চলচ্চিত্র – শ্যামল ছায়া। 

রচনা – হুমায়ুন আহমেদ। 

প্রকাশ – ২০০৪ 

পরিচালনায় – ইমপ্রেস টেলিফিল্ম 

 

১৯৭১,  বাঙালি জাতির জন্য প্রাপ্তি ও হতাশার এক অনন্য সন।  বাংলার মাঠ-ঘাট ,প্রান্তর  সর্বক্ষেত্রে কেবল একটি আশার বাণী,  একটি আলোর খোঁজ,  স্বাধীনতা।  তবে স্বাধীনতা প্রাপ্তি কি খুবই সহজ কিছু?  

হাজারো মাইলের রক্তাক্ত সাগর, নৃশংসতায় ভরা শহর-নগর,  হাহাকারে কেঁপে ওঠা আকাশ, নির্বাক মায়ের মুখশ্রীর দর্শন ব্যাতিত লাল সবুজের এ-ই পতাকা কি আমরা পেতাম?   হয়তো বা না।  

 

এরপর মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে রচিত হয়েছে বহু সাহিত্যকর্ম। বহু সাহিত্যিক তাদের সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই উত্তাল সময়—মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তেজনার বারুদ, সাধারণ জনতার দিশেহারা-সন্ত্রস্ত দিন,পাক-হানাদারদের নির্মমতা। শ্যামল ছায়া (২০০৪) সালের বাংলাদেশী যুদ্ধভিত্তিক নাট্য চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। 

 

সাধারণ চিত্রায়নে অসাধারণ প্রারম্ভ 

গল্পের শুরুতেই আমরা দেখতে  পাই, ‘এটি একটি নৌকা যাত্রার গল্প। ১৯৭১, আষাঢ় মাস। একদল অসহায় মানুষ যাত্রা শুরু করলো মুক্তাঞ্চলের দিকে। দেশে তখন ভয়াবহ অবস্থা! দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যার উৎসবে মেতেছে। দেশ মাতৃকার বীর সন্তানেরা শুরু করেছে স্বাধীনতা যুদ্ধ। নৌকার অসহায় যাত্রীদের মনে তীব্র আতঙ্ক। কিন্তু চোখে শ্যামল ছায়ার স্বপ্ন। তারা কি পারবে শ্যামল ছায়ায় যেতে?’

এই শ্যামল ছায়াই আসলে সোনার বাংলার কাঙ্খিত প্রতিরূপ।

 

পাকিস্তানি বাহিনী যখন গ্রামটিতে আক্রমণ করে তখন একদল মানুষ আরেকজনের ভাড়া করা নৌকায় আশ্রয়প্রার্থী হয়। এই প্রেক্ষাপটে প্রারম্ভ হয় দৃশ্যকল্পের।  জাতি, ধর্মে,  বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় নৌকাটি। মূলত এই নৌকাযাত্রায় তারা কি কি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলো এবং আসলেই কি তারা শ্যামল ছায়ার সন্ধান পেয়েছিলো কিনা এ-ই বিষয়বস্তু ধারণ করে আছে সম্পূর্ণ চলচিত্রটি। 

 

বৃদ্ধ, শিশু, তরুণ, তরুণী, অন্ধ, এমনকি গবাদি পশুও ঠাঁই পায় এই নৌকায়। এ যেন নুহের নৌকা। সবাইকে নিয়ে বিপদ পারের তরণী। এই নৌকা যাত্রাটি বেশ প্রতীকী। কখনো নৌকা চরে আটকে যায়, কখনো নৌকার ইঞ্জিন নষ্ট হয়, কখনো নৌকার পাখা নষ্ট হয়, তবু নৌকা এগিয়ে চলে, কখনো রাজাকারদের পাল্লায় পড়ে নৌকা, তবু শেষ পর্যন্ত এই নৌকা চলতে থাকে মুক্তাঞ্চলের দিকে।

 

যে যাত্রা হতে পারতো তাদের জীবনের শেষ যাত্রা।  তবুও ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের একত্রিত হওয়া এবং তদের মধ্যকার কথপোকথনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে খুব নিখুঁতভাবে চরিত্রগুলোর বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে।  সিনেমাটির বিশেষত্ব হচ্ছে, নৌকার মানুষগুলো একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন মানসিকতার হলেও কি অসাধারণভাবে সব পরিস্থিতি তারা পার করেছেন। 

 

চলচ্চিত্রটির   মূল চরিত্রে ছিলেন হুমায়ূন ফরিদী, মেহের আফরোজ শাওন, শিমুল, রিয়াজ, স্বাধীন খসরু, সৈয়দ আক্তার আলী, তানিয়া আহমেদ, এজাজুল ইসলাম, ফারুক আহমেদ প্রমুখ। 

 

মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা,  সহমর্মিতা ইত্যাদির এক অনন্য উপস্থাপনা উপভোগ করা যায় সম্পূর্ণ চলচিত্র জুড়ে। মাওলানা চরিত্রে রিয়াজের এই সংলাপ প্রক্ষেপণে ‘শ্যামল ছায়া’ আমাদের সহাবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। 

প্রসঙ্গত মনে পড়ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টতই বলেছিলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়, মনে রাখবেন।”

 

আবার একজন হিন্দু মেয়ের সম্ভ্রম বাঁচাতে মাওলানা সাহেবের পানিতে ঝাপিয়ে পড়া ।  আবার রোজা রাখা অবস্থায় কোরআন পাঠরত একজন মুসলিম মায়ের  ওপর ছায়ার ব্যবস্থা করলেন একজন হিন্দু ছেলে।  

 

 দেশের চলচিত্র সমাজ একসময় কতটা সমৃদ্ধ ছিলো তারও এক অন্যরকম নজির হুমায়ুন আহমেদের রচনা।   ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পরিচালিত ১১০ মিনিটের এ-ই চলচ্চিত্রে দর্শক সমাজে বেশ কিছু বার্তা পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়।  তৎকালীন হিন্দু সমাজের প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস, ধারণা,  গ্রামীন মানুষের মাঝে বিদ্যমান নেতিবাচকতা ইত্যাদির কুফলগুলোও তুলে ধরা হয় এ-ই চলচ্চিত্রে।  এজাজ এবং ফারুক চরিত্রের হাস্যরসাত্নক  কিছু কথপোকথন  সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রে ভিন্নধর্মী এক রসের আধার হিসেবে কাজ করেছে। চলচ্চিত্রের  অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট ছিলো গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে মাওলানা সাহেবের যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।

 

 কেন চলচ্চিত্রটি দেখবো? 

সেই নির্মাণকাল থেকে এখন পর্যন্ত সারা জাগানো এক অনন্য সৃষ্টি এ-ই চলচ্চিত্রটি। আপনি যদি মনে প্রাণে বাংলাকে ভালোবাসেন তবে আপনার হৃদপিণ্ডে অনিয়মিত স্পন্দনই তার প্রমাণ দেবে। সোনার বাংলা নামক শ্যামল ছায়ার খোঁজের এ-ই যাত্রার সর্বশেষ অংশ বিশেষ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অনন্য চির অক্ষয় ও চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলা চলচ্চিত্রের  যে এক অমায়িক নিপুণতার পরিচয় পাওয়া যায় এ চলচ্চিত্রে তা আপনার জন্যও হতে পারে লোমহর্ষক৷  

 

লেখকের পরিচয় লেখায় 

কবির পরিচয় কবিতার পাতায়। 

তাহলে চলচ্চিত্রের পরিচয় কোথায়? ” 

 অবশ্যই রুচির মাধুর্যতায় ।  আমার পক্ষ থেকে রেটিং এ ১০/১০।  আপনার মতামত কি? 

 

আরও ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

Writer 

Lutfur Nahar 

Intern 

Content Writing Department 

YSSE