দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের বনাঞ্চলের বেশ ক্ষতি হয়। যুদ্ধের চাহিদা মেটাতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন হয়। যুদ্ধের পর জাপান বনাঞ্চল পুনরুদ্ধারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়। যেখানে যেমন প্রাকৃতিক বন ছিল সেখানে তেমনই বন সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় । দেশটি ফের বৃক্ষ সমৃদ্ধ হতে যে কৌশলকে প্রাধান্য দেয় তার নাম ‘ডাইসুগি’। 

 

ডাইসুগি: গাছ না কেটে কাঠ উৎপাদন 

 

ডাইসুগি হল একটি জাপানি শব্দ যার অর্থ “দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকা গাছ”। এটি একটি প্রাচীন জাপানি কাঠ উৎপাদন পদ্ধতি যা গাছকে কেটে না ফেলে কাঠ উৎপাদন করে যা জাপানে ১৪ শতকে উদ্ভাবিত হয়েছিল। এই পদ্ধতিতে, গাছের ডালপালাগুলিকে পরিকল্পিতভাবে ছাঁটাই করা হয়, যার ফলে গাছটি শক্তিশালী হয় এবং আরও বেশি কাঠ উৎপন্ন করে। ডাইসুগি পদ্ধতিটি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই, এবং এটি জাপানের বনাঞ্চলের পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

 

ডাইসুগি পদ্ধতির ইতিহাস

 

ডাইসুগি পদ্ধতির উৎপত্তি ১৪ শতকে জাপানে। সেই সময়, জাপানে বনজ সম্পদ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে বনজ সম্পদ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, জাপানিরা ডাইসুগি পদ্ধতি উদ্ভাবন করে।

 

ডাইসুগি পদ্ধতিটি প্রথমে জাপানের দাইগোকু অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বন ছিল, এবং ডাইসুগি পদ্ধতি ব্যবহার করে এই বনজ সম্পদকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল।

 

ডাইসুগি পদ্ধতির নীতি

 

ডাইসুগি পদ্ধতির মূল নীতি হল গাছকে কেটে ফেলা না দিয়ে, গাছের ডালপালাগুলিকে পরিকল্পিতভাবে ছাঁটাই করা। এই ছাঁটাই গাছের বৃদ্ধি এবং বিকাশকে প্রভাবিত করে, যার ফলে গাছটি শক্তিশালী হয় এবং আরও বেশি কাঠ উৎপন্ন করে।

 

ডাইসুগি পদ্ধতিতে, গাছের নিচের অংশে ছোট ছোট ডালপালাগুলিকে ছাঁটাই করা হয়। এই ছাঁটাই গাছের মূলকে শক্তিশালী করে এবং এটিকে আরও বেশি খনিজ পদার্থগুলো এবং পুষ্টি গ্রহণ করতে সাহায্য করে।

 

গাছের মাঝখানের অংশে, বড় বড় ডালপালাগুলিকে ছাঁটাই করা হয়। এই ছাঁটাই গাছের কাঠামোকে শক্তিশালী করে এবং এটিকে আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে।

 

গাছের উপরের অংশে, সবচেয়ে পুরানো এবং মৃত ডালপালাগুলিকে ছাঁটাই করা হয়। এই ছাঁটাই গাছকে আরও সূর্যালোক এবং বাতাস পাওয়ার সুযোগ করে দেয়।

 

ডাইসুগি পদ্ধতিতে কাঠ উৎপাদন

 

ডাইসুগি পদ্ধতিতে কাঠ উৎপাদনের জন্য, প্রথমে গাছের ডালপালাগুলিকেপরিষ্কার করে নিয়ে ছাঁটাই করতে হয়। ছাঁটাই করার সময়, ডালপালাগুলিকে এমনভাবে ছাঁটাই করতে হয় যাতে গাছটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়,গাছটি সোজা এবং গিঁটমুক্ত কাঠ উৎপন্ন করতে পারে। ছাঁটাই করার ফলে, গাছটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নতুন ডালপালা গজাতে থাকে। 

 

নতুন ডালপালাগুলিকে কাঠ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য, সেগুলিকে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হয়। পরিষ্কার করার সময়, ডালপালাগুলি থেকে পাতা, ফুল এবং ফলগুলিকে সরিয়ে ফেলতে হয়। পরিষ্কার করার ফলে, ডালপালাগুলি শুকিয়ে যায় এবং কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা সহজ হয়। 

 

ডাইসুগি পদ্ধতির সুবিধা 

 

ডাইসুগি পদ্ধতির অনেক সুবিধা রয়েছে।

 

◑ পরিবেশবান্ধব: গাছকে গোড়া থেকে না কেটে কাটায় পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।

 

◑ উন্নত মানের কাঠ: গাছকে নিয়মিত প্রুনিং করায় কাঠটিতে গিঁট থাকে না এবং তা সোজা ও শক্ত হয়।

 

◑ দীর্ঘস্থায়ী কাঠ উৎপাদন: গাছটিকে গোড়া থেকে না কাটায় তা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এবং কাঠের উৎপাদন অব্যাহত থাকে।

 

◑পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ: এই পদ্ধতিটি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই। এটি গাছকে কেটে ফেলে না, তাই এটি বনজ সম্পদকে রক্ষা করে।

 

◑মূল্যমান নিয়ন্ত্রণ: ডাইসুগি পদ্ধতি ব্যবহার করে, একই গাছ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে কাঠ উৎপাদন করা সম্ভব। এটি কাঠের চাহিদা পূরণে সহায়তা করে এবং কাঠের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখে।

 

◑প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ: ডাইসুগি পদ্ধতি ব্যবহার করে উৎপাদিত কাঠের গুণমান ভালো হয়। এই কাঠটি সোজা, গিঁটমুক্ত এবং শক্তিশালী হয়।

 

ডাইসুগি পদ্ধতির অসুবিধা 

 

◑ব্যয়বহুল: ডাইসুগি পদ্ধতিতে গাছকে নিয়মিত প্রুনিং করতে হয়, যা একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।

 

◑দক্ষতা প্রয়োজন: ডাইসুগি পদ্ধতিতে গাছকে কেটে ফেলার জন্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারা করা হয়, যা একটি দক্ষতা প্রয়োজন।

 

ডাইসুগি পদ্ধতির সম্ভাব্য প্রভাব  

 

ডাইসুগি পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী কাঠ উৎপাদন শিল্পে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এই পদ্ধতিটি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই, যা কাঠের উৎপাদনকে আরও টেকসই করে তুলতে পারে। এছাড়াও, ডাইসুগি পদ্ধতিতে উন্নত মানের কাঠ উৎপাদন করা যায়, যা কাঠের শিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। 

 

বাংলাদেশে ডাইসুগি পদ্ধতির সম্ভাবনা ব্যাপক। বাংলাদেশের বনাঞ্চল বেশ সমৃদ্ধ এবং এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে যা ডাইসুগি পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত। ডাইসুগি পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের কাঠ উৎপাদন শিল্পকে আরও টেকসই এবং লাভজনক করে তোলা সম্ভব।

 

ডাইসুগি পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ

 

ডাইসুগি পদ্ধতির কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল: 

 

◑ দক্ষতা: ডাইসুগি পদ্ধতিতে কাঠ উৎপাদনের জন্য দক্ষতা প্রয়োজন। প্রশিক্ষিত কাঠুরে না হলে এই পদ্ধতি সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না।

 

◑ সময়: ডাইসুগি পদ্ধতিতে কাঠ উৎপাদনের জন্য সময় লাগে। গাছকে পূর্ণ বৃদ্ধি পেতে দেওয়া হয় এবং তারপর কাঠ উৎপাদন করা হয়।

 

◑ছাঁটাই পদ্ধতি: ডাইসুগি পদ্ধতিতে গাছকে বিশেষভাবে ছাঁটাই করা হয় । যদি ছাঁটাই সঠিকভাবে না করা হয়, তাহলে গাছটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

 

◑অতিরিক্ত পরিশ্রম :ডাইসুগি পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য অনেক পরিশ্রম প্রয়োজন হয়। গাছের ডালপালাগুলিকে ছাঁটাই করার জন্য বিশেষ সরঞ্জাম এবং দক্ষতা প্রয়োজন।

 

◑পূর্ব পরিকল্পনা :এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করার জন্য, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন।

 

ডাইসুগি পদ্ধতির সম্ভাবনা

 

ডাইসুগি পদ্ধতি একটি অনন্য টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব কাঠ উৎপাদন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটি বিশ্বব্যাপী বৃহৎ আকারে গ্রহণ করা যেতে পারে।যা বিশ্বব্যাপী বৃক্ষনিধন সমস্যা সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

ডাইসুগি পদ্ধতি ব্যবহার করে,বৃক্ষনিধন না করে বনজ সম্পদকে রক্ষা করা সম্ভব। এটি কাঠের চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে এবং কাঠের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখবে।

 

এরকম আরো ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন। 

লেখিকা,

ফারিহা আলিফ

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *