১৭ই জুলাই, ১৯৬৯ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের তখন কপালে ভাজ। White House এর অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষও প্রেসিডেন্ট সাহেবের ঘাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অলরেডি মিশন ফেইল হলে জাতির উদ্দেশ্যে কি ভাষণ দিবেন তাও ঠিক করে ফেলছেন।

তাতেই আন্দাজ করা যাচ্ছে এই মিশনটা কতটা রিস্কি ছিল। তার পাশে দাড়িয়ে ছিলেন তার ব্যক্তিগত নাসার কর্মকর্তা ফ্রাঙ্ক বোরম্যান রিচার্ড নিক্ষনকে যথাসম্ভব আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও নিজেই নিজের চাপকে আয়ত্তে আনছে পারছেন না।

কোনোভাবে মিশনটা ব্যর্থ হলে সারা পৃথিবীর সামনে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে আর এই সুযোগটাই নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। যথাসময়ে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩২ মিনিটে কেপ কেনেডি থেকে SATURN V SA রকেটের পেটে চেপে বসে তিনজন মার্কিন নভোচারী চাঁদের উদ্দেশ্যে পৃথিবী ছাড়লেন।

উপরের লেখাগুলো কাল্পনিক হলেও কয়েকটা তথ্য কিন্তু আসলেই সত্য। প্রেসিডেন্ট নিক্সন আসলেই ঠিক করে রেখেছিলেন মিশনটা ব্যর্থ হলে জাতির উদ্দেশ্যে কি ভাষন দিবেন। অ্যাপোলো ১১ মিশন এতটাই বিপজ্জনক ছিল যে নভোচারীদের কেউই জীবন বীমা কিনতে সক্ষম হননি। নভোচারীদের পরিবার যেন তাদের অবর্তমানে অর্থকষ্টে না ভুগে, সেজন্য অনেকগুলো অটোগ্রাফ রেখে যান, যেন ওই অটোগ্রাফ নিলাম করে সারাজীবন চলে যাতে পারে।

পৃথিবীর ইতিহাসে ৬০এর দশকটা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন স্নায়ুযুদ্ধ তুঙ্গে| এমন স্নায়ুযুদ্ধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় মহাকাশ। কে কাকে টেক্কা দিবে এই মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়াই প্রথম মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠায়, স্পুটনিক-১,১৯৫৭ সালে। আমেরিকাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?

১৯৫৮ সালে তারাও মহাকাশে পাঠিয়ে দিলো এক্সপ্লোরার-১। তবে সোভিয়েত রাশিয়ার চিন্তা ছিল মহাকাশে মানুষ পাঠানোর চিন্তা। পরীক্ষামূলক হবে ১৯৫৭সালে মহাকাশে মস্কোর রাজপথের এক নেড়ী কুকুর লাইকাকে স্পুটনিক-২এ চাপিয়ে পাঠিয়ে দেয় মহাকাশে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, লাইকা বেশিক্ষণ বাঁচতে পারেনি মহাকাশে। কারিগরি ত্রুটির জন্য লাইকা মহাকাশেই মারা যায়।

পরবর্তীতে ১৯৬১সালে ভস্কট-১ চড়ে মহাকাশে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন রাশিয়ান নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন। ব্যস রাশিয়ান নাগরিক ইউরি হলেন মহাকাশে গমণকারী প্রথম মানব। অ্যালেন শেফার্ড প্রথম আমেরিকান হিসেবে FREEDOM-1 ক্যাপসুলে চেপে মহাকাশ ঘুরে আসেন।

এরপর রাশিয়া ভেলেন্তিনা তেরেসকোভা নামের এক নারীকে ভস্কট-৬এ চাপিয়ে ১৯৬৩ সালে মহাকাশে পাঠায়। তাতেই আঁতে ঘা লাগলো মার্কিনিদের। সবসময় কেন রাশিয়ানদের পিছনে থাকা লাগবে তাদের? এরই মাঝে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি ঘোষণা দিলেন খুব শীঘ্রই মার্কিনিরা চাঁদে যাবে।

আসলে পরিকল্পনা ছিল শুধু মহাকাশচারী একটা রকেটকে চাঁদের কক্ষপথে নেওয়ার কিন্তু প্রেসিডেন্ট কেনেডি চেয়েছিলেন আরও বেশি, অর্থাৎ চাঁদের উপর মার্কিনিদের পদচিহ্ন। পুরো বিশ্ব হেসে উড়িয়ে দিলেওমার্কিনিরা সে মোতাবেক এগোতে লাগলো।

১৯৬৪ সালে NASA এর Ranger 7 চন্দ্র পৃষ্ঠের প্রথম ক্লোজ-আপ টিভি ছবি তৈরি করেছিল। ১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশযান LUNA 9 চাঁদে প্রথম অবতরণ করেছিল। ১৯৬৭ সালে নাসার লুনার অরবিটার মিশন চাঁদের ফটোগ্রাফিক ম্যাপিং সম্পন্ন করেছে।

 

এসে গেলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। চাঁদে যেতে প্রস্তুত তিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ নভোচারী। নিল আর্মস্ট্রং, বাজ অল্ড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স। পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা চেপে বসলেন SATURN V SA রকেটে। তাদের মনে তখন কি ঘুরছিলো জানি না, হয়ত এক রোমাঞ্চ, ভয়, অ্যাডভেঞ্চার বা অন্য কিছু, এসবের মাঝেও তারা যথেষ্ট স্বাভাবিকই ছিলেন, সবচেয়ে উত্তেজিত ছিলেন নিল আর্মস্ট্রং, যার হৃদ চাপ ছিল সবচেয়ে বেশি। মজার বিষয় হলো, নিল আর্মস্ট্রং নিজেও সন্দিহান ছিলেন তারা কি আদৌও চাঁদে অবতরণ করতে পারবেন কিনা; ২০১২ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এটা জানান। সেদিন নীল আর্মস্ট্রংদের সাথে চন্দ্র মুল্লুকে আরেকটা জিনিস উড়েছিলো।

যারা প্রথম মানুষকে বিশ্বাস করতে শেখায় পাখির মতো মানুষও উড়তে পারে, সেই অলিভার রাইটস আর উইলভার রাইটসের ভ্রাতৃত্বদ্বয়ের তৈরি করা প্রথম উড়োজাহাজের মডেলের একটা ছোট অংশ। যথাসময়ে যথাযথভাবে রকেটটি পৃথিবী ছেড়ে চন্দ্রমুল্লুকের দিকে ছুটে যায়।

তিন দিনে প্রায় তিন লক্ষ চুরাশি হাজার কিলোমিটার মহাকাশে পারি দিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করতে প্রস্তুত মূল চন্দ্রযান Eagle এর রাডার নকশা প্রণয়ন ও কারিগরি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন সিলেটে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী রফিক উদ্দিন আহমেদ) কিন্তু, একটা সমস্যা, চন্দ্র পৃষ্ঠ খুবই অসমতল আর পাহাড় আর খাদে ভরপুর। টার্গেট অবতরনের অংশ থেকে প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূরে শেষ পর্যন্ত Sea of Tranquillity (শান্ত সাগর) নামক চন্দ্র পৃষ্ঠে ঈগল অবতরণ করে।

নিল আর্মস্ট্রং যখন চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেন তখন মাত্র উড়ার মতো ৩০ সেকেন্ডের মতো জ্বালানী অবশিষ্ট ছিল। কিছুটা বাকবিতন্ডার পর ঠিক হয় সবার আগে চন্দ্র পৃষ্ঠে নামবেন অভিযানের অধিনায়ক নীল আর্মস্ট্রংই তারপর বাজ অল্ড্রিন। আমেরিকার স্থানীয় সময় বেলা তিনটা সতেরো মিনিটে নীল আর্মস্ট্রংইচাঁদে তার পায়ের ছাপ ফেলতে সক্ষম হন।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন মানুষ চাঁদে অবতরণের টেলিকাস্ট দেখেছিল এবং এটি সেই তারিখ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি দেখা টেলিভিশন ইভেন্ট ছিল। টিভি স্ক্রিনের সামনে পুরো আমেরিকার অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকা সার্থক হলো। নাসার আনন্দ দেখে কে!!

প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। মিনিট খানেক পর বাজ অল্ড্রিনও চাঁদে নামলেন। কিছুক্ষণ চন্দ্র পৃষ্ঠে হাটাহাটি করলেন, চাঁদ থেকে দেখলেন অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীটাকে ! যদিও নীল আর্মস্ট্রংই হয়তো প্রথম মানুষ যিনি চাঁদে পা রাখেন, বাজ অলড্রিনই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সেখানে মূত্র বিসর্জন করেন, তার স্পেসসুটে একটি বিশেষ টিউব ব্যবহার করেছিলেন!!

মজার ব্যাপার হলো বাজ অলড্রিন এবং নিল আর্মস্ট্রং লুনার মডিউলের দরজাটি লক আউট হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য কিছুটা খোলা রেখেছিলেন। অ্যাপোলো ১১ মিশন একটি ফেল্ট টিপ কলম দ্বারা রক্ষা পেয়েছিল। লুনার মডিউলের অ্যাসেন্ট ইঞ্জিনকে সক্রিয়কারী সার্কিট ব্রেকারের সুইচটি ত্রুটিপূর্ণ হলে, নভোচারীরা সুইচটি উল্টাতে এবং বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য একটি ফেল্ট টিপ পেন ব্যবহার করেন!

অ্যাপোলো ১১-তে যে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়েছিলো, তার থেকে আজকের দিনের একটা সাধারন স্মার্টফোনের কর্মক্ষমতা বেশি। ২১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট চন্দ্র পৃষ্ঠে বিচরণের পর ২২কেজি চন্দ্র শীলা-পাথর-ধুলো নিয়ে যাতারা EAGLE-এ পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এই পুরোটা সময় মাইকেল কলিন্স ছিলেন চরম চিন্তিত। একসময় তিনি বলে উঠেন নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন ফেরত না আসলে তিনি অবশ্যই আত্মহত্যা করবেন না, তিনি ফিরে আসবেন পৃথিবীতে। চন্দ্র বিজয়কালে ব্যবহৃত পতাকাটা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। প্রথমে পতাকা নিয়ে নাসা কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি কারণ এর ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করবে। বহুল আলোচিত এই পতাকাটা Sears কর্তৃক প্রস্তুতকৃত।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল চন্দ্রপৃষ্ঠ নরম কিন্তু অবতরণের পর দেখা গেলো চন্দ্রপৃষ্ঠ পাথুরে, যেটার জন্য পতাকা স্থাপন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পতাকাটা যদিও বেশিক্ষণ টিকে নাই। ঈগলের থ্রাস্টার দ্বারা উৎপাদিত শক্তির জন্য কক্ষপথে ফিরে আসে, পতাকাটি দ্রুত পড়ে যায়। পরবর্তীতে ওই পতাকাটার আর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন কেবল সেই পতাকাটির চেয়েও বেশি কিছু রেখে গেছেন: পৃথিবীতে ফিরে আসা অন্যান্য অর্থবহ স্মৃতিচিহ্নগুলির মধ্যে ছিল 73 জন বিশ্ব নেতার বার্তা, একটি জলপাই শাখার আকারে একটি সোনার পিন (শান্তির প্রতীক), এবং অ্যাপোলো ১১ মিশনের একটি প্যাচ (যে অপারেশন কখনও পরিচালিত হয় নাই কারণ এর তিনজন নভোচারী একটি প্রশিক্ষণ অনুশীলনের সময় নিহত হয়েছিল)।

২৪শে জুলাই, ১৯৬৯ সালে আমেরিকার স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে বারোটায় প্রশান্ত মহাসাগর অবতরণ করে এবং USS HORNET নামক জাহাজ উদ্ধার করে। চন্দ্র বিজয়ীদের প্রায় ১৭ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকা লেগেছিল চন্দ্রাভিযানের বিজয়ীদের।

১৯৭২ সালের মাঝেই নাসা আরও ৬টি চন্দ্রাভিযান পরিচালনা করে। শুধু অ্যাপোলো-১৩ মহাকাশযানটি চাঁদে পৌছাতে পারেনি। যেই নাসা “Unlucky 13” কে বুড়ো আঙুল দেখাতে চেয়েছিলো, সেই অ্যপোলো-১৩ই একমাত্র চাঁদে পৌছাতে পারেনি কিছু কারিগরি ত্রুটির কারণে। নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা ফেলার সাথে সাথেই বলেছিলেন, এটা একটি ছোট্ট পদক্ষেপ মাত্র, কিন্তু মানবজাতির জন্য বিশাল অগ্রগতি।

 

Write,

Md. Nabil Abdullah Koushik

Intern 

Content Writing Department

YSSE