামকরণ করেন অ্যাডিডাস। ব্যস! সেই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত একে অন্যের চির প্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও পরিসংখ্যান বিবেচনায় অ্যাডিডাস পুমা থেকে বহুগুণ এগিয়ে। আজও ধরে রেখেছে শীর্ষস্থান।
আপনারা জানেন কি?
অ্যাডিডাস ও পুমা’ই একমাত্র ব্র্যান্ড যাদের ব্যক্তিগত রেষারেষি কেবল বিভক্ত করেনি একটি পরিবারকে, বিভক্ত করেছে একটি শহর, পুরো সমাজ ও তার সাথে সাথে মানুষগুলোকেও । শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা Aurach নদীও এর থেকে বাদ পরেনি । নদীর একপাশে বাস করে অ্যাডিডাসের সমর্থক তো অন্য পাশে পুমা। কিছু মানুষ কাজ করে রুডলফের কোম্পানিতে বাকি লোকজন পুমাতে। এছাড়াও প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা আলাদা খেলার স্টেডিয়াম, খেলোয়ার, জার্সি, রয়েছে ক্লাব রাস্তা-ঘাট,পার্ক, হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেখানে নিজ নিজ ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগানো আছে।
কি অদ্ভুত না!! এক ভাই অন্য ভাইয়ের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শহরে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। এতে করে সাধারণ জনগণও প্রচুর লাভবান হয়।
পরিশেষে, কেমন লাগলো তাদের পারস্পরিক দ্বন্ধ? অর্থ, প্রতিপত্তি, নাম, যশ, ক্ষমতা যেমন সুখ সমৃদ্ধি এনে দেয় ঠিক তেমনি মুহুর্তে বদলে দিতে পারে সকল সম্পর্ক, তৈরি করে দিতে পারে শক্ত দেয়াল।
আরও ব্লগ পরতে এখানে # ক্লিক করুন
Writer
Baitul Hikma
Intern,Content writing Department YSSE.