বাংলাদেশে বর্তমানে মার্কেটিং জগতে জনপ্রিয় নাম নাফিস সালিম। তাঁর মার্কেটিং সম্পর্কিত ভিডিও অনুপ্রাণিত করেছে অনেক উদ্যোক্তাকে। তাঁর বেড়ে উঠা, পড়াশুনা এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানবো এই ব্লগে।

YSSE : আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন। (নাম, পড়াশোনা, বর্তমানে কী করছেন,আপনার বেড়ে ওঠা ইত্যাদি)

A : আমার নাম নাফিস সালিম। আমি বর্তমানে লাইফস্প্রিং (lifespring) যা মানসিক এবং শারীরিক সুস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা, এখানে হেড অব ডিজিটাল মার্কেটিং এই পদে নিযুক্ত আছি।

আমার ছোটবেলা থেকেই মার্কেটিং এর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। আমি যখন ক্লাস টুতে পড়তাম, তখন আমার কাজিনদের মধ্যে একটা মুদ্রা তৈরি করি যেটা ব্যবহার আমাদের মধ্যে গিফট কার্ড, চকোলেট বিনিময় করা যেতো। 

বন্ধুদের কাছে চকোলেট, পোকেমন কার্ড বিক্রি করতাম। আমাকে “মার্কেটিং খুব নাড়া দিত”। এই ব্যাবসার পোকা আমার মধ্যে ছোট থেকেই ছিল।

আমার আশেপাশে যারা ছিলেন অর্থাৎ আমার বাবা, চাচা, দাদা সবাই ব্যাবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তাই একবার আমাকে বলা হয়েছিল যে, ব্যাবসা আমার রক্তে মিশে আছে।

ছোটবেলা থেকে চাইতাম বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবো কিন্তু মনে মনে ভাবতাম কিভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাথে ব্যাবসা মেলানো যায়। কিন্তু বাবা মাকে কখনো সাহস করে বলতে পারিনি যে আমি ব্যাবসা নিয়ে পড়াশুনা করতে আগ্রহী।

আমি পড়াশোনা করেছি মার্কেটিং নিয়ে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, আমি পড়ে যতটা না শিখেছি তার চেয়েও বেশি শিখেছি অবজার্ভ করে। 

একটা কেস ষ্টাডি বুঝতে পড়াশুনা মোটিভেশন দেয় এবং সর্বোপরি জীবনের কোন ক্ষেত্রে কি কাজে লাগবে এই ধারণার জন্য পড়াশুনা আমাকে সাহায্য করেছে। 

আমি পড়াশুনা করতে যাই স্টনি ব্রুক ইউনিভার্সিটিতে ২০১১ সালে, সেখানে আমি কন্টিনিউ করিনি এবং পরবর্তীতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়েছি। 

এরপরে আমি পড়াশুনা শেষ করেছি স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক এর অধীন এম্পায়ার স্টেট কলেজে মার্কেটিং থেকে।

আমি মার্কেটিং নিয়ে খুব ভাবতাম। তখন আমেরিকান কিছু ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করি। ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরেও আমার কাজ করা ততদিনে শুরু হয়। আমি একটা স্টার্টআপের সাথে যুক্ত ছিলাম যেটা ছিল আমেরিকান স্পেস স্টার্টআপ। 

এরপরে কন্টেন্ট ক্রিয়েশনে আসা হয়; “Naf bro” নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল ছিল, যেখান থেকে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করি। আমি ড্রপ শিপিং করেছি তাই ই কমার্স ব্যাবসা সম্পর্কেও অনেক অভিজ্ঞতা হয়। এছাড়াও আমেরিকাতে কিছু কোম্পানিতে বেশ কিছুদিনের জন্য কাজ করেছি।

YSSE : আপনার বিজনেস সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। আপনার পেইজ “Nafees Salim”, বিজনেস, “SpringLife”, “Storyketcher”, “Mango resort convention Hall.”

A : আমার Nafees Salim পেজে আমি মূলত মার্কেটিং ও ব্যাবসা বিষয়ক ভিডিও বানাই যেখান আমার পছন্দের টপিক নিয়ে আলোচনা করি। আর মানুষ এখন বই পড়ায় কম আগ্রহী কিন্তু কোনো টপিক যদি গল্পের আকারে বলা হয় তাহলে শুনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

লাইফস্প্রিং নিয়ে আমি বলেছি একবার। আর Storyketcher এবং Mango Resort Convention Hall হলো আমার ছোট দুটো ব্যাবসা। 

Mango Resort Convention Hall রাজশাহীতে সবচেয়ে বড় কনভেনশন সেন্টার যেখানে বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজিত হয়। আর Storyketcher একটা বিয়ের স্টেজ ডেকরেশনের একটা ছোট খাটো ব্যবসা।

YSSE : আপনি এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পিছনের রহস্যটা কি? 

A : প্রথমত, আমি নিজেকে সফল বলবো না। যেদিন আমি নিজেকে সফল ভাববো সেদিনই আমি ব্যার্থ হবো। আমি এখনও অনেক ছোট, আমার বড় হওয়ার অনেক জায়গা আছে এবং সফলতার কোনো মাপকাঠির মধ্যে আমি পড়ি না। 

আমি এখনও স্টুডেন্ট, আমি শিখতে চাই ভুল থেকে। আমি রিস্ক নিয়েছি অনেক ক্ষেত্রে এবং আমি যদি বলি এইটুকু উঠে আসার পিছনে “রিস্ক নেওয়া” সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। রিস্ক নেওয়ার কারণে আমি বুঝতে পেরেছি কোনটা সঠিক, যদিও এটা বের করা ছিল খুব কষ্টকর কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, “আমি পেরেছি”

YSSE : অনুপ্রেরণা কারা বা কী ছিল? এবং আপনার সফলতার পেছনে কাদের সাপোর্ট এর কথা আপনি উল্লেখ করতে চান?

A : সরাসরি অনুপ্রেরণা তেমন কেউই ছিল না কিন্তু আমার দাদা আমাকে পরোক্ষ অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।

আমার দাদা আমার জন্মের এক বছর আগে মারা যান, তাকে আমি দেখতে পাইনি। তিনি রাজশাহীর একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর গল্প, তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, তাঁর কাজ সবকিছু আমাকে অনুপ্রাণিত করতো যেনো আমি আমার দাদার মত হতে পারি।

আমার সফলতার পিছনে একমাত্র সাহায্য এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে, এছাড়া আর কিছুই নয়। আমি আজ যেই অবস্থানে আছি শুধু মাত্র আল্লাহর জন্য। যদি কেউ মনে করেন যে আমার প্রতিভার জন্য এতদূর এসেছি, তবে আরো পাঁচ বছর আগে কেনো আসতে পারলাম না এই অবস্থানে?

প্রত্যেকটা বিষয় একটা আরেকটার সাথে জড়িত আল্লাহ সফলতার দানকারী, তাই আল্লাহর সাহায্যের জন্যই আমার আজ এতদূর আসা সম্ভব হয়েছে।

আর মানুষের মধ্যে যদি কারো উল্লেখ করতে হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট করেছে আমার স্ত্রী। সে আমাকে যতটা সাপোর্ট করেছে, আর কেউ এমন সহযোগিতা আমাকে করেনি।

YSSE : আপনার এই সফলতার পেছনে প্রতিবন্ধকতা ছিল কি? থাকলে সেগুলো কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা। এবং কীভাবে সেগুলো ওভারকাম করেছিলেন?

A : আমার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা, Nafees Salim, আমি নিজে। মানুষের সবচেয়ে বড় বাঁধা সে নিজেই। আপনার যদি ইচ্ছাশক্তি এবং সম্ভাবনা থাকে তাহলে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মানুষের ক্ষমতা নেই যে আপনাকে দমিয়ে রাখবে।

আপনার মধ্যে পৃথিবী জয় করার শক্তি সামর্থ্য আছে, তাই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। আমি মনে করি জীবনে যদি কোথাও বাঁধা পেয়ে থাকি সেটা আমার নিজের দোষে তাছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। 

যদি আল্লাহ তকদিরে না রাখেন সেটা এক কথা এছাড়া আমার প্রতিবন্ধকতা আমি নিজেই।

YSSE : আপনার YouTube চ্যানেল সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। শুরু কিভাবে এবং কি কি কনটেন্ট নিয়ে কাজ করছেন? 

A : ২০১৪ সালে ইউটিউব চ্যানেল করি “Naf Bro” নামে। চ্যানেলে মূলত বিনোদনমূলক কন্টেন্ট তৈরি করতাম। প্রায়, ৮৬ হাজার সাবস্ক্রাইবার হয় এই চ্যানেলে।

এরপরে আমি ভিডিও দেওয়া বন্ধ করি এবং স্টেপ ব্যাক করি। জীবন নিয়ে চিন্তা করি যে আমি ঠিক কাজ করছি কিনা। ২০১৯ সালে আমি অফিসিয়ালি ঘোষণা দেই যে আমি আর কন্টেন্ট তৈরি করবো না।

২০২১ সালের আগস্ট মাসে আমি আবার কন্টেন্ট তৈরি শুরু করি একদম নতুন আঙ্গিকে, নিজের নামে। 

মার্কেটিং এবং ব্যবসায় সংক্রান্ত টপিকের কন্টেন্টএর জন্য Nafees Salim ব্র্যান্ড শুরু করা। 

অনেকে ভাবতে পারে আমি মার্কেটিং এর গুরু কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার চেয়ে জ্ঞানে অনেক বড় মানুষ আছে, তাদের তুলনায় আমি ক্ষুদ্র।

আমি মনে করি যেটা আমি শিখছি তাতে আরো ১০ জনের কাজে আসতে পারে তাহলে আমি তা ১০ জনকে শেখাবো।

হাদীস অনুসারে, জ্ঞান আর সম্পদ যত বণ্টন করবেন তত বৃদ্ধি পাবে। 

এছাড়া একটা ভিডিও করতে গেলে আমার নিজেও প্রচুর পড়তে হয়, গবেষণা করতে হয়, এটা আমার জন্যও নতুন সুযোগ তৈরি করে দেয়।

তবে আমি বিশ্বাস করি যদি আমার একটা বাক্যে কোনো উদ্যোক্তার ব্যবসায় সফল হয় তাহলে সেখানেই আমার কাজ সার্থক। আমার আশা যেনো আমার মাধ্যমে আরো উদ্যোক্তা এবং ব্যাবসায়ী তৈরি হয়, অনুপ্রাণিত হয়, সফল হয়, তখনই আমার ভিডিও,কাজ সার্থকতা খুঁজে পাবে।

YSSE : যে তরুণরা আপনার মতো উদ্যোক্তা হতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার সাজেশন কী থাকবে?

A : আমি বলবো আমি কোনো সফল উদ্যোক্তা না। আপনি আমার মত না হয়ে আপনার মত করেই উদ্যোক্তা হবেন।

ভালো বই পড়েন, ভালো মেন্টর খুঁজে বের করেন যে কিনা আপনাকে আপনার ফিল্ডে সফল হতে সাহায্য করবে। আপনি যদি ফ্রিল্যান্সিং এ যেতে চান বা রেস্টুরেন্ট খুলতে চান, তাহলে এই সেক্টরে ভালো কে আছে তাকে খুঁজে বের করুন, সেখানে আমাকে খুঁজলে হবে না। আমি হয়ত একটা সামগ্রিক ধারণা দিতে পারবো।

এছাড়া হাল ছাড়া যাবে না, ভুল করার এবং মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে, হতাশা মোকাবেলা করতে জানতে হবে। একজন ভালো পার্টনার বেছে নিতে হবে। ভালো উদ্যোক্তার মানুষকে দিতে পারার মানসিকতা রাখতে হবে, আগ্রহী থাকতে হবে। সবশেষে, কাজ করতে থাকতে হবে, ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু হবে। ধন্যবাদ।

ইন্টারভিউ নিয়েছেন : আনিকা ওয়াহাব। 

এরকম আরো ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন এখানে। 

লেখিক

নুসরাত জাহান সোনিয়া

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *