ভরদুপুরে রাজধানীর একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছি নিজস্ব প্রয়োজনে। বাইরে তপ্ত আবহাওয়া। মুঠোফোন জানান দিচ্ছে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। হঠাৎ দেখলাম একদল মানুষ জনৈক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। মহিলাটি প্রায় অচেতন। সারা দেহ ঘেমে-নেয়ে একাকার।  বোঝাই যাচ্ছে বেশ অসুস্থ। কিন্তু এরকম অসুস্থ একজন মানুষকে আগে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে সরাসরি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিয়ে আসা হলো কেন? 

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আগে জানতে হবে হিটস্ট্রোক কি এবং এর কারণ ও লক্ষণসমূহ। কারণ, উপরোক্ত ভদ্রমহিলার অসুস্থতা ছিল মূলত হিটস্ট্রোক। 

মানবদেহে বিপাক ক্রিয়ার ফলে প্রতিনিয়ত তাপ উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত অতিরিক্ত তাপ শরীর থেকে বের করে দেয়ার মূল সহায়ক হলো ঘাম। কিন্তু যখন আবহাওয়া অত্যাধিক তপ্ত থাকে ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে, তখন দেহের এই স্বাভাবিক তাপ-নিষ্কাশন প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। আর ঠিক তখনই ঘটে হিটস্ট্রকের মতো বিপত্তি যা মানুষের জীবনকে মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলতে পারে, তাকে কোমায় নিয়ে যেতে পারে কিংবা স্থায়ীভাবে অচল করে দিতে পারে শরীরের যেকোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। 

হিটস্ট্রোক হয় শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট। অতিরিক্ত গরম ও ঊচ্চ আর্দ্রতার কারণে এই তাপমাত্রা বেড়ে যখন ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট (৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) বা তার বেশিতে পৌঁছে যায় তখনই মরণঝুঁকি মানুষকে পেয়ে বসে।  তাই বাংলাদেশের মতো জায়গায় যেখানে তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, সেখানে হিটস্ট্রোক বিষয়ক সচেতনতা, এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা থাকাটা সকলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।  

হিটস্ট্রোক হলে করণীয়ঃ

  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রথমত ছায়াযুক্ত অথবা অপেক্ষাকৃত শীতল জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। হতে পারে এমন কোন জায়গা যেখানে ফ্যান, এসি বা প্রাকৃতিক বাতাসের সুষ্ঠু চলাচল আছে। 

 

  • শরীরের উভয় পাশে পেট এবং উরুর মধ্যবর্তী স্থান, ঘাড় ও বগলে বরফ ব্যবহার করতে হবে তাপমাত্রা কমানোর জন্য।

 

  • ক্রমাগত রোগীর শরীর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুছে দিতে হবে। গায়ের ভারী কাপড় খুলে দিতে হবে বা আলগা করে দিতে হবে। 

 

  • রোগীকে লবণযুক্ত পানীয় পান করাতে হবে। যেমন- স্যালাইন, স্পোর্টস ড্রিংক, লবণপানি ইত্যাদি। ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় সম্পূর্ন এড়িয়ে চলতে হবে।

 

  • রোগীকে কোনপ্রকার ওষুধ না তাৎক্ষণিকভাবে না দেওয়াই ভালো। 

 

  • থার্মোমিটারে রোগীর দেহের তাপমাত্রা মেপে দেখতে হবে। যতক্ষণ না শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইটের নিচে নামছে ততক্ষণ উপরোক্ত প্রক্রিয়াগুলো চালিয়ে যেতে হবে।

 

  • যদি আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে অচেতন হয়ে পড়ে তবে যত দ্রুত সম্ভব তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। 

 

হিটস্ট্রোকের লক্ষণসমূহঃ

  • ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • শুষ্ক ও লালচে ত্বক।
  • দেহের তাপমাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যাওয়া।
  • চলাফেরা ও নড়াচড়ায় অসুবিধা হওয়া।
  • দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারা।
  • খিঁচুনি।
  • হ্যালুসিনেশন।
  • প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া।
  • বমি বমি ভাব বা বমি।
  • শ্বাসকষ্ট, ঊচ্চ অথবা নিম্ন রক্তচাপ।
  • চেতনা হারিয়ে ফেলা।

 

হিটস্ট্রোক প্রতিরোধে কি করবেন?

  • অতিরিক্ত গরমে ও ঊচ্চ আর্দ্রতায় শরীরচর্চা, খেলাধুলা বা কোন পরিশ্রমের কাজ না করলে হিটস্ট্রোক এড়িয়ে চলা সম্ভব।


  • বেশি পরিমানে পানি ও স্যালাইন, প্রাকৃতিক ফলের রস খেলে এই অসুস্থতা থেকে নিজেকে দূরে রাখা যেতে পারে।


  • দাবদাহ চলাকালীন বাতাসের সুষ্ঠু চলাচল আছে এরকম জায়গায় অবস্থান করলে হিটস্ট্রোক এড়ানো সম্ভব।


  • ভারী, মোটা ও গাঢ় রঙের কাপড় পরিহারকরা উচিত। এসব কাপড় তাপ শোষণ করে থাকে যা দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা অনেকখানি বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। যতটা সম্ভব হালকা রঙ ও ওজনের কাপড় পরিধান করাই শ্রেয়।


  • আঁটোসাঁটো কাপড়ের বদলে ঢিলেঢালা কাপড় পরাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, ঢিলে কাপড়ের মধ্য দিয়ে বাতাসের চলাচল অপেক্ষাকৃত বেশি।


  • যাদের নিয়মিত বাইরে কাজ করতেই হয় তারা দীর্ঘক্ষণ তপ্ত আবহাওয়ায় কাজ না করে ছোট ছোট একাধিক বিরতি নিয়ে করতে পারেন। এতে করে দেহের তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় থাকবে। 

 

একাধিক জরিপ অনুযায়ী, দাবদাহের মতো প্রাকৃতিক কারনে হওয়া হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১০% থেকে ৬৫% মানুষই পরবর্তীতে এই অসুস্থতা থেকে মারা যায়।  আর একই রোগে ৩% থেকে ৫% লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তপ্ত আবহাওয়া ও ঊচ্চ আর্দ্রতায় অতিরিক্ত শারীরিক কসরত করার কারণে। আমাদের দেশেও সম্প্রতি বেশ কিছু স্কুল শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে জটিল এই অসুখের কবলে পড়ে।  তাই এখনই সময়, হিটস্ট্রোকের বিষয়ে নিজে সচেতন হবার ও অন্যকে সচেতন করবার; এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে জেনে সেসবের সর্বোচ্চ বাস্তবিক প্রয়োগ নিশ্চিত করবার। যাতে আর কোন খবরের কাগজের শিরোনামে এই মারণব্যাধিতে মৃত্যুবরণ করা কোন ব্যক্তির নাম উঠে না আসে। 

To read more blogs #click here.

 

Writer

Rejawana Chowdhury Mithila

Intern

Content Writing Department, YSSE