শহরের কর্মব্যস্ততা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। কর্মব্যস্ত জীবন, সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবনের নানা সমস্যার চাপে যখন আমরা হাসতে ভুলে যাই, তখন আমাদের মুখে হাসি ফুটে উঠে ৩-৪ মিনিটের ছোট্ট কিছু ভিডিও দেখে। এমনই ছোট্ট কিছু কার্টুন ভিডিও এর মাধ্যমে সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলছে শিফু, পুচকি চরিত্রের দুইজন।  তাদের খুনসুটি হাসাতে বাধ্য করে সবাইকে, দুই মিনিট ভুলে থাকতে দেয় জীবনের সমস্যাগুলোকে। কিন্তু এই শিফু, পুচকির নির্মাতা, যিনি সবার মাঝে হাসি ছড়াচ্ছেন, তাঁর সম্পর্কে জানে এমন মানুষ কিন্তু খুবই কম। আজকের এই ব্লগে আমরা তাঁর সম্পর্কেই জানবো, যিনি নিরবে সবার মাঝে হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

YSSE : প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছি। আপনার পরিচয়, বেড়ে উঠা, পড়াশোনা, বর্তমানে কী করছেন ইত্যাদি।

আমার প্রকৃত নাম সাখাওয়াত হোসেন সিফাত। ফেসবুকে সবাই আমাকে আরফিন সিফাত নামেই চেনে। আমার জন্ম নওগাঁতে এবং বেড়ে উঠা রাজশাহী শহরে, বর্তমানে এখানেই আছি। রাজশাহী শহরে আমার কনটেন্ট তৈরির যাত্রা শুরু এবং এখনো চলছে। বর্তমানে পড়ালেখার পাশাপাশি কনটেন্ট তৈরি করছি।

YSSE : “Sifat Cartoon Store” এর এই পর্যায়ে আসার পিছনের গল্পটা সম্পর্কে জানতে চাইছি।

প্রতিটা সাফল্যের পিছনে একটা বড় গল্প লুকিয়ে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা, বন্ধু-বান্ধব দের সমালোচনা, কোনরকম প্রমোট ছাড়া এই অবস্থানে আসা সহজ ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই আমার কার্টুন ভালো লাগতো না। তাই যারা কার্টুন দেখতো তাদের কাছেও ভিড়তাম না।

আসলে প্রতিটি মানুষই ছোট থাকতে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে যে আমি বড় হয়ে এরকম কিছু করবো। তো আমার ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিলো যে আমি এমন একটা পর্যায়ে যাবো বা এমন একটা স্থানে যাবো, যেখানে বাংলাদেশের সব মানুষ আমাকে এক নামে চিনবে। যেখানে আমি আমার চেহারা প্রকাশ না করেও সবার পছন্দের তালিকায় নিজের জায়গা করে নিতে পারবো। সেই উদ্দেশ্যেই আমি গেমিং, বিভিন্ন স্ট্রিমিং এর মত কাজ করেছি কিন্তু সফলতা পাইনি।

সেই মুহূর্তে কন্টেন্ট ক্রিয়েটিং এর কথা আমি জানতাম না এবং কার্টুনিস্ট হওয়ার ইচ্ছাও আমার ছিলো না। একটা সময় বিভিন্ন কনটেন্ট ক্রিয়েটর এর কাজ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। একই সাথে যখন বিভিন্ন বাংলাদেশি কার্টুন আমার নিউজফিডে আসতে থাকে, তখন আমি ভাবতে শুরু করি, এই জিনিসটা আমি চেষ্টা করলে কেমন হয়, এখানে তো আমার চেহারা প্রকাশ করতে হচ্ছে না।

কিন্তু কাজটা শুরু করতে গেলে পরিবার থেকে নানারকম চাপ আসে। যেহেতু তাদের ইচ্ছা ছিলো না আমাকে পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু করতে দেয়ার। এমনকি যখন আমি কার্টুন নিয়ে কিছু করতে চাইছি, এই সম্পর্কে বন্ধুদের সাথে কথা বলতাম, তখন তারা নানারকম হাসি-তামাশা করতো। তাই আমি আমার কাজটা সম্পর্কে আর কাউকে জানাতে চাই নি। প্রথম থেকেই আমি জানতাম না যে স্মার্টফোনের মাধ্যমে কার্টুন তৈরি করা যায় এবং সেই সময় ল্যাপটপ না থাকায় আমার কাছে জিনিসটা অসম্ভব মনে হতো। তাও আমি ইউটিউবে এই সংক্রান্ত ভিডিও গুলো নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করি এবং এমন কোন অ্যাপ ছিলো না যেটা আমি ইন্সটল করিনি শুধুমাত্র কার্টুন শিখবো বলে

তো এক পর্যায়ে আমি একটা অ্যাপের মাধ্যমে ছোট এনিমেশন তৈরী করার চেষ্টা করতে থাকি। প্রথমদিকে হতো না, আবার চেষ্টা করতাম। একপর্যায়ে ছোটখাটো ভাবে এনিমেশন তৈরী করা শিখি, কিন্তু আসলে জিনিসটাকে একসময় প্রফেশনালি নিবো বা এতদূর নিয়ে আসবো এটা কখনো চিন্তা করিনি। ভাবতাম আপলোড দিবো, কেউ দেখলে দেখবে, না দেখলে না দেখবে।

তো 2021 সালের আগস্ট মাসে আমি পেজটি শুরু করি এবং সম্ভবত নভেম্বর 21 তারিখে আমার আর পুচকি একটা ভিডিও আপলোড করা হয় সেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু।

YSSE : শিফু আর পুচকির আইডিয়াটা আপনার কাছে কীভাবে আসলো? সবার প্রিয় চরিত্র ‘পুচকি’ কি বাস্তব নাকি কাল্পনিক?

শিফু, পুচকি চরিত্রগুলো বাস্তব। বাস্তব জীবনেও আমি পুচকি বলেই ডাকি এবং পুচকিও আমাকে শিফু বলেই ডাকে। কার্টুন শিফু, পুচকি চরিত্রের কথোপকথনও বাস্তবে আমাদের মধ্যে যেভাবে কথা হয় ঠিক সেভাবেই তুলে ধরা হয়। যাতে আমাদের এই টম এন্ড জেরির মতো সম্পর্ক এবং কথোপকথন সবাই উপভোগ করতে পারে। 

বাস্তব জীবনে পুচকি হলো আমার বোনের মেয়ে। কিন্তু ওর কথাবার্তা, চলাফেরার অনেক কিছুই আমরা কার্টুন পুচকিতেও তুলে ধরি। মূলত আমাদের বাস্তব জীবনের কিছু ঘটনা একত্রিত করে আমরা একটা টপিক এর মাধ্যমে তুলে ধরি।

YSSE : আপনার এই কাজের পিছনে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে কে বা কারা? 

আমার প্রথম অনুপ্রেরণা জোগানোর কথা বললে সেই ব্যক্তি টা আমি নিজে। আমি নিজেই ভেঙে পড়তাম আবার নিজেই নিজেকে মোটিভেট করতাম। এরপর বলতে হলে, পুচকি আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা যোগায়। অন্যরা আমার কাজ নিয়ে কথা না বললেও, পুচকি  নিজের থেকেই বিভিন্ন প্ল্যান বানায়। এছাড়াও প্রথমদিকে পরিবার থেকে সহায়তা না পেলেও, বর্তমানে তারাও আমাকে বেশ সাপোর্ট করে। আমার মা, বাবা, বোন, ভাইয়া এছাড়াও আমাদের গ্রুপ যিনি ম্যানেজ করেন, উর্মি  এবং এক বড় ভাই, তানভীর আমাকে প্রচন্ড ভাবে সাপোর্ট করেন।

YSSE : একজন অ্যানিমেশন ক্রিয়েটার হিসেবে আপনাকে কী কী দক্ষতা অর্জন করতে হয়েছে?

প্রথমেই অ্যানিমেশন সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা থাকতে হবে। এছাড়াও ভিডিও কোয়ালিটি, সাউন্ড কোয়ালিটি, সবকিছু ম্যানেজ করা, অনলাইন টুলস সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা অর্থাৎ কন্টেন্ট ক্রিয়েটিং এর জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জানতে হবে। ছোটবেলা থেকেই আমি কম কথা বলতাম, তো এটার জন্য আমার কথা বলার দক্ষতাও অর্জন করতে হয়েছে।

YSSE : আপনার এই কাজে আপনার কোনটি সবচেয়ে বড় সফলতা মনে হয়েছে?

আমার কাছে সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে মানুষের ভালোবাসা পাওয়াটা। একসাথে এত মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি ভেবে, আমি আমার পিছনের সব কষ্ট ভুলে গেছি।

YSSE : কখনো কী কাজটা ছেড়ে দেয়ার মতো চিন্তা মাথায় এসেছে?

আসলে যখন মানুষের কোন কাজে সফলতা দেখা মেলে না, তখন তা ছেড়ে দেয়ার চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। হ্যাঁ, আমিও ভাবতাম। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ভাবতাম যে, কালকে থেকে আর এই কাজগুলো করবোই না। কিন্তু সকালে আবার ঘুম থেকে উঠলে মনে হচ্ছে, কালকে রাতে তো সফলতা আসতেও পারে। এভাবেই আমার এতদূর আসা।

YSSE : বাংলাদেশে এখন তো অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিযোগিতা রয়েছে, তো এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আপনি কি পন্থা অবলম্বন করেছেন? 

আসলে প্রতিটা কর্মক্ষেত্রেই প্রচন্ড প্রতিযোগিতা রয়েছে। অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাটা দিন দিন বাড়ছে। আসলে যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে অনন্যতা আনতে পারলে সাফল্য অর্জন করাটা কিছুটা সহজ হয়ে যায়।  আপনি আপনার কনটেন্টে যত বেশি ক্রিয়েটিভিটি আনতে পারবেন, সাধারণ মানুষ সেটা বেশি পছন্দ করবে। আমার ক্ষেত্রে, আমার আর পুচকির ব্যতিক্রমী যে কথোপকথন এটা হয়তো সবাইকে আকর্ষণ করে। এছাড়াও কিছু মানুষের ভিডিও শুধু ছেলেরা কিংবা মেয়েরা, শুধুমাত্র বাচ্চারা দেখে আবার কিছু ভিডিও রয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, কিন্তু আমাদের ভিডিও গুলো কিন্তু সকল শ্রেণীর, সকল বয়সের মানুষ দেখতে পারছে যেটা আমাদের সাফল্য অর্জনে বেশি সহায়ক ছিল।

YSSE : আপনার এই কাজের মধ্যে আপনি কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন এবং কীভাবে সেই বাধাগুলোকে কাটিয়ে উঠেছেন? 

আসলে মানুষ যখন ভালো কিছু করে, তখন তার পিছনে লাগার মানুষের অভাব হয় না। এমন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলাম যে মনে হয়েছে, এখানেই আমাদের যাত্রা শেষ। কিন্তু আমাদের সমর্থক অর্থাৎ যারা আমাদের ভিডিও দেখে, তাদের সাপোর্ট, ভালোবাসার কারণেই আমরা এখনো আছি এবং নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি তাদের পাশে থাকার।

YSSE : আপনার পছন্দের ব্যক্তিত্ব কে?

আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর রফিকুন নবী। তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম, “টোকাই” আমাকে বেশ অনুপ্রেরণা যোগায় এবং তাকে অনুসরণ করেই এই তো এই পর্যায়ে।

YSSE : আপনি তো বললেন যে, ছোটবেলা হতেই আপনার কার্টুনের প্রতি ঝোঁক ছিলো না, তাহলে পরবর্তীতে এমন কোনো কার্টুন কী ছিলো যেটা আপনার ভালো লেগেছে বা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে কার্টুন নিয়ে কাজ করতে? 

হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। আমার প্রিয় একটি চরিত্র যেটা আগে ছিল, এখনও আছে তা হলো শামীমা শ্রাবণীর “ইয়ামিন”। মূলত তাদের কার্টুনের কনসেপ্ট আমার কার্টুন তৈরি ইচ্ছাকে বাড়িয়ে দেয়। যদিও মূল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল রফিকুন নবী স্যারের ” টোকাই” থেকে।

YSSE : আপনার কাজের ক্ষেত্রে আপনি কোন জিনিসটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন?

আমরা ভিডিও তৈরীর সময়, মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করতে পারে কিংবা মানুষের ব্যক্তিত্ব বা দুর্বলতাকে আঘাত করতে পারে এ ধরনের কোনো লেখা যাতে স্ক্রিপ্টে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখি। আসলে কোন মানুষকে হাসানো সহজ, কিন্তু হাসাতে গিয়ে তাদের অনুভূতিকে কোন ভাবে আঘাত করতে চাই না আমরা।

YSSE : একজন ব্যক্তির অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করা যে কোন ব্যক্তির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তারা তো আছেনই, সাথে যারা নতুন, তারাও চেষ্টা করে গেলে একদিন না একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন। তবে আমার মতে, অ্যানিমেশন বা কার্টুন নিয়ে কাজ করা ব্যক্তির জীবনে বিয়ে নিয়ে সমস্যা হয়ে যাবে। (হাঁসতে হাঁসতে)। মানে যখন জিজ্ঞেস করবে, ছেলে কি করে? তখন যদি বলা হয় ছেলে ‘কার্টুনিস্ট’, তারা তো বলবে, “ওহ আচ্ছা, ছোটবেলাও কার্টুন, বড় হয়েও কার্টুন।”

YSSE : আপনার কাজের মূলমন্ত্র কী?

এক কথায় বলতে গেলে, আমার দর্শকদের ভালোবাসাই আমার কাজের মূলমন্ত্র।

YSSE : সবশেষে আপনার দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

আমার দর্শকদের বলবো, তোমরা আমাকে যেভাবে ভালোবাসা দিয়েছো, সেভাবে ভালবাসতে থাকো। সবসময় আমার পাশে থাকো। আমার জায়গা থেকে তোমাদের জন্য যতটুকু করার আমি সবসময় করে যেতে থাকবো

“আপনাদের ভালোবাসার কাঙ্গাল

-সাখাওয়াত হোসেন সিফাত” 

আরো ব্লগ পড়তে এখানে  #ক্লিক করুন।

Writer,

Diderul Islam 

Intern, Content Writing Department 

YSSE